October 29, 2023 | 7:35 am
সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: পাল্টাপাল্টি সমাবেশে দিনভর রাজধানী ঢাকা ছিল সরগরম। রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়াল রাজপথে। নয়াপল্টন-কাকরাইল এলাকা পরিণত হলো রণক্ষেত্রে। পুলিশসহ প্রাণ হারালেন দু’জন। রাজধানীবাসীকেও দিনভর পোহাতে হলো ব্যাপক ভোগান্তি। তবে সে ভোগান্তি যেন ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’।
ঢাকায় এক দিনে ১৩ সমাবেশের পরদিনই সারাদেশে হরতাল ডেকেছে বিএনপি। এর প্রতিবাদে সারাদেশে আবার শান্তি সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক এসব কর্মসূচি ফের উত্তেজনা ছড়াবে রাজনৈতিক অঙ্গনে— এমনটিই মনে করছেন সবাই। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থেকে সংঘাত-সংঘর্ষের শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হলে তা কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে।
গতকাল শনিবার (২৮ অক্টোবর) বিএনপির সমাবেশ ছিল নয়াপল্টনে দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দুপুর ২টায়। আগের দিন ঢাকা মহানগর পুলিশ ২০ শর্তে বিএনপিকে সেখানে সমাবেশের অনুমতি দেয়। তবে সমাবেশ সামনে রেখে শুক্রবার রাত থেকেই নয়াপল্টন লোকারণ্য হয়ে ওঠে। শনিবার সকাল থেকেই কাকরাইল থেকে শুরু করে পল্টন পর্যন্ত এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশের।
গতকাল শনিবার সকাল থেকেই কাকরাইল এলাকা ছিল বিএনপির নেতাকর্মীদের দখলে। সাড়ে ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি পিকআপ গুলিস্তানের যাওয়ার পথে কাকরাইল মোড়ে পৌঁছালে সেখানে অবস্থান নেওয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের কারণে সেটি আটকে যায়। সেখানে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
এরপর থেকে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে বিএনপির নেতাকর্মী ও পুলিশের মধ্যে। কাকরাইল মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের একটি বক্সে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। বেশকিছু গাড়ি ভাঙচুর করা হয়, আগুনও দেওয়া হয় কিছু গাড়িতে। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
এদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ দফায় দফায় টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দও পাওয়া যায়। সমাবেশের আশপাশে মোতায়েন করা হয় বিজিবি। বিকেল ৩টার দিকে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে থাকলে সমাবেশ পণ্ড হওয়ার উপক্রম হয়। এ সময় মঞ্চ থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আজ রোববার (২৯ অক্টোবর) সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন। পরে জামায়াতে ইসলামীও রোববার সারাদেশে হরতালের ডাক দেয়। আরও বেশ কিছু রাজনৈতিক দল বিএনপির হরতালে সমর্থন জানিয়েছে।
জাতীয় সংসদের প্রায় তিন মেয়াদ ধরে ক্ষমতার বাইরে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। দীর্ঘ দিন ধরে তারা আন্দোলন চালিয়ে এলেও গত কয়েক বছরে হরতাল কর্মসূচি তারা পালন করেনি বললেই চলে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে হরতাল পালন করেছিল বিএনপি। সে হিসাবে তিন বছর ৯ মাস বা প্রায় চার বছর পর হরতাল ঘোষণা করল দলটি।
অন্যদিকে বিএনপি সারাদেশে হরতাল পালন করেছে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ওই হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল। সে হিসাবে সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি তারা ঘোষণা করল প্রায় ছয় বছর পর। আর সরকার পতনের দাবিতে বিএনপি সবশেষ হরতাল পালন করেছেন ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল। সে হিসাবে সরকার পতনের দাবিতে বিএনপির এবারের হরতাল ডাকা হলো প্রায় ৯ বছর পর।
শনিবার বিএনপির সমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। বিএনপি হরতাল ডাকার পর ওই সমাবেশ থেকে রোববার সারাদেশে শান্তি সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নৈরাজ্যের হরতাল কেউ মানবে না। হরতাল হলো ভোঁতা অস্ত্র। এই অস্ত্র ভোঁতা গেছে। ওই ভোঁতা অস্ত্রে কাজ হবে না। আমরা আবারও শান্তির পথে। আগামীকাল (রোববার) মহানগর, থানা, জেলা, উপজেলাসহ সারা বাংলাদেশে শান্তি সমাবেশ হবে। আমরা শান্তির পক্ষে, সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে। আমরা রক্তপাতের বিরুদ্ধে শান্তি চাই।
বিএনপি আজ রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকলেও পরিবহন মালিক সমিতি জানিয়েছে, ঢাকাসহ সারাদেশে তারা পরিবহন চালু রাখবে। হরতাল ঘোষণার পর সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, অগণতান্ত্রিক হরতাল আমরা মানি না। দূরপাল্লার সব গাড়িসহ গণপরিবহন চলাচল করবে। কিছু ঘটলে মালিক-শ্রমিক মিলে প্রতিহত করা হবে।
২০১৩-১৪ সালে আন্দোলনের নামে বিএনপির নেতাকর্মীরা কয়েক শ গাড়ি পুড়িয়েছে ও ৯২ জন শ্রমিককে হত্যা করেছে অভিযোগ করে এনায়েত উল্যাহ বলেন, আজও অনেক গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। এর প্রতিবাদ করছি। আমরা বলে দিতে চাই, আপনারা গাড়িতে হাত দেবেন না, আগুন দেবেন না। এভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় না।
এদিকে হরতালের নামে কোনো ধরনের নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলা হলে কিংবা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান।
শনিবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। তেমনি হরতাল পালন না করাও জনগণের অধিকার। আগামীকাল (রোববার) একটি দল হরতাল ডেকেছে। হরতালের নামে মানুষের স্বাধীন চলাফেরায় ব্যাঘাত তৈরি করলে কিংবা জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সমাবেশের দিনটি শেষ পর্যন্ত সংঘাত-সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে। অন্তত দুজনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন অনেকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য বলছে, এদিন অর্ধ শতাধিক গাড়িতে আগুন দিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে বাস ছিল অন্তত ৯টি।
এ ছাড়া কাকরাইল-নয়াপল্টন এলাকায় পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়েছে শনিবার। হামলা করা হয়েছে প্রধান বিচারপতির বাসায়। আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় বেশকিছু দোকানপাটও ভাঙচুর করা হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে রোববারের হরতাল আর শান্তি সমাবেশের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থেকেও সংঘাত ছড়াবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। সংঘর্ষ এড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তারা বলছেন, রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে রাজনৈতিকভাবেই সংকটের সমাধান করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংস পথ যেমন সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তেমনি রাজনৈতিক সংকটকেও ঘনীভূত করবে।
সারাবাংলা/টিআর