বিজ্ঞাপন

আ.লীগে চুমকির প্রতিদ্বন্দ্বী আক্তারুজ্জামান, বিএনপিতে মিলন একাই

November 21, 2023 | 12:36 pm

মো. তাওহীদ কবির, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

গাজীপুর: একটি সমৃদ্ধ ও প্রাচীন জনপদের নাম গাজীপুর। এই জেলাটিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী বিখ্যাত ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠে এই গাজীপুরে। বাংলাদেশকে বিশ্বে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর যার নাম উচ্চারিত হয় তিনি হলেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমেদ। তিনি ছিলেন বিরল মেধা ও প্রজ্ঞার অধিকারী এবং প্রচণ্ড ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত ক্ষণজন্মা এক ব্যক্তিত্ব। তাজউদ্দীনের বাইরেও সুস্থ রাজনীতির বাহক, দেশ উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় যাদের নাম উচ্চারিত হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- প্রয়াত শামসুল হক, শহিদ আরজ উদ্দিন, শহিদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন, গাজী গোলাম মোস্তফা, প্রয়াত হাবিবুল্লাহ, শহিদ হুরমত আলী, শহিদ আহসান উল্লাহ মাস্টার, মো. রহমত আলী ও আ ক ম মোজাম্মেল হক।

বিজ্ঞাপন

পোশাক শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই গাজীপুরকে এক কথায় বলা চলে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এই জেলার পাঁচটি আসনই বর্তমানে আওয়ামী লীগের দখলে। রাজনীতির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই গাজীপুরের রাজনীতি আবর্তিত হয় স্থানীয় জনগণ ও পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে। এই জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার পোশাক কারখানা রয়েছে। ফলে এখানে স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। যে কারণে এই জেলার আসনগুলোতে ভোটার অন্যান্য আসনের চেয়ে বেশি।

আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে গাজীপুরের আসনগুলোতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বড় দল এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় এই জেলার কয়েকটি আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপির প্রার্থীর সংখ্যাও কম নয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকেই মাঠে নেমেছেন। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কেন্দ্রেও যোগাযোগের চেষ্টা করছেন তারা। তবে দুই দলেই মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক জায়গায় অভ্যন্তরীণ বিরোধের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ও ভোটারের জেলা গাজীপুরের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা। এবারও জাতীয় পার্টি মহাজোটে থেকে নির্বাচন করছে। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে গাজীপুর-৫ আসনের চিত্র।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন:

আ.লীগে সহজেই পার পাচ্ছেন না সবুজ, বিএনপিতে একাধিক প্রার্থী

গাজীপুর-৫ আসনটি কালীগঞ্জ উপজেলা, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪০, ৪১ ও ৪২ নম্বর ওয়ার্ড এবং গাজীপুর সদরের বাড়িয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহিদ ময়েজ উদ্দিন আহমেদের জন্মস্থান এটি। এই আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবেই পরিচিত। গাজীপুরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই শক্তিশালী। তবে এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগের এ ঘাঁটি ধরে রাখতে বেশ বেগ পেতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ জিতেছে সর্বোচ্চ ছয় বার, বিএনপি তিন বার এবং জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র একবার করে।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ ময়েজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি ১৯৮৪ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজ সংসদীয় এলাকায় স্বৈরাচারদের হাতে নিহত হন। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোখলেছুর রহমান জিতু মিয়া। পরবর্তী সময়ে তিনি বিএনপি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন। চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন হাছিউদ্দিন দেওয়ান। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন প্রয়াত ডা. আসফার হোসেন মোল্লা। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান। গত ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ময়েজ উদ্দিনকন্যা মেহের আফরোজ চুমকি।

বর্তমান সংসদ সদস্য চুমকি এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আরও রয়েছেন- গাজীপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ডাকসুর সাবেক ভিপি আক্তারুজ্জামান, কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম নজরুল ইসলাম ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আশরাফি মেহেদী হাসান।

এদিকে, নির্বাচনে বিএনপির একজন প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। তিনি হলেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা কমিটির সভাপতি একেএম ফজলুল হক মিলন । দল থেকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচনে ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারবেন বলে মনে করছেন নেতা-কর্মীরা।

তবে এই আসনে সাংগঠনিকভাবে জাপার তেমন কোনো তৎপরতা নেই। তবে দলটি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যাও কম নয়। এই আসন থেকে মনোনয়ন চান- উপজেলা জাতীয় পার্টির জাতীয় পার্টির রাহেলা পারভিন শিশির, আরিফুর রহমান খান, মনজুরুল হক ও মিনহাজ আবেদিন বিশাল। এই আসনে নির্বাচনের জন্য মাঠে রয়েছে জাকের পার্টির প্রার্থী। জাকের পার্টি ছাত্রফ্রন্টের ঢাকা বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী মনোনয়ন পাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

মনোনয়ন প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ সংগঠন। এখানে (গাজীপুর-৫) অনেকেই প্রার্থী হতে পারে, অনেকেরই যোগ্যতা থাকতে পারে। তবে যোগ্যতার বিচার যদি করা হয়, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আমি আছি, জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমি এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছি। জননেত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন করেছে ঠিক তারই ধারা অব্যাহত রেখে আমি আমার গাজীপুর-৫ আসনে উন্নয়ন করে চলেছি। এখন কালীগঞ্জকে মানুষ আধুনিক কালীগঞ্জ বলে। আমি নারী ক্ষমতায়ন, নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমি কাজ করেছি। আমার বিশ্বাস, সব বিবেচনা করে জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। তিনি পুনরায় আমাকে নৌকা মার্কা দেবেন।’

গাজীপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহ-সভাপতি মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘মিলন ভাইয়ের বিকল্প আমরা চিন্তা করতে পারিনা। কারণ তিনি বিগত দিনে সংসদ সদস্য ছিলেন, কাজও করেছেন অনেক। সাধারণ মানুষ পরিবর্তন চায়। তারা পুনরায় মিলন ভাই তাদের পাশে থেকে উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করুক এটা চায়।’

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য বর্তমান সরকারের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে বিজয়ী করবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এই আসনে মিলন ভাই অনেক অবদান রেখেছেন। আমরা আশা করি, যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং মিলন ভাই মনোনয়ন পায় তাহলে এই আসনের চিত্র বদলে যাবে।’

নির্বাচন নিয়ে জাকের পার্টির এম হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে গাজীপুর-৫ আসনে আমার দল জাকের পার্টি আমাকে মনোনয়ন দেবে- এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। কারণ, আমি প্রায় ২৫ বছর ধরে জাকের পার্টি ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ নতুন কিছু দেখতে চায়। আমাকে একবার সুযোগ দিলে গাজীপুর-৫ আসনের রূপ বদলে দেবো।’

তবে সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ময়েজ উদ্দিন আহমেদের কন্যা বর্তমান সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি। নিয়মিত এলাকার মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে সরব থাকায় এখন পর্যন্ত অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন তিনি। মেহের আফরোজ চুমকি নির্বাচনি এলাকার ব্যাপক উন্নয়নও করছেন বলে দাবি দলীয় নেতাকর্মীদের।

উল্লেখ্য, এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২ হাজার ৪৭৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪২০ জন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৯৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মেহের আফরোজ চুমকি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির এ কে এম ফজলুল হক মিলন। তিনি পান ৭৫ হাজার ১১৮ ভোট। এর পর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান চুমকি। ওইবার তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান চুমকি। ওই নির্বাচনে তিনি ২ লাখ ৭ হাজার ৬৯৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এ কে এম ফজলুল হক মিলন পান ২৭ হাজার ৯৭৬ ভোট।

সারাবাংলা/টিকে/পিটিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন