বিজ্ঞাপন

কারাগারে বন্দি জবি ছাত্রের খোলা চিঠিতে আত্মহত্যার হুমকি

March 2, 2019 | 2:20 am

।।সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘আমি চিন্তা করেছি এখান (কারাগার) থেকে বের হয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে যাবো। তারপর আম্মু, আমি আর আমার প্রতিবন্ধী ছোট বোন এই ৩ জন মিলে সুইসাইড করবো।’

এভাবেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এহসান হাবীব সুমন নামে এক শিক্ষার্থী জামিনে বের হওয়া অন্য এক বন্দির মাধ্যমে চিঠি পাঠান। পরে সেই চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করা হলে ভাইরাল হয়।

কারাগার থেকে পাঠানো জবি ছাত্রের ওই খোলা চিঠিতে লেখা আছে,

বিজ্ঞাপন

‘আমি এহসান হাবিব সুমন। জগন্নাথের ১১তম আবর্তন ফিন্যান্স বিভাগে পড়ি। একজন নির্দোষ মানুষের জীবনে এরকম একটা ঝড় আসতে পারে, এটা এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছি না। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মানুষের জীবন কতখানি বদলে যেতে পারে তার বড় স্বাক্ষী এখন আমি নিজেই। যে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে এত স্বপ্ন দেখিয়েছে, আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয় আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে।

প্রথমেই বলে রাখি, আমি কখনো কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম না। বাবা মারা যাওয়ার পর নিজের পরিবারটাকে চালাতে আমার যায় যায় দিন অবস্থা। অথচ গত ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলায় (আনুমানিক সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা) ক্যাম্পাসের সামনে থেকে রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। এখন কারাগারে বসে কাগজে কলমে সেদিনের ঘটনাটা একটু বর্ণনা করতে চাই।

আমার একটি বাইক আছে। আমার বাসার নিচে কোনো গ্যারেজ না থাকার কারণে বিগত ৪ মাস ধরে আমি আমার বাইক ক্যাম্পাসের বিবিএ ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে রাখি। গত ১৯ তারিখেও রাতে সাড়ে ৭টার দিকে আমি বাইক রাখতে ক্যাম্পাসে যাই। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে বাইকটা রেখে লক করে হেলমেটটা হাতে নিয়ে বাইরে চলে আসি। আন্ডারগ্রাউন্ডের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তার প্রমাণ। বের হয়ে গেটে আসতেই দেখি, আমার রুমমেট জিএম শোভন শিশির ক্যাম্পাসের গেটে একটি বেঞ্চে বসা।

বিজ্ঞাপন

আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম, বন্ধু বাসায় যাবি না? ও বললো, হ্যাঁ চল, একটা চা খেয়ে যাই। ভার্সিটি গেটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখলে এটারও প্রমাণ মিলবে। এর মধ্যে খুব সম্ভবত আমাদের সহকারী প্রক্টর স্যার ক্যাম্পাস থেকে বের হচ্ছিলেন। উনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন আপনার কারা? এখানে কি করছেন? জবাব দেয়ার আগেই ২০ থেকে ৩০ জন পুলিশ হঠাৎ করে গেটের সামনে চলে আসে। পুলিশের এক কর্মকর্তা আমাদের আটক করার আদেশ দেন। কিছুই বুঝতে পারলাম না, কি হচ্ছে। কেন তুলে নিচ্ছেন জিজ্ঞাসা করলেও কোনো জবাব পেলাম না। থানায় নিয়ে হাজতে ঢোকানোর পর জানতে পারলাম, গত ১৮ তারিখের মারামারিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করে দিয়েছে। আবার কেউ কেউ বলতে লাগলো, আমরা বিজয় মিছিল করেছি, পোস্টার ছিঁড়েছি কমিটি বাতিল হবার পর। তাই আমাদের আটক করা হয়েছে।

এ ঘটনা শুনে আমি প্রচণ্ড অবাক হলাম। যেহেতু আমি জীবনে কখনো রাজনীতি করিনি, তাই কখনো রাজনৈতিক খোঁজখবর নিয়ে মাথাও ঘামাইনি। আমি সবাইকে বললাম, ভাই আমি তো এসবের কিছুই জানি না। আমি তো কোনোদিন রাজনীতি করিনি। আপনার ভুল করে আমাকে ধরেছেন, আমাকে ছেড়ে দিন।

পুলিশ আশ্বাস দিল, আপনি নির্দোষ হলে আপনাকে ছেড়ে দেয়া হবে, কোনো অসুবিধা নেই। রাতে ওসি মওদুদ ভাইয়ের রুমে ডেকে নিয়ে উনি নাম, ঠিকানা সবকিছু জিজ্ঞাসা করায় আমি বললাম। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ক্যাম্পাসে কেন এসেছিলাম? আমি হেসে হেসেই জবাব দিলাম, বাইক রাখতে এসেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আজ কি আমার এখানে থাকা লাগবে? উনি বললেন, বলা যাচ্ছে না। তোমাদের ভেরিফাই করা হবে। তারপর একটু সময় তো লাগবেই। যেহেতু নির্দোষ ছিলাম সেহেতু ভেরিফাইয়ের কথা শুনে সাহস পেলাম। কারণ আবারো বলছি আমার কোনোদিনও কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। আর এসব ঘটনার কিছুই আমি জানি না। জড়িত থাকার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। ক্যাম্পাসের গেট থেকে আমিসহ মোট ৫ জন আটক হয়েছিলাম। রাতে আরো ২ জনকে আটক করে নিয়ে আসলো। মোট ৭ জন। ভার্সিটি গেট থেকে ধরে আনা ২ জন বাদে বাকি ৩ জন এবং রাতে ধরে আনা ২ জনকে কেস দিয়ে কোর্টে চালান দেয়া হলো দুপুর ১টার দিকে। আমি বললাম, ভাই একটু তাড়াতাড়ি করেন। কাল রাত থেকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে, অথচ আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।

দুপুর ১টার দিকে যখন একজন পুলিশ এসে আমিসহ আরো ৫ জনের নাম ধরে ডেকে বললো যে আপনাদের নামে মামলা দেয়া হয়েছে। আপনাদের কোর্টে চালান দেয়া হবে এখুনি। শুনেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সেসময় একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম, একজন দোষী সবসময় বলে সে নির্দোষ। কিন্তু একজন নির্দোষের আসলে কিছুই বলার থাকে না। যতদূর জানি, আমাদের প্রক্টর স্যারকে তো জানানোর কথা মামলা দেয়ার আগে। উনি তো একজন নিরপরাধ শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংস করে দিতে পারেন না। আমি রাজনকে বললাম প্রক্টর স্যারকে ফোন দিতে। স্যার ফোন ধরলেন না। রাজন প্রক্টর স্যারকে ফোন দিচ্ছে আর অন্যদিকে আমি চিল্লাচ্ছি, আমি তো কিছু করিনি। আমাকে কেন মামলা দিবে? আমাদের ৫ জনকে হাতকড়া পরানো হলো। জীবনের সব স্বপ্ন মনে হলো এক মুহূর্তেই কেউ ভীষণ জোরে আছাড় মেরে ভেঙে দিল। গাড়িতে উঠিয়ে ভার্সিটির সামনে দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে আমাদের কোর্টে নিয়ে যাচ্ছে এমন সময় শিশির পুলিশের কাছে মামলার কাগজ দেখতে চাইলো, আমিও দেখলাম। দেখে আমি এতটাই অবাক হলাম যেন বোবা থাকা অবস্থায় আরো বোবা হয়ে গেলাম।

বিজ্ঞাপন

মামলায় লেখা ১৮ ফেব্রুয়ারি মারামারিকে কেন্দ্র করে মামলা দিয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি আমি গিয়েছিলাম মিরপুর BRTA-তে, আমার বাইকের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার আনতে। সেদিন শামীম আহম্মেদ সুমন ভাইও আমার সাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত BRTA-তে ছিলেন। বাইকের রেজিস্ট্রেশন পেপার ও নাম্বার পাবার পরপরই গ্লোবাল ইনস্যুরেন্স থেকে বাইকের ইনস্যুরেন্স করাই। এই সমস্ত পেপার তখনো আমার পকেটে ছিল এবং দুইটি পেপারেই ১৮ তারিখের কথা উল্লেখ আছে।

যাই হোক, বাকি ঘটনা আর বলতে চাই না। অবাক হতে হতে আর কাঁদতে কাঁদতে আমি ক্লান্ত। একজন নিরপরাধ এবং নিরীহ মানুষ হয়েও আমি জেলে বসে আছি। জেলখানায় এসে মায়ের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। প্রথম ২ দিন মা মা করে অনেক কেঁদেছি। এখন একটু শক্ত হয়েছি। আমি জানি, আমার মা এখনো কাঁদছে। এখন রাত ৩টা বেজে ১৫ মিনিট। আমার মা ঘুমোতে পারেনি। মায়ের সাথে সন্তানের টেলিপ্যাথির জোরটা অনেক বেশি। মা, তুমি প্লিজ কান্নাকাটি করো না। আমি ভালো আছি মা। অনেক ভালোবাসি মা তোমায়। এখানে এসে একটা কথা বুঝেছি। জেলের ভেতরে মানুষ জেল খাটে না, জেল খাটে বাইরের মানুষ।

আমি চিন্তা করেছি এখান থেকে বের হয়ে বাড়ি ফিরে যাবো মায়ের কাছে। তারপর আম্মু, আমি আর আমার প্রতিবন্ধী ছোট বোন এই ৩ জন মিলে সুইসাইড করবো। অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম, মাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম। তার কোনোটাই এখন আর অবশিষ্ট নেই। স্বপ্ন না থাকলে, আশা না থাকলে ভাবলেশহীন জীবন কাটায়। আর স্বপ্ন ভেঙে গেলে মানুষ সুইসাইড করে। এটা যে আমার সুইসাইড নোট এমন কিছুও না। হয়তো বেঁচেই থাকবো। আত্মহত্যা করার মতো অতটা সাহসও হয়তো আমার হবে না।

আমার এই কথাগুলো সংশ্লিষ্ট মহলে পৌঁছাবে কি না জানি না। কেউ কোনোদিন জানবে কি না তাও জানিনা। তবুও বলে যেতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত প্রক্টর স্যার, মাননীয় ভিসি স্যার আমাদের অভিভাবক। আমরা তাদের সন্তান। আপনাদের এমন এক সন্তান আজ জেলে আটক আছে যে কি না কিছুই জানতো না। আপনাদের এমন এক নিরপরাধ সন্তান জেলে আছে যে কি না কোনোদিন রাজনীতিটাও করেনি। সংসার আর নিজের জীবনের ঘানি টানতে টানতে সময় পার করেছি জীবনটা। হ্যাঁ, মানছি আপনার কিছু সন্তান অপরাধ করেছে। কিন্তু তার জন্য একটা নিরপরাধ নিরীহ মানুষ ফেঁসে গেল। যার অপরাধ শুধু একটাই ক্যাম্পাসে বাইক রাখতে এসেছিল। আসল অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অথচ পরিস্থিতি শান্ত করার নামে এমন একটা মানুষের বলিদান দিলেন যার দুইকুলে কেউ নেই। আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ রইলো স্যার, ভবিষ্যতে আপনার কোনো নিরপরাধ সন্তানের জীবনটা যেন এভাবে নষ্ট না হয়ে যায়। মামলা দেয়ার আগে একবার হলেও দেখে নিবেন বৃহত্তর স্বার্থে কোনো নিরীহ ছাত্র যেন কখনো বলির পাঠা না হয়ে যায়।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ) থেকে এহসান হাবিব সুমন, ১১তম ব্যাচ ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. নুর মোহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, খোলা চিঠির বিষয়টি জানা নেই। আর সংঘর্ষে যারা জড়িত ছিলেন কেবল তাদের নামেই মামলা হয়েছে। কেউ নির্দোষ হয়ে থাকলে সে ব্যাপারে ভেবে দেখা হবে বলে জানান প্রক্টর।

জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, নির্দোষ দাবি করে কারাগার থেকে খোলা চিঠির বিষয়টি প্রথম আপনার কাছে জানলাম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের পর প্রক্টরের মাধ্যমে কয়েকজন ছাত্রকে আটক করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা করলে তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এখানে পুলিশের কোনো দায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কোনো ঘটনা বা পুলিশ বাদি হলে দায়টা পুলিশের ওপর পড়ত। এরপরেও আমরা এ বিষয়টি দেখব বলে জানান তিনি।

সারাবাংলা/ইউজে/এনএইচ

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন