বিজ্ঞাপন

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় রক্তাক্ত মঠবাড়িয়া এখন আতঙ্কের জনপদ

June 11, 2024 | 11:40 pm

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ভোটের পরের দুদিনে নির্বাচনে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় হামলা-সংঘর্ষ ঘটেছ। এতে গুরুতর জখম হয়ে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে ৫০ জনেরও বেশি কর্মী-সমর্থককে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ঘরবাড়িতে। প্রতিদিনেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে গত ২৯ মে ভোট হওয়ার কথা ছিল পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সেই নির্বাচন স্থগিত হয়। পরে গত রোববার (৯ জুন) এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর নির্বাচনের দিন থেকে শুরু করে আজ মঙ্গলবার (১১ জুন) পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলছে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা।

মঠবাড়িয়া উপজেলার এই ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থী বায়জিদ আহমেদ খান। প্রতিদ্বন্দ্বী আনারস প্রতীকের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদকে তিন হাজার ৩৪৬ ভোটে পরাজিত করেন তিনি।

স্থানীয়রা জানান, রোববার রাত ৯টার দিকে ভোটের ফলাফল ঘোষণার পরপরই শুরু হয় হামলা-সংঘর্ষ। ওই রাতেই আনারস প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া যায়। উপজেলার কয়েকটি গ্রামে কৃষকের খড়ের গাদায় আগুন দেওয়া হয়। বেশ কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।

বিজ্ঞাপন

গত দুদিনে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন নির্বাচন-পরবর্তী হামলা-সংঘর্ষের শিকার হয়ে। ছবি: সারাবাংলা

স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বায়জিদ আহমেদের পক্ষে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। নির্বাচনে বায়জিদের জয়ের পর তারাই রিয়াজ আহমেদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা চালান। হামলার শিকার হওয়ার শঙ্কায় নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি স্থানীয় শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অনেকেই। নাম গোপন রাখার শর্তে তারা সারাবাংলাকে বলেন, এর মাধ্যমে চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করা রিয়াজ আহমেদের ওপর বড় প্রতিশোধ নিয়েছেন তারা।

তারা আরও বলছেন, মঠবাড়িয়া ও ভান্ডরিয়ার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন তেলিখালীর একটি গ্রাম হরিপাগলার চিহ্নিত সন্ত্রাসী সাদ্দামের নেতৃত্বে তুষখালী ইউনিয়নের ছোটমাছুয়ার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য সগিরে বাহিনী এসব হামলায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। তারা রিয়াজ আহমেদের সমর্থকদের ঘরবাড়ি বিক্রি করে দিয়ে এলাকা ছাড়তে বলেছে।

স্থানীয় অধিবাসী, পুলিশ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নির্বাচনের পর তুষখালী বাজারে বসবাসরত সাংবাদিক কামালের বাড়িতে গভীর রাতে হামলার ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে আইনুল হক স্বপন ফরাজীর বাড়ীতেও। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করার পর ঘটনাস্থলে পুলিশ তদন্তে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত হরিপাগলার চিহ্নিত সন্ত্রাসী সাদ্দাম ও তুষকালীর সগীর মেম্বর গ্রেফতার হননি।

বিজ্ঞাপন

মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. রাকিবুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, ভোটের রাত থেকে শুরু করে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হামলা-সংঘর্ষে আহত শতাধিক ব্যক্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনের জখম গুরুতর হওয়ায় তাদের বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কয়েকজনকে পঠানো হয়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই বিভিন্ন বাড়িঘরে হামলা চালানো হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

ডা. রাকিবুলের তথ্য অনুযায়ী, মঠবাড়িয়ার বেতমোর রাজপাড়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম (৫০), চড়কগাছিয়া গ্রামের ওয়াজেদ আলীর ছেলে আইনজীবী সহকারী আব্দুল আউয়াল (৫০), বাদুরা গ্রামের মন্নান হাওলারের ছেলে কলেজ ছাত্র রোহান (২৫), বড়শিংঙ্গা গ্রামের আ. মন্নান হাওলাদারের ছেলে নুরুল হক (৬৫), টিকিকাটা গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে আল আমিন (৫০) ও বুড়িরচর গ্রামের আওলাদ হাওলাদারের ছেলে কলেজছাত্র নাজমুলসহ (২৪) কয়েকজনকে পাঠানো হয়েছে বরিশালে। অন্যদিকে উপজেলার বাদুরা গ্রামে সন্ত্রাসী হামলায় আহত আটজনের মধ্যে সংকটাপন্ন শহিদ পঞ্চায়েতকে পাঠানো হয়েছে খুলনায়।

সোমবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার দুপুর ২টা পর্যন্ত সময়েও উপজেলায় পৃথক পৃথক হামলার ঘটনায় অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দধিবাংগা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক ইউপি সদস্য হুমায়ুন কবির (৬৫), ফারুক খান (৬৬), ফুলঝুড়ি গ্রামের সাইফুল ইসলাম (২২), শাহ আলম (৬২), মহিউদ্দিন (৩৫), বাদুরা গ্রামের মিরাজ (২৫) ও আ. মালেককে (৭০) গুরুতর আহত অবস্থায় বরিশালে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ছয়জনকে ভর্তি করা হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। ডা. রাকিবুল জানান, গুরুতর আহত সাইফুল ইসলাম ও মহিউদ্দিনের অবস্থা সংকটাপন্ন।

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে মঠবাড়িয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বাচ্চু মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে-পরে কখনো এ রকম অরাজকতা হয়নি। মঠবাড়িয়া এখন রীতিমতো রক্তাক্ত জনপদ। এখানে ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়েছে। মানুষ চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। আমি নিজেও আতঙ্ক নিয়ে সাবধানে চলাফেরা করছি। কারণ বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসীরা কখন কার ওপর হামলা চালায়, বলা মুশকিল।’

বিজ্ঞাপন

এমন সংঘাতসময় পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘পুলিশের ভূমিকা মনে হচ্ছে পুতুলের মতো। হয়তো তারা কারও কাছে প্যাকেট হয়ে গেছে।’

কেবল হামলা-ভাঙচুর নয়, কয়েকটি বাড়িতে আগুনও দেওয়া হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘মঠবাড়িয়ার পরিস্থিতি ভয়াবহ। জনগণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আমি ইউনিয়নে ইউনিয়নে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছি।’ পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এই জনপ্রতিনিধিও।

জানতে চাইলে মঠবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) আলী রেজা বলেন, ‘আপাতত পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান বায়জিদ ও স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রতিটি ইউনিয়নে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য সবার সঙ্গে মতবিনিময় করছেন।’

পিরোজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুকিত হাসান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মঠবাড়িয়া পরিদর্শনে গিয়েছি। পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য প্রতিটি সড়কের মোড়ে পুলিশ মোতায়ন ও পুলিশের টহল বাড়িয়েছি। নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। হামলা-সংঘর্ষে জড়িত অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর বাইরেও তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পেলে বা সুনির্দিষ্টভাবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাকেও গ্রেফতার করা হবে।’

এসব বিষয়ে জানতে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান বায়জিদ আহমেদ খান এবং ভোটে পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের মোবাইল নম্বরে কয়েক বার কল করা হলেও তারা রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

ভাঙচুর করা হয়েছে নির্বাচনি কার্যালয়ও। ছবি: সংগৃহীত

সব শ্রেণিপেশার মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান

মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘মঠবাড়িয়ার পরিস্থিতি ভালো না। মানুষ এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা পছন্দ করে না। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সবাইকে যৌথভাবে এগিয়ে আসতে হবে।’

তুষখালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল শরীফ বলেন, ‘মঠবাড়িয়ার পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। জনগণ আতঙ্কের মধ্যে আছে। আমাকেও আতঙ্কে মধ্যে থাকতে হয়।’ অধ্যাপক গোলাম মোস্তফার মতো তিনিও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাই মিলে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন।

মঠবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি মিজানুর রহমান মিজু বলেন, ‘মঠবাড়িয়া এখন আতঙ্কের উপজেলা। এই আতঙ্ক দূর করতে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে যৌথভাবে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে। পুলিশ-প্রশাসন অরাজকতা থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ভূমিকায় জনগণ সন্তুষ্ট নয়।’

সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন