বিজ্ঞাপন

গভর্নিং বডির দুর্নীতি-অনিয়মে বেহাল দশায় কলেজ

April 26, 2024 | 9:17 pm

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

ফরিদপুর: গভর্নিং বডির দুর্নীতি, অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতায় বেহাল দশায় পড়েছে মধুখালী উপজেলার কুড়ানিয়ারচরের হাজী আব্দুর রহমান আব্দুল করিম ডিগ্রি কলেজ। কলেজটির সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মাদ মাহাবুবুর রহমান অনিয়ম ও স্বেছাচারিতার মূলোৎপাটন করতে গিয়ে খোদ গভর্নিং বডির সদস্যরা অনিয়ম ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন। বিষয়টি নিয়ে চরম অস্বস্তিতে আছেন কলেজের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মাদ মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টির কথা বলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য অবাধে ঢাকা ও গাজীপুর ও হাইকোর্টে আসা যাওয়ার নামে পাহাড়সমান খরচের ভাউচার পাস করিয়ে নিয়েছেন। কলেজের শিক্ষার মান উন্নয়ন তদারকির পরিবর্তে গভর্নিং বডির সদস্যরা নিয়োগ বাণিজ্যে অধিক মনোযোগী। কলেজের লেখাপড়া, শিক্ষা-দীক্ষাসহ সার্বিক মানোন্নয়নের কথা ভুলে গিয়ে অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনে মেতে উঠেছেন তারা। আদালতের খরচ বহনসহ নানা অজুহাতে গভর্নিং বডির কতিপয় সদস্য নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছেন।

শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠনসহ অন্যান্য সুবিধার কথা গভর্নিং বডিতে শিক্ষকরা উপস্থাপন করলেই বিদ্যোৎসাহী সদস্য মো. আব্দুল আজিজ, বিদ্যোৎসাহী সদস্য মির্জ্জা গোলাম ফারুক ও অভিভাবক সদস্য আব্দুর রহিম লস্কর রনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আলী মুহাম্মদ সেখ এবং সভাপতি নিজেও বারবার শিক্ষকদের জানিয়েছেন যে, সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের নামে হাইকোর্টে মামলা পরিচালনায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ কারণে সাবেক অধ্যক্ষের মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের কোনো সুযোগ সুবিধা কলেজ থেকে বহন করা যাচ্ছে না। অথচ কলেজ তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি। তিনিও কলেজের নামে কোনো মামলা করেননি।

এ ঘটনা জানার পর শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে গভর্নিং বডির সভায় আব্দুল আজিজ সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মাদ মাহাবুবুর রহমানের নামে ফের আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দিলে শিক্ষক প্রতিনিধি শিরিন আক্তারের বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে অনিয়ম ও অপকর্ম খতিয়ে দেখার জন্য গভর্নিং বডির সভাপতি ডা. মাহবুব আল করিম নামকাওয়াস্তে কমিটি একটি গঠন করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গভর্নিং বডির সদস্যরা কলেজের শিক্ষকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেন। শিক্ষকদের সম্পর্কে নানা নেতিবাচক মন্তব্য, অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং দুর্ব্যবহার অব্যাহত রাখেন।

বিজ্ঞাপন

২০২২ সালের ২৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-অভিভাবক সমাবেশ ও শিক্ষার মান উন্নয়ন বিষয়ক সেমিনারে শিক্ষকদের চাকরির উপার্জনকে হারাম বলে অভিহিত করেন কলেজ সভাপতি ডা. মাহবুব আল করিম। এ ঘটনায় কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি এবং সমাবেশে যোগ দেওয়া অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধানরাও আপত্তি ও ক্ষোভ জানান। প্রতিবাদ হিসেবে সব শিক্ষক কর্মচারী দুপুরের খাবার বর্জন করলে সভাপতি ডা. মাহবুব আল করিম, গভর্নিং বডির সদস্য মির্জ্জা গোলাম ফারুক, আব্দুর রহিম লস্কর রনি, আতাউর রহমান শিক্ষক প্রতিনিধিদের ওপর চড়াও হন। ফরিদপুর জেলা পরিষদের সদস্য মির্জা আহসানুজ্জামান আজাউলকে দিয়ে শায়েস্তা করার হুমকি দেন সভাপতি।

সূত্রমতে, কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আলী মুহাম্মদ সেখ দলাদলির পাহারা ও নিয়োগের টাকা সংগ্রহে ব্যস্ত থাকতেন এবং নিজের কক্ষকে রেস্ট্রিকটেডের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রবেশ অধিকার খর্ব করে গভর্নিং বডির কতিপয় সদস্যের আড্ডাখানায় পরিণত করেন। গভর্নিং বডির সদস্য আব্দুর রহিম লস্কর বাউবির পরীক্ষা হলে উপস্থিত হয়ে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন ও শিক্ষকদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করেন। গভর্নিং বডির বিদ্যোৎসাহী সদস্য মির্জ্জা গোলাম ফারুক ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য মো. আব্দুল আজিজ শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতির ভয় দেখান।

জানা গেছে, একাডেমিক বিষয়ে অধ্যক্ষের কর্মকাণ্ডে গভর্নিং বডির সদস্যরা অযাচিত হস্তক্ষেপ করে থাকেন। রেজুলেশন বইয়ে মিটিংয়ের রেজুলেশন লেখা হয় গভর্নিং বডির সদস্য আব্দুল আজিজ ও গোলাম ফারুক এর করা ড্রাফট অনুসারে। দাপ্তরিক পত্র লেখার ক্ষেত্রে অধ্যক্ষের স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ ঘটে না। গভর্নিং বডির সভার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রেজুলেশনভুক্ত হয় না। কখনও কখনও মিটিং শেষ হওয়ার পর রদ-বদল করে নতুন সিদ্ধান্ত লেখা হয়। সভাপতি নিজে সিদ্ধান্ত নিতে অপরাগতা প্রকাশ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে যাদের শরণাপন্ন হতেন তারা তাকে ব্লাকমেইল করে। গভর্নিং বডির অনিয়মের পক্ষে না থাকলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বিলে স্বাক্ষর করতে গড়িমসি করেন সভাপতি।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষকদের সনদ যাচাইয়ের ক্ষমতা গভর্নিং বডির না থাকলেও কুমতলবে গভর্নিং বডির সদস্য আব্দুল আজিজের উদ্যোগে শিক্ষকদের মূল সনদ যাচাই করেন গভর্নিং বডির সদস্যরা। আপত্তি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকরা তাদের একাডেমিক সনদ প্রদর্শনে বাধ্য হন। এমনকি সনদ যাচাই কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয় অভিভাবক সদস্য আব্দুর রহিম লস্কর রনিকে, যার সনদ সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।

শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাদরে গ্রহণ করেননি গভর্নিং বডির সদস্য আব্দুল আজিজ। তিনি তার আপত্তি কেবল মিটিংয়ে উপস্থাপন করেননি, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহণ না করার বিষয়টি সভাপতিকে চাপ প্রয়োগ করে রেজুলেশনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও গভর্নিং বডি গঠনের বিধি পরিপন্থী। কলেজ চলাকালে প্রায় সময় গভর্নিং বডির সদস্য আব্দুল আজিজ, মির্জ্জা গোলাম ফারুক ও আব্দুর রহিম লস্কর রনি অধ্যক্ষের কক্ষে শিক্ষক প্রতিনিধি ও গভর্নিং বডির অন্যান্য সদস্যদের অনুপস্থিতে মিটিং করেন। সেখানে সভাপতি না থাকলেও মিটিংয়ের আলোচনা রেজুলেশনভুক্ত হয় ও বাস্তবায়ন হয়।

সূত্রমতে, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের টাকা অনুদান হিসেবে কলেজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা না করে গভর্নিং বডির সভাপতির মালিকানাধীন মালেকা হাসপাতালে জমা করা হয়। সভাপতির এজেন্টরা তাদের ভাগের অংশ এখান থেকে নিয়ে নেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে আলী মুহাম্মদ সেখ দায়িত্ব পালনের সময় গভর্নিং বডির এ সব অনিয়ম হয়। অডিট করার সময় দুর্নীতিপরায়ণ সদস্যদের নিয়ে মো. আব্দুল আজিজ উপস্থিত হয়ে অডিটে কী কী অনিয়ম হচ্ছে তা অবগত হন এবং সেগুলো দাপ্তরিকভাবে ঠিক করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের অনিয়মগুলোকে বৈধ ভাউচারে সমন্বয় করে নিজেদের ইচ্ছেমত অডিট রিপোর্ট তৈরি করেন। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটিতে সদস্য হিসেবে তারাই স্থান পায় যারা বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।

এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গভর্নিং বডির পরিপত্র লঙ্ঘন করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট গভর্নিং বডির পরিবর্তে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট গভর্নিং বডি দিয়ে পরিচালিত হয়েছে কলেজের কার্যক্রম। সভাপতির অনুপস্থিতিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বিলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির ১২ নং ধারা অনুসারে উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরে বেতন উত্তোলনের বিধান থাকলেও তা মানা হয় না। সভাপতি তার পছন্দসই ব্যক্তিকে দিয়ে অনিয়ম করে বেতন উত্তোলনের ব্যবস্থা করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গভর্নিং বডির কাঠামোতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদ না থাকলেও এখানে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পদ সৃষ্টি হয়েছে। সভাপতির অনুপস্থিতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন বিদ্যোৎসাহী সদস্য মো. আব্দুল আজিজ, যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের এক্তিয়ারের প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরূপ।

বিজ্ঞাপন

সূত্রমতে, ডিজির পরিপত্র মোতাবেক অধ্যক্ষের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার কথা উপাধ্যক্ষের। কিন্তু ডিজির পরিপত্র তোয়াক্কা না করে গভর্নিং বডির অধিকাংশ সদস্যের মতামত অগ্রাহ্য করে বিধি বহির্ভূতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয় শিক্ষক তালিকার ৩ নং শিক্ষক মো. আব্দুর রাজ্জাক মিয়াকে। সহকারী অধ্যাপক মো. আব্দুর রাজ্জাক মিয়া কলেজ গভর্নিং বডির বিদ্যোৎসাহী সদস্য মো. আব্দুল আজিজের ভাতিজা। মো. আব্দুর রাজ্জাক মিয়া ২০০৪ সালে একজন ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লে এলাকার ছাত্র-অভিভাবক মিলে তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে।

২০১৬ সাল থেকে চলে আসা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ষোলকলা পূর্ণ করতে যাচ্ছে গভর্নিং বডি। ডিজির পরিপত্র লঙ্ঘন করে অবৈধ পন্থায় নিয়োগ দেওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে দিয়ে একই চরিত্রের অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে যাচ্ছে তারা। নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা ও কলেজের ডিগ্রি শাখা এমপিওকরণের নামে মোটা অংকের টাকা শিক্ষকদের কাছ থেকে বাণিজ্য করার কারণে নিজ প্রতিষ্ঠানে তোপের মুখে পড়া এবং নানা অপরাধের কারণে নিজের কর্মস্থলে অবাঞ্চিত পার্শ্ববর্তী কলেজের এক অধ্যক্ষকে হাজী আব্দুর রহমান আব্দুল করিম ডিগ্রি কলেজে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে গভর্নিং বডি। আর এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মোটা অংকের ঘুষ লেন-দেনের অভিযোগ উঠেছে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে গভর্নিং বডির সভাপতি ডা. মাহবুব আল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ একটাও প্রমাণ করতে পারবেন না। কলেজে যা কিছু হয়েছে সবার উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে এবং মিটিং রেজুলেশনের মাধ্যমে হয়েছে। কলেজের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এক টাকাও ঘুষ লেন-দেন হয় না। অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রেও হবে না। যদি ঘুষ লেন-দেন প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমি রিজাইন করব।’

কথা বলার একপর্যায়ে ফোন কেটে দেন ডা. মাহবুব আল করিম। এর কিছুক্ষণ পর গভর্নিং বডির বিদ্যোৎসাহী সদস্য মো. আব্দুল আজিজ এ প্রতিবেদককে ফোন দেন। এ সময় সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বগ্রহণ, ব্যাংকে রক্ষিত স্বাক্ষর কার্ডে নাম অন্তর্ভুক্তিকরণ, বেতন বিলে স্বাক্ষরসহ সবকিছু বিধি মোতাবেক হয়েছে। এ ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি থাকলে তারা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আমরা আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বিষয়টি ফায়সালা করব।’

অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং চরিত্রহীন ব্যক্তিকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি একজন অসৎ লোককে নিয়োগ দিই, তাতে আপনাদের কী সমস্যা? নিয়োগ বোর্ডে ইন্টারভিউ দিয়ে কেউ যদি চাকরি পায়, তাতে কারও কিছু বলার সুযোগ নেই। কলেজের মঙ্গলের জন্য দেখে-শুনে ভালো লোকই নিয়োগ দেওয়া হবে।’

সারাবাংলা/এজেড/একে

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন