বিজ্ঞাপন

মানবমুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা ফরাসি কথাসাহিত্যিক ও কবি ভিক্টর হুগো

May 22, 2023 | 11:34 am

সৈয়দ আমিরুজ্জামান

আর্থসামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ও মানবমুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা ফরাসি কথাসাহিত্যিক ও কবি ভিক্টর হুগো’র ১৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।

বিজ্ঞাপন

উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী রোমান্টিক লেখক তিনি। বহুমুখী ও বহুমাত্রিক এক বিশ্বজনীন প্রতিভা। একাধারে কিংবদন্তি সাহিত্যিক, প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মী। বিশ্ববিখ্যাত ‘লা মিজারেবল’ ও ‘হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম’ তারই সৃষ্টি।

পুরো নাম ভিক্টর মারি হুগো। ১৮০২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা। কবিতা, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের অনেক দিকেই ছিল তার বিচরণ। এগুলোর পাশাপাশি তিনি ৪ হাজারেরও বেশি চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবন
হুগোর শৈশব কেটেছে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে। জন্মের দুই বছর পর নেপোলিয়ন ফরাসিদের সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। যেহেতু তার বাবা নেপোলিয়নের শাসনকালে একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন, তাই পরিবার নিয়ে প্রায়ই তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতে পারতেন। হুগো এই ভ্রমণগুলো থেকে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেন ও অনেক কিছু শিখেছিলেন। এই অর্জনগুলো পরবর্তীতে তার সাহিত্যে তুলে ধরেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

শৈশবেই হুগোর বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মা সোফি প্যারিসে তিন সন্তান নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তবে হুগোর শিক্ষা ও আগ্রহকে সবসময় তিনি উৎসাহিত করেছিলেন। ফলস্বরূপ, শৈশবে রচিত তার বেশিরভাগ কবিতায় ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা যায়।

তরুণ ভিক্টর প্রেমে পড়েছিলেন শৈশবের বন্ধু অ্যাডেলে ফাউচারের। মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গোপনে ১৮২২ সালে তাকে বিয়ে করেন। ১৮২৩ সালে তাদের প্রথম সন্তান লেওপোল্ড মারা যায়। ঐ ছেলেটির বয়স বেশ কম ছিল। ১৮২৪ সালে এই দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান লিওপোল্ডাইন জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীতে ১৮৪৫ সালে ১৯ বছর বয়সে এই সন্তানটিও মারা যায়। সে সময় হুগো ও তার স্ত্রী দক্ষিণ ফ্রান্সে ভ্রমণরত ছিলেন। সেখানে একটি ক্যাফেতে সংবাদপত্র মারফত মেয়ে লিওপোল্ডাইনের মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারেন।

মেয়ের আকস্মিক মৃত্যু কবিকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। কন্যার জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে অনেক কবিতা লেখেন। এক গবেষক বলছেন, হুগো সেই বিষাদ সারাজীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা সম্ভবত ‘ডিমেন, ডেস ল’আউব’ (আগামীকাল, প্রথম প্রভাতে); এতে বর্ণিত হয়েছে তার মেয়ের কবর পরিদর্শন করার কথা।

বিজ্ঞাপন

সাহিত্যকর্ম
হুগোর সাহিত্য জীবনের সূচনা কবিতা দিয়ে। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮২২ সালে। প্রকাশের পরপরই এটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এরপর একে একে রচিত হয় ট্রাজেডি, অপেরা, অনুবাদ সহ নানান সৃষ্টি। সাহিত্যে ফ্রান্সের প্রচলিত ধারা ভেঙে নতুন ধারার সূচনা করেন হুগো। তাঁকে ফ্রান্সের রোমান্টিক কাব্য আন্দোলনের পথিকৃৎ বলা হয়ে থাকে। গীতি কবিতায় ছন্দের সুষম প্রয়োগ ঘটিয়ে তিনি ফরাসি কাব্য জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর রচনার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছিল মানুষের মুক্তি। ফ্রান্সের জনগণকে অন্ধকার আর গ্লানি থেকে মুক্তির আলোয় আলোকিত করে সমাজ রূপান্তরের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। এজন্যে হুগোকে সমাজ সংস্কারকও বলা হয়ে থাকে।

‘ওডেস এট পয়েসেস ডাইভারসেস’ নামে তার প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় ১৮২২। এ গ্রন্থের জন্য তিনি রাজা অষ্টাদশ লুইয়ের পক্ষ থেকে পুরস্কারও পান। ১৮২৩ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘দ্য হ্যান্ড আইল্যান্ড’। ১৮২৯ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যেই তার পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। লা অরিয়েন্টালিস, লা ফিউস ডি অটোমেন, লা চ্যান্টস ডি ক্রেপসিকিউল, লা ভক্স ইন্টিরিয়রস এবং লা রিয়ন্স এট লেস ওম্ব্রেস।

এদের মাঝে ‘লা অরিয়েন্টালিস’ ও ‘লা ভক্স ইন্টেরিয়রস’ তৎকালীন ইউরোপের কাব্যজগতে আলোড়ন তোলে। ১৮২৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘ওড টু ব্যালাডস’ কাব্যগ্রন্থ। ১৮২৯ সালে রচনা করেন উপন্যাস ‘দি লাস্ট ডে অব এ কন্ডেমড ম্যান’। ১৮৩০ সালে লেখেন সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম’। এরপর লেখেন বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’ (১৮৬২)।

অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে আছে ‘টয়লার্স অব দ্য সি’ ও ‘দ্য ম্যান হু লাফস’। এছাড়া রাই ব্লাস, হারমানি, ক্রমওয়েল ও নেপোলিয়ন লা পেতিতসহ আরও কিছু কাব্যগ্রন্থও আছে। সাহিত্য সমালোচনা নিয়ে লিখেছেন ‘ফিলোসফি অব লিটারেচার’। Notre-Dame de Paris (দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম) ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হবার পর দ্রুত ইউরোপের প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য ভাষায় বইটি অনূদিত হয়। এই উপন্যাস মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, হাজার হাজার পর্যটক ফ্রান্স শহর ঘুরতে আসে শুধু এই বই পড়ে।

বিজ্ঞাপন

তার প্রজন্মের অনেক তরুণ লেখকের মতো হুগোও উনিশ শতকের প্রথম দিকে রোমান্টিসিজম সাহিত্যের অগ্রপথিক ফ্রাঙ্কো-রেন দে চ্যাটুব্রায়েন্ড দ্বারা প্রভাবিত হন। হুগোর লেখালেখির প্রথম জীবনের ব্রত ছিল চ্যাটুব্রায়েন্ডের মতো লেখালেখির দক্ষতা অর্জন করা।

হুগো ক্রমওয়েল (১৮২৭) এবং হারনানি (১৮৩০) নাটক রচনার মধ্য দিয়ে রোম্যান্টিক সাহিত্য আন্দোলনের মূখ্য চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। ম্যারাওন ডেলর্ম (১৮৩১), দ্য কিং আমাসেস হিমেল (১৮৩২), এবং রুয়ো ব্লাস (১৮৩৮)-এর মতো পরবর্তী নাটকেগুলো রচনার মাধ্যমে হুগো জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস, লেস ট্রাভাইলের্স দে লা মের (সাগরের ট্রলার)। সেখানে হুগো সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি থেকে সরে একটি ভিন্নধর্মী গল্প উপহার দিয়েছিলেন। এটি পাঠকের কাছে ‘লা মিজারেবল’-এর চেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছিল।

তার বাংলা অনূদিত বইগুলোর মধ্যে ‘লা মিজারেবল’, ‘হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম’, ‘দ্য ম্যান হু লাফস’ ও ‘নাইন্টি থ্রি’ অন্যতম।

সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় ছিল তার অপূর্ব দক্ষতা। সঙ্গীত নিয়ে তার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখাও আছে। চিত্রকর ও চিত্র সমালোচক হিসেবেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী।

রাজনৈতিক জীবন এবং নির্বাসন
সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতেও জড়িত ছিলেন। ১৮৪৫ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লা মিজারেবল’ লেখার সময় ফ্রান্সের রাজা তাকে উচ্চকক্ষের সদস্যপদ দেন। আইনসভার সর্বোচ্চ দলের সঙ্গে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। তিনি সেখানে সবার জন্য বিনা খরচে লেখাপড়া, সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং মৃত্যুদণ্ডের বিলুপ্তির ব্যাপারে কাজ করেন।

১৮৪৮ সালে যখন রাজ্যে উন্নতির জোয়ার শুরু হয়েছিল, তিনি লা মিজারেবল লেখা বন্ধ করে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। পরে ১৮৫১ সালে ঘটনাক্রমে পরিস্থিতি বদলে যায়। হুগোর রাজনৈতিক চেতনার বিরোধিরা তাকে ব্রিটিশ চ্যানেলের একটি দ্বীপে নির্বাসিত করে। সেখান থেকে ১৮৬০ সালে তিনি আবার লা মিজারেবল লেখার কাজে হাত দেন। পরের বছরই উপন্যাসটি শেষ করেন। ফরাসি ভাষায় ‘লা মিজারেবল’ এর শব্দগত অর্থ দীন দুঃখীরা। এই উপন্যাসে লেখক উনিশ শতকের ফ্রান্সের সাম্রাজ্যতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের অধীনে সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষের এক সকরুণ জীবন চিত্র এঁকেছেন, যারা দুঃখ-দৈন্যের অভিশাপে বিকৃত। এ যেন কোনো উপন্যাস নয়; জীবনের জয়, পরাজয়, উত্থান-পতন, আশা-আকাঙ্খা সম্বলিত এক মহাকাব্য।

১৮৭০ সালে সম্রাটের পতন হলে হুগো ফ্রান্সে ফেরত আসেন, যেখানে তাকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে বিপুলভাবে সম্মানিত করা হয়।

ধর্মবিশ্বাস
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সময়ে সময়ে পরিবর্তন আসে হুগোর। শৈশবে তিনি ছিলেন ক্যাথলিক। বিভিন্ন লেখায় তিনি চার্চের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাও জ্ঞাপন করেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ক্যাথলিক বিরোধী এবং একপর্যায়ে ধর্মীয় মতবাদ বিরোধী হয়ে উঠেন। জানা যায়, নির্বাসনকালে তিনি প্রেতচর্চা তথা আত্মার আরাধনাও করেছিলেন। সারা জীবন ধর্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। ১৮৭২ সালে এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তিনি ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী কি না, উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “না। আমি মুক্তচিন্তার অধিকারী।”

জীবনকালের সমাপ্তি
১৮৭০ সালে যখন হুগো প্যারিসে ফিরে আসেন, তখন দেশ তাকে জাতীয়ভাবে অভিবাদন জানায়। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তাকে একনায়কতন্ত্র দেওয়া হবে। যেমনটি তিনি সেই সময় তার কিছু নোটে লিখে গিয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালের ৩ আগস্ট তিনি জনসাধারণের সামনে তার শেষ বক্তব্যে একটি আশাবাদী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, In the twentieth century war will be dead, the scaffold will be dead, hatred will be dead, frontier boundaries will be dead, dogmas will be dead; man will live.
“বিংশ শতাব্দীতে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে, ভাস্কর্য বিনষ্ট হবে, ঘৃণা অস্তিত্ব হারাবে, সীমান্তের সীমানা হারিয়ে যাবে, দেবতারা মারা যাবে; মানুষ বাঁচবে।”

১৮৭৮ সালের ১৮ জুন হুগো একটি মাইল্ড স্ট্রোক করেন। এই স্ট্রোক তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে ডাক্তার জানান, তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা একদমই কম। উনবিংশ শতকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে ফলাফল হিসেবে মৃত্যুকেই মেনে নিতো। তখনকার চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না।

১৮৮৫ সালের ২২ মে ভিক্টর হুগোর মৃত্যুর পর ফ্রান্সের রাস্তায় তার কফিন বয়ে নেবার সময় লাখ লাখ মানুষের ঢল নামে। সেদিন ফ্রান্সের জনগণ যথাযথভাবে সম্মান জানিয়ে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। তার মৃত্যুতে জাতীয় শোক পালন করা হয়।

ভিক্টর হুগো শুধুমাত্র সাহিত্যের বিশাল ব্যক্তিত্ব হিসেবেই সম্মানিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্র দ্বারা জনগণকে আকৃষ্ট করেছিলেন। সারাজীবন তিনি স্বাধীনতা, সমতা ও ফরাসি প্রগতিশীল সংস্কৃতির জন্য পরম আন্তরিকতায় সাধনা করে গেছেন।

মৃত্যুর দুই দিন আগে তিনি একটি নোট লিখেছিলেন, যেটির শেষ কয়টি শব্দ ছিল- “To love is to act”। এই ভালোবাসা দিয়েই তিনি তার সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করে গিয়েছেন আর জয় করেছেন হাজারো মানুষের মন।

পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই বিশ্বজনীন মহান এই গুণীর সাহিত্য, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন