বিজ্ঞাপন

অডিও বুক— বাড়ছে গ্রাহক, ঢুকছে বিকল্প থেকে মূলস্রোতে

February 14, 2024 | 11:00 pm

আহমেদ জামান শিমুল, এন্টারটেইনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: কর্মব্যস্ত রাজধানীতে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় চলে যায় বেসরকারি চাকরিজীবী আসিফ আহমেদের। একসময় অফিসের বাসে করে অফিসে যাওয়ার পথে বই পড়তেন। চোখের সমস্যার কারণে যাত্রাপথে বই পড়াও বাদ দিতে হয়েছে। কিন্তু এখনো নিজের আগ্রহের বিষয়ের ওপর নতুন বই দেখলেই পড়ার ইচ্ছাটা কমেনি। তবে সে ইচ্ছা আর পূরণ করার সুযোগ পান না। রাতে অফিস থেকে ফিরে সারাদিনের অফিসের সঙ্গে যানজটের ক্লান্তিতে আর বইয়ে মনোযোগ দিতে পারেন না।

বিজ্ঞাপন

আসিফ আহমেদের মতো বইপ্রেমী হয়েও বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না যারা, তাদের জন্যই একটি সমাধান এনে দিয়েছে প্রযুক্তি। তাদের আর বই পড়তে হচ্ছে না, বরং বই পড়ে তাদের শোনানোর ব্যবস্থা করেছে অডিও বুক। হ্যাঁ, জনপ্রিয় লেখকদের জনপ্রিয় সব বই এখন তৈরি হচ্ছে অডিও বুক ফরম্যাটে। তাতে যারা বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, তারা শুনে নিতে পারছেন অডিও বুকের মাধ্যমে। কাজ করতে করতে, কাজের ফাঁকে কিংবা যাত্রাপথেই হোক না কেন, স্মার্টফোনে অডিও বুকের অ্যাপ চালিয়ে বই শুনে নেওয়া যাচ্ছে নির্বিঘ্নেই।

অডিও বুক ধারণাটি নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ফরম্যাটে অডিও বুক তৈরি ও প্রচলনের চেষ্টা চলে আসছে। বাংলাদেশেও বিচ্ছিন্নভবে অনেকেই অডিও বুক নিয়ে কাজ করেছেন। ধীরে ধীরে এখন অডিও বুকও চলে আসছে বইয়ের মূলস্রোতে। বইয়ের ‘হার্ডকোর’ পাঠক যারা, তাদের মধ্যেও যারা ব্যস্ততা বা নানা কারণে বই পড়ার সময় বের করতে পারেন না, তারাও এখন নির্ভর করতে শুরু করেছেন অডিও বুকের ওপর।

অডিও বুকের সুবিধা রয়েছে আরও। নিরক্ষর কেউও এখন অডিও বুকের মাধ্যমে কোনো বই পড়ার স্বাদটি নিতে পারবেন। আবার দৃষ্টিশক্তিহীন যারা, তারাও অডিও বুকের মাধ্যমেই শুনে নিতে পারবেন বই।

বিজ্ঞাপন

বাংলা একাডেমির আয়োজনে চলমান যে অমর একুশে বইমেলা, সেখানেও এবার জায়গা করে নিয়েছে অডিও বুক। শুনবই, বইঘর, কাব্যিক অডিও বুক ও রকমারি ই-বুক এই মেলার স্টলে বিক্রি করছে ই-বুকও। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব অ্যাপ, যেখানে টাকা দিয়ে কিনে নিলে সেই বই পড়ে শোনার সুযোগ পাবেন গ্রাহক।

বইমেলা উপলক্ষে অডিও বুক প্রতিষ্ঠানগুলো সাবস্ক্রিপশনে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। ছবি: সারাবাংলা

প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কর্মব্যস্ততা কমেছে। বেড়েছে বিভিন্ন ডিভাইসনির্ভারতা। মোবাইল, কম্পিউডার, ট্যাব বা ল্যাপটপে দিনের বড় একটি সময় কাটাতে হয় তরুণ থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষকেই। অডিও বুক নির্মাতারা বলছেন, বইপ্রেমী যারা বই হাতে নেওয়ার সুযোগ কম পাচ্ছেন এবং প্রযুক্তির সঙ্গে সময় বেশি কাটাতে হচ্ছে, তাদের জন্য বই শোনার সুযোগ দিতেই চেষ্টা করছেন তারা।

শুনবইয়ের স্টলে কথা হলো কর্মীদের সঙ্গে। জানালেন, তাদের যাত্রা শুরু ২০২১ সালে। তাদের ভাণ্ডারে রয়েছে এক হাজারেরও বেশি অডিও বুক। অ্যাপ ডাউনলোড হয়েছে লক্ষাধিকবার। পেইড সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। বইমেলা উপলক্ষে মাত্র ১০ টাকায় এক মাসের সাবক্রিপশন দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিজ্ঞাপন

২০২২ সালে যাত্রা শুরু করা কাব্যিকে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার অডিও বুক। তাদের অ্যাপটিও ডাউনলোড হয়েছে লক্ষাধিকবার। তবে পেইড সাবস্ক্রাইবার কিছুটা কম— সাত হাজার। তাদের নিয়মিত মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি ৭০ টাকা। তবে বইমেলা উপলক্ষে মাত্র ২১ টাকায় সাবস্ক্রিপশন দিচ্ছে তারা।

সাত হাজার ই-বুকের বিশাল ভাণ্ডার নিয়ে বইমেলায় স্টল দিয়েছে রকমারি ই-বুক। বইঘরও কাজ করছে অডিও বুক নিয়ে। তাদের সংগ্রহে অডিও বুকের সংখ্যা আড়াই হাজার।

শুনবই বাদ দিয়েল বাকি সবগুলো প্রতিষ্ঠানই নতুন প্রজন্মের লেখকদের বই নিয়ে বেশি অডিও বই করছে। সাদাত হোসাইন, নাজিম উদ দৌলা মৌরি মরিয়ম, শানজানা আলমের মতো লেখকরা রয়েছেন এই তালিকায়। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের মধ্যে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হক এবং প্রয়াত ও কালজয়ী লেখকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ের অডিও বুক করেছে অনেকেই। প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, তারা অডিও বুকের পাশাপাশি নানা বিষয়ে পডকাস্ট শোও শুরু করতে যাচ্ছে।

অডিও বুক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোই বলছে, ধীরে ধীরে বাড়ছে অডিও বুকের চাহিদা। ছবি: সারাবাংলা

রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠগুলো শ্রোতাকে আকৃষ্ট না করলে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহক হারাবে। এ ক্ষেত্রে তারা কী করছে— এমন প্রশ্নে কাব্যিক অডিও বুকের কর্মকর্তা মো. আরাফাত ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শুধু সাধারণভাবে বই পাঠ রেকর্ড করে পাঠকদের দিই না। চেষ্টা করি শৈল্পিকভাবে বইটি তাদের কাছে উপস্থাপন করতে। সবগুলো চরিত্রের জন্য আলাদা অডিও রেকর্ডিং করার চেষ্টা করা হয়। অনেকটা বাংলাদেশ বেতারের শ্রুতিনাটকের মতো করে। তবে সব বইয়ের ক্ষেত্রে তা করা সম্ভব হয় না।’

বিজ্ঞাপন

আরফাত বলেন, ‘ঢাকা-কলকাতার ভয়েস আর্টিস্টরা আমাদের এখানে কাজ করছেন। ফলে আমাদের অডিও বুক যখন শ্রোতা শুনবেন, তারা বই পাঠের প্রায় কাছাকাছি অনুভূতিই পাবেন।’

সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’সহ অনেক বিখ্যাত লেখকের বড় বড় আয়তনের বইও রয়েছে অডিও বুকে। একেকটি অডিও বুকের দৈর্ঘ্য ৪০-৫০ ঘণ্টাও রয়েছে। শ্রোতাদের পক্ষে একটানা এত দীর্ঘ অডিও শোনা সম্ভব নয় স্বাভাবিকভাবেই। এ ক্ষেত্রে অডিওগুলো থেমে থেমে শোনার অপশনও রয়েছে অ্যাপে।

অডিও বুক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, অডিও বুকের প্রধান সুবিধা হলো— এতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। চাইলে মোবাইলটি পকেটে রেখেও হেডফোনে অডিও বুক শোনা যায়। ফলে অডিও বুক থেকে চোখের ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। পাশাপশি অডিওর গতি কমানো-বাড়ানোর সুবিধা রয়েছে। নির্দিষ্ট একটি সময় পর অডিও প্লে যেন বন্ধ হয়ে যায়, রয়েছে সেই নির্দেশ আগে থেকেই দিয়ে রাখার ব্যবস্থাও।

ছাপা বইয়ের রয়্যালটি নিয়েই লেখকদের সঙ্গে প্রকাশকদের বড় ধরনের দূরত্ব রয়েছে, যে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। তবে অডিও বুকের নির্মাতারা বলছেন, তারা সঠিকভাবে লেখকদের রয়্যালটি দিয়ে থাকে। শুনবইয়ের কর্মকর্তা ফেরদৌসী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুরো বিষয়টি ডিজিটালাইজড হওয়ায় রয়্যালিটি নিয়ে ফাঁকিবাজি করা সুযোগ থাকে না। তাই আমরা লেখকদেরকে তাদের সঠিক প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দিতে পারছি।’

অডিও বুকের সংগ্রহও দিন দিন বাড়ছে অ্যাপগুলোতে। ছবি: সারাবাংলা

বই প্রকাশের ক্ষেত্রে যেমন প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে লেখকের চুক্তি হয়, অডিও বুকের জন্যও একইরকমভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে বলে জানাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কাব্যিকের মো. আরাফাত ইসলাম বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্ট্রিমিং হলেই লেখককে রয়্যালটি দিচ্ছি আমরা। সবকিছু চুক্তিতে উল্লেখ থাকছে। লেখকরা বেশ ভালো অঙ্কের টাকা পাচ্ছেন।’

বই থেকেই সবার আগ্রহ কমে যাচ্ছে— খুব প্রচলিত অভিযোগ এটি। অডিও বুকের কী অবস্থা? এমন প্রশ্নের জবাবে বইঘরের বিক্রয়কর্মী জান্নাত বলেন, ‘পাঠকরা আকৃষ্ট হচ্ছে অডিও বুকের দিকে। কারণ মানুষের এখন স্ক্রিনটাইম বেড়ে গেছে। রান্না করতে বা জিম করতে করতে একটি অডিও শুনে ফেলা সম্ভব। মানুষ যে আগ্রহী হচ্ছে তার প্রমাণ প্রতিনিয়তই আমাদের পেইড সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বাড়ছে।’

বইমেলা ঘুরে দেখা গেল, ক্রেতা-দর্শনার্থীরা অন্যান্য বইয়ের স্টলগুলোর মতো অডিও বুকের এই স্টলগুলোতেও আগ্রহ নিয়ে ঢুকছেন। কেউ স্টলের ডিভাইস থেকে অডিও বুক শুনে দেখছেন। কেউ কেউ নিজের মোবাইলেই অডিও বুকের অ্যাপ ইনস্টল করে নিচ্ছিলেন।

দর্শনার্থী মোস্তফা কামাল বলেন, সময়ের অভাবে বই কিনে পড়া হয় না। আবার বইয়ের যে দাম, তাতে আমাদের মতো মানুষের পক্ষে কিনে পড়াও সম্ভব হয় না। আগে এলাকাগুলোতে লাইব্রেরি ছিল। সেখানে গিয়ে বই পড়তাম। এখন তাও নেই। অডিও বুকের কথা আগে শুনেছি, কখনো সেভাবে দেখা হয়নি। এবার মেলায় এসে দেখলাম। দেখে ভালো লাগলো। অল্প টাকা দিয়েই পুরো একটা বইয়ের গল্প বা কবিতা শুনে ফেলতে পারব, বিষয়টি ভালোই লেগেছে।’

আব্দুল হাসীব নামে আরেক দর্শনার্থী সারাবাংলাকে, ইউটিউবে অনেক অডিও বুক পাওয়া যায়। যানজটে বসে থাকতে থাকতে ইউটিউব থেকে অডিও বুক শোনা হয় প্রায় নিয়মিতই। প্রকাশনীগুলো এরকম পেশাদারিত্বের সঙ্গে অডিও বুক করলে আমার মতো পাঠক-শ্রোতাদের জন্য সুবিধাই হয়।

সারাবাংলা/এজেডএস/টিআর

Tags: , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন