বিজ্ঞাপন

আদরের বিড়াল, ভালোবাসার গিটার সবই আছে, ঘরজুড়ে তবুও শূন্যতা

December 5, 2018 | 4:54 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘মেয়েটা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ‘কুটুস’ ওর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো, স্কুলের পোশাক না বদলায়ে আগে ওকে কোলে নিত, বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরতো। ওকে খাবার খাইয়ে তারপর নিজের ঘরে যেত। আর যদি কোনো কারণে কোলে না নিত তাহলে মেয়ের পায়ে পায়ে ঘুরতো। সেই ‘কুটুস’ কাল থেকে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, অরিত্রীর খাটে গিয়ে শুয়ে থাকছে, আমরা কেউ খাবার দিলেও খাচ্ছে না। তিনদিন ধরে অরিত্রী নেই, তিনদিন ধরে খাচ্ছে না ওর আদরের বিড়াল।’

বুধবার (৫ ডিসেম্বর) সকালে শান্তিনগরের বাসায় অরিত্রীর প্রিয় বিড়াল কুটুসকে কোলে নিয়ে বসে থাকা বাবা- দিলীপ অধিকারী এ প্রতিবেদকের কাছে যখন এসব বলছিলেন তখন তার দুচোখ গড়িয়ে ঝরছিলো বাঁধভাঙ্গা অশ্রু।

আরও পড়ুন- ভিকারুননিসায় রোববার থেকে ক্লাস-পরীক্ষা, ৩ শিক্ষক বরখাস্ত

গত দুই দিন ধরে অরিত্রীর বাসাভর্তি আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। যে আসছে তাকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদছেন দিলীপ অধিকারী।

বিজ্ঞাপন

এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছেন মেয়ের কথা, মেয়ের আদরের বিড়ালের কথা। কখনো কালো রংয়ের ব্যাগ থেকে খুলে সবাইকে দেখাচ্ছেন অরিত্রীর গিটার। গিটার খুঁজতে গিয়ে দেখতে পান সেটা মেঝেতে রাখা। আমার মায়ের গিটার নিচে রেখেছে কে প্রশ্ন করতে করতে নিজেই টেবিলের ওপরে রাখেন। বলেন, মেয়ে গিটার ধরতে দিতো না, বলতো-টিউন নষ্ট হয়ে যাবে। সেই বিড়াল, সেই গিটার ছেড়ে মেয়েটা চলে গেছে। তার বাসায় তিনদিন ধরে এত এত মানুষ আসছে, কিন্তু পুরো ঘরজুড়ে শূন্যতা, বলেন দিলীপ চৌধুরী।

অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারী গত ডিসেম্বরে স্ট্রোক করেছেন। সেই থেকে তিনি অসুস্থ। আর মেয়ের চলে যাওয়াতে তিনি প্রায় বাকরুদ্ধ। নীরবে কেঁদে যাচ্ছে অরিত্রীর ছোট বোন ঐন্দ্রিলা। খাওয়া বন্ধ তার, কথাও বলছে না কারও সঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

অরিত্রীর বাসায় যাবার পরই বই ও পোশাকের আলমারি, পড়ার টেবিল, পুতুল দেখিয়ে দিলীপ অধিকারী বলেন, কত কিছু করতো মেয়েটা, সব শেষ হয়ে গেল আমার। স্পিকার দেখিয়ে বলেন, এটা দিয়ে গান শুনতো। সবকিছু রেখে গেল মেয়েটা, কেবল সে চলে গেল—আমি কেমন করে বাঁচবো? মেয়ের কাপড়ে হাত বুলিয়ে বাবা বলেন—এসব ড্রেস আর কখন পরবে না আমার বাচ্চাটা।

অরিত্রীর পুরো বাড়ি ঘুরে জানা যায়, বাবা-মা আর তারা ‍দুইবোন থাকতেন পাশাপাশি দুটি কক্ষে। আর এই দুই কক্ষের সঙ্গেই লাগোয় সামনের অংশে একটি ট্রের ওপরে রাখা একটি ছবি। সেখানে অরিত্রীররা দুবোন আর বাবা-মায়ের একটি পারিবারিক ছবি। ছবিটির ওপরে লেখা, ‘ফানি লাইফ’, আর পাশে ছোট করে লেখা ‘মিস ইউ’।

বাসায় থাকা অরিত্রীর চাচা বলেন, আগে যদি জানতাম, তাহলে মিস ইউ লেখা ফটো ফ্রেমে এই ছবি রাখতে দিতাম না। আমরা সবাই তোকে মিস করছি মা—বলেই  হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী কোনো ভাবেই নিজেকে সামাল দিতে পারছেন না। মেয়ের কথা বলতে বলতে মেয়ের স্মৃতি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন আর কাঁদছিলেন।

দিলীপ অধিকারী জানান, তার বড় মেয়ে ছোট থেকেই মেধাবী। ভিকারুননিসা নূন স্কুলে প্রথম শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় তৃতীয় হয় সে। ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে সে এ প্লাস পেয়েছে, গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে অষ্টম শ্রেণিতে। সেই মেয়ে মোবাইলে নকল করছিল—এ কথা কতুটুকু বিশ্বাসযোগ্য—সে প্রশ্নও তোলেন দিলীপ অধিকারী।

এক নাগাড়ে বলতে থাকেন দিলীপ, হয়তো একটা মোবাইল তার কাছে ছিল, কিন্তু তারাতো একটা সুযোগ আমাকে, আমার মেয়েটাকে দিতে পারতো। ওর সামনে দাঁড়িয়ে মাফ চেয়েছি, বলেছি একটা সুযোগ দেন আমাকে। পরীক্ষাটা দিতে দেন—আমি মেয়েকে আর পড়াবো না, কিন্তু তারা শোনেনি।

শাস্তি হিসেবে স্কুল থেকে টিসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং বাবা-মায়ের অপমান সে সহ্য করতে পারেনি আমার বাচ্চাটা। স্কুল থেকে বের করে দিলে বাবার মানসম্মান থাকবে না—এটা ভেবেই আমার মেয়ে চলে গেল।

ওই স্কুলের কতজন আছে যারা আমাকে চেনে, ওকে চেনে। স্কুলের শিক্ষক, আত্মীয়, বন্ধুদের সামনে আমার অপমান সে সহ্য করতে পারেনি। ওর সামনেই আমাকে, ওর মাকে যে অপমান করেছে। ওর সামনে বলেছে, আপনারা বের হয়ে যান, বের হয়ে যান, তারা দূর ‍দূর করে আমাকে তাড়িয়ে দিল। এগুলো ও সহ্য করতে পারেনি।

দুই মেয়ের সব সার্টিফিকেট একটা ফাইল করে রেখেছেন এতদিন দিলীপ অধিকারী। সেখান থেকে অরিত্রীর সার্টিফিকেট দেখাতে দেখাতে বলেন, ‘ওর সার্টিফিকেট তো আর কোনো কাজে লাগবে না, ভিকারুননিসা আমাকে শেষ করে দিল। ওই স্কুলে কেন পড়াতে গেলাম আমি, তাহলে আজ আমাকে মেয়েহারা হতে হতো না’- বিলাপ করতে থাকেন দিলীপ অধিকারী।

‘সন্তানের মৃতদেহ বাবার জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী, কিন্তু সেটা যে এতো ভারী, এত কঠিন তা আমি জানতাম না, মরে গিয়ে আমার অরিত্রী আমাকে সে শিক্ষা দিয়ে গেল। ওর আগে কেন আমি চলে গেলাম না।’

অরিত্রীর মা দিপালী অধিকারী অসুস্থ, কিন্তু মৃত্যুর পর তিনি প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছেন। কেবল নিজেদের অ্যালবাম বের করে ছবিগুলো দেখছিলেন, দেখাচ্ছিলেন। সেসব ছবি দেখাতে দেখাতে বলেন, ওর জন্ম থেকে শুরু করে প্রতিটি ছবি এখানে আছে, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে বলেই বোধহয় এত ছবি তুলেছিলাম আমরা।

অরিত্রীর বাসায় আসা আত্মীয়-স্বজনরা বলছেন, আমাদের মেয়ে চলে গিয়েছে, তাকে আর ফেরত পাবো না। কিন্তু যেজন্য সে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে—আমরা চাই না সে ঘটনা আবার ঘটুক। আর কোনো অরিত্রী অভিমান করে চলে যাক, আর কোনো বাবা-মায়ের কোল খালি হোক।

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ

আরও পড়ুন-

ক্ষমা চাইলেন ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ
শান্তিনগরে ভিকারুননিসা শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে: শিক্ষামন্ত্রী
ভিকারুননিসার শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, তদন্তে ৩ কমিটি
ভিকারুননিসার প্রভাতী শাখার প্রধান শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত
শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ
বুধবার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের
অরিত্রীকে আমরা ভুলে যাব
শিক্ষার্থীদের মানসিকতা আমরা বুঝছি না

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন