বিজ্ঞাপন

তীব্র গরমে ঝরেছে আমের ৬০% গুটি, উৎপাদন আশঙ্কায় চাষিরা

April 22, 2024 | 10:57 pm

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাজশাহী: রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় সব গাছে এবার মুকুল এসেছিল অনেক দেরিতে। এখন আমও কম দেখা যাচ্ছে। আবার সেই গুটির অধিকাংশ ঝড়ে পড়ছে তীব্র গরমে। ফলে হতাশ আমচাষিরা। তারা বলছে, এবার ফাল্গুনের অনেক পরে আমের মুকুল দেখা গেছে। আবার বৈশাখের শুরুতে গুটি দেখা গেলেও এখন তা ঝড়ে পরছে তীব্র গরমে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন পোকার উপদ্রব তো আছেই। এখন গাছে যা আম আছে তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।

বিজ্ঞাপন

আমচাষিরা বলেছেন, আম রক্ষায় অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ ছিটাতে হচ্ছে। পোকার আক্রমণের এবার আমের উৎপাদন কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর- এই চার জেলায় ৯৩ হাজার ২৬৬ হেক্টর জমিতে আম বাগান আছে। চলতি বছর এইসব জমি থেকে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর এই অঞ্চলে আম উৎপাদন হয়েছিল ১২ লাখ ৭ হাজার ২৬৩ টন। এবার উৎপাদনে ভাটা পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

গরমে বেশিরভাগ গুটি ঝরে গেছে, তারপরও যা আছে সেখানে আবার পোকার আক্রমণ। ছবি: সারাবাংলা।

গরমে বেশিরভাগ গুটি ঝরে গেছে, তারপরও যা আছে সেখানে আবার পোকার আক্রমণ। ছবি: সারাবাংলা।

কৃষি বিভাগের হিসাবে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। এইসব বাগান থেকে চলতি মৌসুমে ৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। আম উৎপাদনকারী আরেক জেলা নওগাঁয় বাগান রয়েছে ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। এখানে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর রাজশাহীর ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমির আমবাগান থেকে এবার ২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে বলে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা আশা করছেন। হিসাব মতে, ৮৫ শতাংশ গাছে আমের মুকুল এসেছে। এখন আমও আছে। কিন্তু কৃষকরা বলছেন আম ঝরে পড়ছে।

বিজ্ঞাপন

রাজশাহী জেলার বেশির ভাগ আম বাগান চারঘাট ও বাঘা উপজেলায়। বাঘা উপজেলার সাদি এন্টারপ্রাইজ কয়েক বছর ধরে বিদেশে আম রফতানি করছে। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আসাফুদ্দৌলা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার বেশির ভাগ গাছে কোনো আম নেই। চাষিরা গাছের কোনো পরিচর্যা করছেন না। ফলে যেসব গাছে কিছু আম আছে পোকামাকড় সেখানেই হামলা করছে। কীটনাশক ছিটানোর এক সপ্তাহের মধ্যেই অন্য বাগান থেকে এসে আক্রমণ করছে। উপর্যুপরি এই আক্রমণে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘এখন বাগানে মাছি পোকা, লেদা পোকানাশক বিষ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।’

এবার ভালো আম ধরেছে বাঘা উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের আমচাষি আনোয়ার হোসেনের বাগানে। তিনটি ড্রাম থেকে মেশিনের মাধ্যমে তিনি তার আমগাছে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কীটনাশক ছিটানোর জন্য তিনি বিশেষ আয়োজন করেছেন। এভাবে কেন কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে? জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘হপার পোকা আমার আমের অনেক ক্ষতি করেছে। এখন নতুনভাবে আম ছিদ্রকারী পোকা উড়ে এসে হুল ফুটিয়ে চলে যাচ্ছে। সেজন্য এভাবে কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওষুধের গুণগত মান কমে গেছে। অল্প মাত্রায় কাজ হচ্ছে না। আবার দামও বেড়ে গেছে ৩০ শতাংশ। সব গ্রুপের ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। শ্রমিকের দাম বেড়েছে। চাষিরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেজন্য অনেকেই আমগাছ কেটে অন্য আবাদে যাচ্ছেন। যাদের কম জমি, তারা শেষ হয়ে যাবেন।’

বিজ্ঞাপন

রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও শাহ কৃষি পাঠাগার ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর শাহর আমবাগান রয়েছে রাজশাহীর পাশের জেলা নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে। সারাবাংলাকে তিনি জানান, অনুমোদিত মাত্রার বাইরে তিনি ওষুধ ব্যবহার করেননি। শ্রমিকরা আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, শুধু অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ দিয়ে পোকার আক্রমণ থেকে আম বাঁচানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। তার বাগানের সব আম পোকায় শেষ করে দিয়েছে।

বাঘা উপজেলার আরেক আম চাষী শফিকুল ইসলাম সানা। গত বছর প্রায় এক কোটি টাকার আম বিক্রি করেছিলেন। তার মধ্যে ২৬ মেট্রিক টন আম বিদেশেও রফতানি করেছিলেন। এবারও শফিকুল ৩০০ বিঘা জমিতে আম চাষ করছেন। তবে গাছে গুটি কম থাকায় হতাশ তিনি। শফিকুল ইসলাম সানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর বাগানে প্রচুর আম হয়েছিল। সে তুলনায় এবার আম যে পাব না, তা গাছ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। খরতাপ উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। এবার ফলন ভালো হবে না।’

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষক কর্মকর্তা উম্মে সালমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমের যা মুকুল আসে, তার সবগুলো আম হলে গাছ তো ধরে রাখতেই পারবে না। অল্প যে মুকুল থাকে, তাতে আম এলেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়।’

পোকার উপদ্রব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন তো হপার পোকা ও অ্যানথ্রাকনোজ নামের একটা ছত্রাকের সংক্রমণ থেকে আম রক্ষার জন্য অনুমোদিত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাতেই কাজ হওয়ার কথা। তা ছাড়া এখন খরা শুরু হয়েছে। চাষিরা সেচ দেবেন, মালচিং করবেন, বিকেলে বা সন্ধ্যায় গাছে পানি স্প্রে করবেন। এতেই কাজ হবে।’

বিজ্ঞাপন

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট হয়ে সোনামসজিদ পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশে শুধুই আমবাগান। এক বাগান অন্য বাগানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। বাগানে বাগানে বিশাল বিশাল সব গাছ। কিন্তু গাছে আম তেমন নেই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা লাউঘাট্টা এলাকার আমচাষি মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, এবার বাগানে প্রায় ৭০ ভাগ গাছে মুকুল এসেছিল। গত মার্চের ২০ ও ২১ তারিখে যে বৃষ্টি হয়েছিল, সেই বৃষ্টিতে সব মুকুল নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া যে আমগুলো গাছে ঝুলছিল তার সিংহভাগ এখন তীব্র খরায় ঝরে যাচ্ছে। এতে খরচ উঠবে না।

শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর এলাকার আমচাষি শাহাদ হোসেন সারাবাংলাকে জানান, চলতি বছর ছয় বিঘার একটি বাগানে অল্প গুটি এসেছিল। সেই গুটি ধরে রাখতে লড়াই করতে হচ্ছে। প্রায় দিনই সেচসহ কীটনাশক স্প্রে করতে হচ্ছে। তারপরও গুটি ঝরা রোধ করা যাচ্ছে না। এতে আমের ফলনে বিপর্যয় ঘটবে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদও ফলন নিয়ে চিন্তা করছেন না। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘গুটি কম এসেছে তা ঠিক। কিছু গুটি খরার কারণে ঝরেও পড়ছে। তারপরও যে পরিমাণ গুটি আসে তার একভাগ টিকে থাকলেও পর্যাপ্ত আম পাওয়া যাবে। কারণ, সব গুটি তো টেকে না। প্রতিটি মুকুল থেকে দুয়েকটি করে আম পাওয়া গেলেও চলবে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় চাষিদের খুবই সতর্কতার সঙ্গে গাছ পরিচর্যা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে। পাশাপাশি নানান ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ডা. পলাশ সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘চলতি মৌসুমে আমের অফ ইয়ার ধরা হয়েছে। কারণ গত বছর প্রচুর পরিমাণে আম এসেছিল। এবার মুকুল ও গুটি কম এসেছে। সেই গুটি টিকিয়ে রাখতে মাঠ পর্যায়ে চাষিদের নানান পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন।’

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, এবার আম কম হবে। আমের অনেক মুকুল ও গুটি নষ্ট হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে টানা খরার পাশাপাশি এবার আমের পরাগায়নে সহায়ক সিনফিড মাছি যথেষ্ট পরিমাণ দেখা যায়নি। এ ছাড়াও, গত মৌসুমে আমের ভালো ফলন হয়েছিল। এবার বেশির ভাগ গাছে নতুন পাতা এসেছে। তাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এবার নয়, আগামী মৌসুমে আমের ভালো ফলন হতে পারে।

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন