বিজ্ঞাপন

‘সবাই মানবাধিকারে অগ্রগতির প্রশংসা করেছে, জোরালো সমালোচনা করেনি’

November 14, 2023 | 12:23 am

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সার্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা (ইউপিআর) প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদন পেশ করে। পরে ব্রিফিংয়ে আইনমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের প্রতিবেদনে উঠে আসা মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতিতে সভায় অংশ নেওয়া দেশগুলো প্রশংসা করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়ে দেশগুলো কথা বললেও বাংলাদেশের জোরালো সমালোচনা কোনো দেশই করেনি।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (১৩ নভেম্বর) সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায় চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। এ মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। আইনমন্ত্রী ব্রিফিংয়ে জেনেভা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। জেনেভা প্রান্তে তার সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং জেনেভায় জাতিসংঘ কার্যালয়ে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ সুফিউর রহমান।

ব্রিফিংয়ে লিখিত বক্তব্য শেষে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়ামসহ সব দেশই আমাদের (মানবাধিকার পরিস্থিতিতে) যে অগ্রগতি হয়েছে, তার প্রশংসা করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্র, যেমন— নির্বাচন প্রসঙ্গ এসেছে তাদের কথায়। তারা বলেছে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা। কিন্তু তারা জোরালোভাবে কোনো সমালোচনা করেনি।’

আরও পড়ুন- জাতিসংঘের সভায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পর্যালোচনা

বিজ্ঞাপন

মন্ত্রী বলেন, ‘উপস্থিত দেশগুলোর মধ্যে স্লোভাকিয়া কিছুটা সমালোচনা করেছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের কতটুকু সম্পর্ক আছে, সেটি আমি জানি না। তারা এবং কিছুটা কানাডা বলেছে (সমালোচনা করেছে)। এই দুটি দেশ ছাড়া অন্য দেশগুলো যারা সমালোচনা করেছে, তারাও খুব মৃদু সমালোচনা করেছে। এই দুটি দেশও যে খুব শক্ত করে বলেছে, তা নয়। তারা বলেছে, আমাদের এই ইউপিআর যেন সাকসেসফুল হয়। কিছু কিছু বিষয়ে আমরা যেন পদক্ষেপ নেই।’

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গও এসেছে জাতিসংঘের পর্যালোচনা সভায়। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত জোরালোভাবে বলেছি। যেটি বাস্তব ও সত্য, সেটিই আমি বলেছি। আমি এটিও বলেছি যে তাদের এই মিথ্যাকে পরিহার করে সত্যের দিকে যেতে হবে।’

জাতীয় নির্বাচন এবং গুম-হত্যা প্রসঙ্গগুলো নিয়েও বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে। আনিসুল হক বলেন, ‘গুম-হত্যা সম্পর্কে আমাদের যে অবস্থান, সেটি আমরা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি। সেটি উল্লেখ করার পর তারা কিন্তু আমাদের কোনো প্রশ্ন করেনি। এ ছাড়া কয়েকটি দেশ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করেছিল। যুক্তরাজ্য-বেলজিয়ামের মতো দেশগুলো বলেছে, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। সে ক্ষেত্রে আমি নির্বাচন নিয়ে আমাদের স্পষ্ট অবস্থান জানিয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

এর আগে ব্রিফিংয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ইউপিআর প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকা আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশের চুতুর্থ ইউপিআর। এর আগে ২০০৯, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের রিভিউ অনুষ্ঠিত হয়। এই ইউপিআর উপলক্ষে আগস্ট মাসে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিবেদন জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে পাঠানো হয়। আমার বক্তব্যে দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে মানবাধিকার সুরক্ষা ও প্রসারে বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছি।

ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ছবি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্বে সরকারের জনকল্যাণমূলক নীতির উল্লেখযোগ্য দিকগুলো মন্ত্রী পর্যালোচনা সভায় উপস্থাপন করেন। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে অবকাঠামো নির্মাণ এবং নিজস্ব অর্থায়নে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরেন।

আইনমন্ত্রী বলেন, গত রিভিউয়ের পর থেকে বাংলাদেশ মানবাধিকার সম্পর্কিত বেশকিছু আইন প্রণয়ন করেছে বলে সভাকে অবহিত করেছি। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতার পাশাপাশি কমিশনকে শক্তিশালী করতে সরকারের নেওয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে উপস্থিত সবাইকে অবহিত করেছি। নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইনি ব্যাখ্যা সভায় উপস্থাপন করেছি।

বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে জাতিসংঘের স্পেশাল প্রসিডিউর ম্যান্ডেটহোল্ডারদের ১০টি সফল আয়োজন করেছে উল্লেখ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ ও এর বিভিন্ন কৌশলের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চলমান সহযোগিতার কথা আইনমন্ত্রী বিশেষভাবে সভায় অবহিত করেন বলে উল্লেখ করেন।

বিজ্ঞাপন

মন্ত্রী বলেন, কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের রিভিউ উপলক্ষে প্রশ্ন করেছিল। এসব প্রশ্নের মধ্যে ছিল শ্রমিক অধিকার, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, মানবাধিকার সম্পর্কিত কিছু বিষয়ে আমাদের সম্ভাব্য র‌্যাটিফিকেশন (অনুসমর্থন), মানবাধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিভিন্ন স্পেশাল রিপ্যাট্রিয়েশন ও মেকানিজমে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার, বৃদ্ধ ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়। আমি যথাযথভাবে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছি। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সুশাসন, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও জবাদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাবে বলে আমি কাউন্সিলকে অবহিত করেছি।

আইনমন্ত্রী সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের ‍নেতৃত্ব দেন। ছবি: জাতিসংঘ

দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের লক্ষ্যের কথা সভায় তুলে ধরেন আনিসুল হক। বলেন, আমরা এমন একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যের কথা তুলে ধরেছি যেখানে প্রতিটি নাগরিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করবে। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে বলে তাদের আমি জানিয়েছি। আমাদের এবারের রিভিউয়ে ১১১টি দেশ অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ দেশ আমাদের মানবাধিকার বিষয়ে অগ্রগতিকে প্রশংসা করে গঠনমূলক সুপারিশ করেছে।

নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, খাদ্য নিরাপত্তা, সবার জন্য আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা সভায় বহুল প্রশংসিত হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী। বলেন, ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছে দেশগুলো।

মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগ এগিয়ে নিতে রিভিউয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো বেশ কিছু গঠনমূলক সুপারিশও করেছে। মন্ত্রী জানান, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যক্রম ও ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার, জাতীয় পর্যায়ে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ও বিভিন্ন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করা, প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দূর করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা জোরদারকরণ, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ, অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়ন, গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, বাল্য বিবাহ রোধ করতে জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ, মানব পাচার বন্ধে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা সম্পর্কিত সুপারিশগুলো বাংলাদেশের জন্য উঠে এসেছে সভায়।

মন্ত্রী বলেন, আমরা সুপারিশগুলো নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় অংশীজনদের সঙ্গে যথাযথ পরামর্শ করব এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার অবস্থান মানবাধিকার পরিষদকে জানাব বলেও উল্লেখ করেছি। পাশাপাশি এরই মধ্যে যেসব পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি, সেগুলোর কথাও বলেছি।

ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ইউপিআর একটি সুন্দর প্রক্রিয়া, যেখানে সব দেশ একই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে আসে। এর বাইরে এর কোনো অপব্যাখ্যা যেন না হয়, তা নিশ্চিত করে। এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।

সারাবাংলা/আইই/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন