বিজ্ঞাপন

ভোটের ফল পূর্বনির্ধারিত ছিল— জিএম কাদেরের বক্তব্যে সংসদে হট্টগোল

March 5, 2024 | 10:57 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের বলেছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কোথাও কোথাও ভোট যেমনই হোক, ফলাফল ছিল পূর্বনির্ধারিত। শুধু একটি শিট বানিয়ে সেই ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (৫ মার্চ) জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণ দিতে গিয়ে জি এম কাদের এ কথা বলেন। এ সময় অধিবেশনে তুমুল হইচই ও হট্টগোল দেখা দেয়। অধিবেশনে কিছুক্ষণের জন্য অচলবস্থা তৈরি হয়। সরকারি দলের সদস্যরা তীব্রভাবে তার এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে থাকলে জিএম কাদের একপর্যায়ে হেসে বলেন, ‘এটা নাও হতে পারে।’

মঙ্গলবার সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জিএম কাদেরের নির্বাচনসংক্রান্ত এ বক্তব্যে তুমুল হট্টগোল দেখা দেয়। সরকারি দলের সদস্যরা মাইক ছাড়াই নানা মন্তব্য করতে থাকেন। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরাও পালটা মন্তব্য করতে থাকেন।

এ পরিস্থিতি সংসদ অধিবেশনে অচলাবস্থা তৈরি হলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদ সদস্যদের শান্ত হওয়ার জন্য একাধিকবার আহ্বান জানান। পরে জিএম কাদের তার বক্তব্য শেষ করেন।

বিজ্ঞাপন

এ সময় জিএম কাদের বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে, তিন ধরনের নির্বাচন হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় সবগুলো কেন্দ্রে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। এসব এলাকায় কোনো ডিস্টার্বেন্স হয়নি। কোনো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার কারণে এসব এলাকায় প্রতিযোগিতাহীন ভোট হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও এসব এলাকায় সরকারের সদিচ্ছায় ভোট শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে।

বাকি দুই ধরনের নির্বাচনের কথা তুলে ধরে জিএম কাদের বলেন, আরেক ধরনের ভোট হয়েছে ‘ফ্রি স্টাইলে’। সেখানে মাসল পাওয়ার (পেশী শক্তি) ও অর্থ অবাধে ব্যবহার করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্র দখল করা হয়েছে। বেশির ভাগ সময় এখানে সরকারি দলের প্রার্থীরা বিদ্রোহী প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী বা আমাদের প্রার্থীদের বাধা দিয়েছে। আরেক ধরনের ভোট ছিল। সেখানে ভোট যেমনই হোক, ফলাফল ছিল পূর্বনির্ধারিত। শুধু একটি শিট বানিয়ে ফলাফল দেখানো হয়েছে।

বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, সব দল নির্বাচনে এলে এবং বাধা ছাড়াই ভোট হলে ১৫ শতাংশ ভোট গ্রহণযোগ্য। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বড় দল নির্বাচনে অংশ নিলে এই মুহূর্তে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়বে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একটি দল না এলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা কঠিন। এতে মানুষ ভোটি দিতে আসে না। যে প্রেক্ষাপটে ছিল, তাতে ৪২ শতাংশ ভোট হতে গেলে সব ভোটকেন্দ্রের সামনে আট ঘণ্টা লাইন থাকার কথা। কিন্তু তা ছিল না।

বিজ্ঞাপন

জি এম কাদেরের বক্তব্যের এ পর্যায়ে সংসদ সদস্যরা হইচই শুরু করেন। জিএম কাদের আরও বলেন, অনেকে বলেছেন ঘণ্টায় তিন-চারটার বেশি ভোট হয়নি। আমি আমার কথা বলছি না। ধারণার কথা বলছি।

সংসদ সদস্যরা হইচই করতে থাকলে। বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে বলতে শোনা যায়, ‘শুনেন না! ধৈর্য ধরেন। যদি ৪২ শতাংশ দেখানো হয়, বাকি ব্যালটগুলো কীভাবে আসলো? কার পক্ষে আসলো?’

তিনি আরও বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী বৈধ হিসেবে গণ্য করা যায়। আইন অনুযায়ী তা বৈধ হয়েছে। কেউ বেআইনি ঘোষণা করেনি। কিন্তু সিংহভাগ মানুষ মনে করে, ভালো নির্বাচন হয়নি। ভোটে সঠিকভাবে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে করে না। আমি মনে করি, আইন-কানুন ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। যাদের দেখার কথা, তারা এড়িয়ে গেছেন, অনেক সময় লঙ্ঘনে সহায়তা করেছেন।

জাপা চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন, নির্বাচনে জয় হয়েছে জনগণের, গণতন্ত্রের। আমার জানামতে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ এ কথার সঙ্গে একমত নয়। এই নির্বাচনে শুধু জয়ী হয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ছাড়া জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে, এমন অন্য সব দল নিজস্ব নীতি-আদর্শ নিয়ে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এখন স্বাভাবিক রাজনীতি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে আমার আশঙ্কা।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রপতির ভাষণের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখে জিএম কাদের বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন, নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পেরেছে। এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেই একমত নয়। বিরোধীদের মামলা দিয়ে জেলে বন্দি করা হয়েছে, হুলিয়া দিয়ে ঘর ছাড়া করা হয়েছে। রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। ধানক্ষেতে, বনে-জঙ্গলে তাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তাদের পক্ষে এমন পরিবেশ ছিল না যে স্বাধীনভাবে কর্মসূচি পালন করতে পারবেন।

রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে দুর্নীতির প্রসঙ্গ আসেনি উল্লেখ করে জিএম কাদের বলেন, দুর্নীতিতে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে। এটা বেশ কিছুদিন ধরে চলছে। দুর্নীতি ছাড়া কোনো কাজ হয় না। এটি প্রত্যেক সমাজের অভিশাপ। দুর্নীতির কারণে ভোগান্তি বাড়তে থাকে। এটি সমাজের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। সরকার সাধারণত দুর্নীতি স্বীকার করে না।

এ সময় স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেন জিএম কাদের। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) দুর্নীতি সূচকের কথা তুলে ধরে বলেন, ২০০১ সাল থেকে পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ, যার শুরুতেই ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ১৩তম স্থানে ছিল। এখন আমরা ১০ম স্থানে আছি। মানে দুর্নীতি অবস্থান এখন নিচের দিকে নেমে গেছে। এটা হলো টিআইবির রিপোর্ট।

এসময় সরকারদলীয় ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা টিআইবির প্রতিবেদনকে ‘ভুয়া প্রতিবেদন’ বলে দাবি করেন। জিএম কাদের বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির ভাষণে দুর্নীতির বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আমরা দেখিনি।’ এ সময় পাশ থেকে এক সংসদ সদস্য বলেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি।’ তখন জিএম কাদেরও বলেন, ‘অবশ্যই মহামান্য রাষ্ট্রপতি।’

বক্তব্যে খেলাপি ঋণ নিয়েও কথা বলেন জি এম কাদের। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফের খেলাপি ঋণের তথ্যের পার্থক্য নিয়ে কথা বলেন। টিআইবির মতো কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করলে সেখানে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দুটি দেশের একটি হতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জিএম কাদের বলেন, আইএমএফ ও আমাদের হিসাবে পার্থক্য হচ্ছে কেন? ব্যাংকের অদ্ভুত ব্যাপার, তারা চাতুরি করে, নিজেদের খেলাপি ঋণ আদায় না করে কার্পেটের তলে ঢুকিয়ে রেখেছে। জনগণের পয়সা। তাদের নিজেদের পয়সা না। আমাদের পয়সা নিচ্ছে। যাকে তাকে দিচ্ছে। তারপর এ পয়সাগুলো দেখাচ্ছে তাদের কাছে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটাকে উৎসাহ দিচ্ছে অভিযোগ উঠেছে বলেও দাবি করেন তিনি।

দ্রব্যমূল্য নিয়ে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি আমদানি করছে। এতে সিন্ডিকেট হওয়াটা স্বাভাবিক। এসব ব্যবসায়ী সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবো যুক্ত। সরকারের কাছে বিকল্প না থাকার কারণে সরকার তাদের হাতে জিম্মি বলেও মনে করেন তিনি।

সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড বিচারহীনতার উদাহরণ উল্লেখ করে বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য তদন্তকাজকে বিলম্বিত করতে উৎসাহিত করতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন