বিজ্ঞাপন

জীবনকে হারিয়ে ‘শোধ নিলেন’ শাহজালাল বলী

April 25, 2023 | 6:59 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

লালদিঘী থেকে: তিন বছর পর লালদিঘী ময়দানে ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলী খেলার আসর। হাজারো দর্শকের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মধ্যে লড়ছেন দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে আসা বলীরা। চূড়ান্ত পর্বে মুখোমুখি সেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কক্সবাজারের চকরিয়ার তারিকুল ইসলাম জীবন এবং কুমিল্লার হোমনার শাহজালাল। সুঠাম দেহের দুই বলী ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে’ এই অবস্থা।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) সোয়া ৫টায় বলী খেলার চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয়। কিন্তু মাত্র এক মিনিট পাঁচ সেকেন্ডেই অবসান হলো মঞ্চের চারপাশে অবস্থান নেওয়া দর্শকদের টানটান উত্তেজনা। জীবনকে হারিয়ে শাহজালাল বলী অর্জন করলেন জয়ের মুকুট। গত আসরে এই জীবনের কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন শাহজালাল। এবার জীবনকে পরাস্ত করে মধুর প্রতিশোধ নিলেন তিনি।

প্রধান রেফারি আব্দুল মালেক যখন শাহজালালের হাত উঁচিয়ে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করেন, দর্শকরা হাততালি দিয়ে ঢোল, বাঁশি ও ভুভুজেলা বাজিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান।

বিজ্ঞাপন

২০১৮ সালেও জীবনকে পরাস্ত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন শাহজালাল। ২০১৯ সালে অবশ্য জীবন প্রতিশোধ নিয়েছিলেন শাহজালালকে হারিয়ে। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বলীখেলা হয়নি। ২০২২ সালে শাহজালালকে হারিয়ে বিজয়মাল্য পরেছিলেন জীবন।

তবে পরাস্ত হওয়া জীবন জানিয়েছেন, অসুস্থতার কারণে ফাইনালে নিজেই আত্মসমর্পণ করেছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার শরীর অসুস্থ। কোমরে ও পায়ের রগে একটু সমস্যা হয়েছে। সেমিফাইনালে সৃজন চাকমাকে যখন আমি চাপ দিই, আমার ব্যথাটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সেজন্য আমি ছাড় দিয়েছি।’

জানতে চাইলে শাহজালাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জীবন আমাকে বলেছে, সে অসুস্থ। তখন আমি ওকে বলি, তুমি অসুস্থ হলে আমার কিছু করার নেই। খেলায় যে জিতবে সে চ্যাম্পিয়ন। তুমি ফাইট করো। তখন সে ফাইট করতে পারবে না বলে জানায়।’

বিজ্ঞাপন

পুরস্কারের টাকায় কী করবেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাড়িতে আমার মা, স্ত্রী ও সন্তান আছে। তাদের জন্য কিছু খরচ করব। আমার শরীর ঠিক রাখতে মাসে আট হাজার টাকার মতো খরচ হয়। ২০০০ সাল থেকে আমি বলী খেলে আসছি। আমাদের এলাকায় অবশ্য এই খেলাকে কুস্তি বলা হয়ে থাকে।’

আব্দুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে জানান, এবার বলীখেলায় অংশ নিতে মোট ১০০ জন তাদের নাম নিবন্ধন করেছিলেন। যাচাই-বাছাইয়ের পর ৪০ জনকে বাদ দেওয়া হয়। মোট ৬০ জন প্রতিযোগী এবারের বলী খেলায় অংশ নেন।

২০ ফুট উঁচু ও ২০ বর্গফুটের বালির মঞ্চে খেলার সাধারণ রাউন্ড শেষে দ্বিতীয় রাউন্ডে মোট আট জন অংশ নেন। এদের মধ্যে তিন জন গতবার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। দুই রাউন্ডের সেমিফাইনালের প্রথম পর্বে সৃজন চাকমা ও জীবন বলি অংশ নেন। ১ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড লড়াইয়ের পর জিতে আসেন জীবন বলী। দ্বিতীয় রাউন্ডে শাহজালাল বলী ও আব্দুর নুর লড়াই করেন। ১ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের খেলায় পরাস্ত হন নুর। জিতেন শাহজালাল বলী। এরপর জীবন ও শাহজালাল বলী চূড়ান্ত পর্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন।

বিজ্ঞাপন

পরে চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল, রানার্স আপ জীবন এবং তৃতীয় স্থানে থাকা সৃজন চাকমার হাতে অতিথিরা ট্রফি তুলে দেন। এর আগে, বিকেলে বলীখেলার উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।

মেয়র বলেন, ‘বৃটিশ শাসনামল থেকে প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে আসছে জব্বারের বলিখেলা। বর্তমানে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ আর মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্রে যে সাংস্কৃতিক সংকট তা রুখতে এবং তা থেকে আমাদের ঐতিহ্য বাঁচাতে জব্বারের বলিখেলা আর বৈশাখী মেলার মতো সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে বাঁচাতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনার অভিঘাত পেরিয়ে এ বছর আমরা লালদীঘি ময়দানে বলী খেলার আয়োজন ফেরাতে পেরেছি। আমি যতদিন মেয়রের দায়িত্বে আছি এই বলী খেলার আয়োজনকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করে যাব। আমরা যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করতে কাজ করছি। মনে রাখতে হবে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ছাড়া স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল আসবে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল না, এ যুদ্ধ ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার যুদ্ধও। আজও এ যুদ্ধ চলমান। আর এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে।’

বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুবসমাজকে জাগাতে ১৯০৯ সালে শুরু হয় এই আব্দুল জব্বারের বলী খেলা। এবার ১১৪তম আসর অনুষ্ঠিত হলো। এবারের আসরে বিপুল জনসমাগম হয়েছে। কেউ এসেছে বাবার হাত ধরে, আবার কেউ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে।

বন্ধুদের সাথে বলীখেলা দেখতে আসা কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রাহুল দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বলী খেলা দেখতে আসতাম। মেলা থেকে অনেক কিছু কিনে নিয়ে যেতাম। গত বছর পরীক্ষা থাকায় আসতে পারিনি। আর কোভিডের কারণে আগের টানা দুই বছর মেলা ও বলী খেলা বন্ধ ছিল। এবার অনেক দিন থেকেই আশা নিয়ে বসেছিলাম। তাই বন্ধুদের নিয়ে বলী খেলা দেখতে চলে এলাম।’

বলীখেলা উপলক্ষে সোমবার থেকে শুরু হওয়া তিন দিনের বৈশাখী মেলা দ্বিতীয় দিনে আরও জমে উঠেছে। দিনভর ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর ছিল মেলা প্রাঙ্গণ। মেলা বুধবারও চলবে। সেইসঙ্গে এদিন চাটগাঁইয়া ঈদ উৎসবেরও আয়োজন করা হয়েছে।

ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন