August 12, 2019 | 7:46 pm
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামজুড়ে কোরবানি দেওয়া প্রাণীর কাঁচা চামড়া বিক্রির জন্য নগরীর চৌমুহনী এলাকায় আসতে শুরু করেছে। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এলাকা থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য আনতে শুরু করেছেন। তবে এবার চামড়ার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম বলে জানিয়েছেন সংগ্রহকারীরা। সংগ্রহ করা চামড়ার প্রত্যাশিত দরও মিলছে না বলে জানিয়েছেন তারা।
কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংগ্রহকারীরা কাঁচা চামড়া সরাসরি আড়তদারের কাছে বিক্রি করতে পারেন না। মূলত চার হাত ঘুরে কাঁচা চামড়া যায় আড়তে। প্রথমে কোরবানি দাতাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করেন স্থানীয় বিভিন্ন পেশার লোকজন যাদের সাধারণত ‘একদিনের চামড়া ব্যবসায়ী’ বলা হয়। তাদের সংগ্রহ করা কাঁচা চামড়া জমা হয় খুচরা বিক্রির বড় আসর নগরীর চৌমুহনী এলাকায় কর্ণফুলী মার্কেটের সামনে।
খুচরা বাজার থেকে সেই চামড়া কিনে নেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছ থেকে কিনে নেন আড়তদারের প্রতিনিধিরা। সেখান থেকে আড়তদার হয়ে কাঁচা চামড়া যায় নগরীর আতুরার ডিপোর মূল আড়তে।
সোমবার (১২ আগস্ট) দুপুরে চৌমুহনীকে কাঁচা চামড়ার খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চামড়ার পরিমাণ অন্য বছরের চেয়ে কম। প্রতিবছর কাঁচা চামড়া নিয়ে আসেন, এমন সংগ্রহকারীরা বলেছেন, পাড়া-মহল্লায় অনেকেই এবার কাঁচা চামড়া বিক্রি না করে এতিমখানায় দিয়েছেন। এতিমখানা থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীরা সরাসরি গিয়ে চামড়া কিনছেন। ফলে খুচরা বাজারে চামড়ার পরিমাণ কম।
নগরীর আমবাগান থেকে ৩৪টি বড় গরুর চামড়া নিয়ে এসেছেন স্থানীয় চা দোকানি মো.কামাল উদ্দিন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি গত ১০ বছর ধরে চামড়া আনছি। ৮০-১০০টির নিচে কখনো আনিনি। এবার মাত্র ৩৪টি নিয়ে এসেছি। যারা কোরবানি দিয়েছেন, তারা যদি চামড়া না দেন, আমরা কিভাবে আনব ?’
আগ্রাবাদ মুহুরীপাড়া থেকে মাত্র ৬টি গরুর চামড়া নিয়ে এসেছেন কদমতলীর একটি বাস কাউন্টারের কর্মচারি মো.আলমগীর। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুরো এলাকায় ঘুরেছি। কেউ কেউ এত দাম বলছে, কিনতে পারিনি। আবার অনেকে বলছে, তারা এতিমখানায় চামড়া দিয়ে ফেলেছে, আমাদের কাছে বিক্রি করবে না।’
আগ্রাবাদ মুহুরীপাড়ার চামড়া সংগ্রহকারী দীন মোহাম্মদ ৩১টি গরুর চামড়া ও ৬টি ছাগলের চামড়া। দুপুর আড়াইটার দিকে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছর সকাল ১১টার দিক থেকে চামড়া আসতে শুরু করে চৌমুহনীতে। এবার চামড়া আসছে সাড়ে ১২টার পর থেকে। অন্যান্য বছর এতক্ষণে ৫-৭ হাজার চামড়া জমা হত। এখন তো এক হাজারও হয়নি।’
কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীদের ভাষ্য, এবার কোরবানির চামড়ার বাজারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে একাধিক সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। পাইকারি চামড়া ক্রেতা এবং আড়তদারের প্রতিনিধিরা মিলে এই সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। এদের মধ্যে বিভিন্ন এলাকার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী লোকজন আছেন। তারা কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় গিয়ে চামড়া সংগ্রহ শুরু করে। অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক কম দরদাম করায় কোরবানিদাতাদের অনেকেই এতিমখানায় চামড়া দান করেছেন। চামড়ার প্রত্যাশিত দাম না পাবার কারণে তারা কাঁচা চামড়া এতিমখানায় দিয়েছেন। সিন্ডিকেটের সদস্যরা এতিমখানা থেকে সরাসরি কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছেন।
আসকারাবাদ থেকে আসা চামড়া সংগ্রহকারী মো.আলাউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আড়তদাররা আমাদের কাছ থেকে সরাসরি চামড়া কিনতে পারে না। আমরাও তাদের কাছে সরাসরি চামড়া বিক্রি করতে পারি না। তিন-চার হাত ঘুরে আড়তে চামড়া যায়। এবার পাইকারদের সঙ্গে আড়তদারের এজেন্টদের একটা সিন্ডিকেট হয়েছে। তারা চায়, আমরা যারা একদিন শখের বশে চামড়ার ব্যবসা করি, আমরা যেন সেটা করতে না পারি। সেজন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তারা দাম পড়তির দিকে রেখেছে।’
‘চামড়া কম আসছে মানে কোরবানি কম হয়েছে, এমন নয়। সিন্ডিকেটের সদস্যরা দাম পড়তির দিকে রেখে নিজেরাই সেই চামড়ার বাজার দখলে নিয়েছে’ বলেন আলাউদ্দিন।
পটিয়ার জিরি থেকে চামড়া নিয়ে আসা মো.সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শখ করে কোরবানির চামড়া কিনে বিক্রি করি। এবার এলাকার ছেলেরাও চামড়া কিনছে। তারা সরাসরি আড়তে নিয়ে যাচ্ছে।’
এদিকে আড়তদারেরা এবার চট্টগ্রামে সাড়ে ৫ লাখ পিস গরুর চামড়া ও ৮০ হাজার পিস ছাগলের চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। তাদের ধারণা, চট্টগ্রামে এবার ৪ লাখ গরু, ১ লাখ ২০ হাজার ছাগল, ১৫ হাজারের মতো মহিষ এবং ১৫ হাজারের মতো ভেড়া কোরবানি দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার বাইরে এবার সরকার প্রতি বর্গফুট চামড়ার দর ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বড় গরুর প্রতিটি চামড়া সাধারণত ১৮ থেকে ২০ বর্গফুট হয়। ছোট গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৫ বর্গফুট পর্যন্ত হয়।
কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীদের অভিযোগ, প্রত্যাশিত চামড়া এবার তারা সংগ্রহ করতে পারেনি। আবার সংগ্রহ করা চামড়ার প্রত্যাশিত দামও তারা পাচ্ছেন না।
চৌমুহনীর দাইয়াপাড়া থেকে ৫টি গরুর চামড়া নিয়ে কর্ণফুলী মার্কেটের সামনে এসেছেন স্থানীয় একটি ভবনে প্রহরী মো.কামাল। ৬০ বছর বয়সী কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি প্রতি পিস গরুর চামড়া ৫০০ টাকা করে কিনেছি। এখানে আনার পর আমাকে দাম দিতে চাচ্ছে ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। এর উপরে দাম তুলছেই না। আড়তদারের এজেন্টদের সবার এক কথা, ৪০০ টাকার ওপরে চামড়া কিনবে না।’
‘গতবছরও আমরা চামড়া বেচে সেভাবে লাভ তুলতে পারিনি। কোনোমতে চামড়া বিক্রি করেছি। এবার যে অবস্থা, আমাদের লোকসান দিতে হবে বলে মনে হচ্ছে।’ বলেন কামাল
আগ্রাবাদ মুহুরীপাড়ার উত্তরা আবাসিক এলাকা থেকে ১৯টি গরুর চামড়া নিয়ে আসা আব্দুল হাকিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘৫০০ টাকার চামড়া কিনতে চাচ্ছে ৩৫০ টাকা। এর সঙ্গে রিকশা ভাড়া আছে। রিকশা ভাড়া বাদ দিলেও একটি চামড়ায় ১৫০ টাকা লস। এভাবে তো চামড়া বিক্রি করতে পারব না।’
তাদের মতে, কাঁচা চামড়ার দামের ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটের প্রভাব আছে। মূল পার্টি অর্থাৎ আড়তদারের কাছে সরাসরি চামড়া বিক্রি করতে গেলে তারা নগদে কিনতে চান না। চামড়া লবণ দিয়ে শুকিয়ে ট্যানারি মালিকের কাছে বিক্রির পর দাম দিতে চায়। অথবা প্রতিটি চামড়ার সর্বোচ্চ দাম দিতে চায় ২০০ টাকা।
মো. কামাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একদিনের ব্যবসা করি সেটা ঠিক। কিন্তু আমরাও তো টাকা খাটাই। লস দিয়ে তো পথে বসতে পারব না। সরকার নির্ধারিত দাম যদি হিসাব করা হয়, তা-ও তো একটি চামড়া আমাদের কাছ থেকে ৭০০ টাকায় কিনতে পারে। কিন্তু আড়তদার, তাদের প্রতিনিধি আর পাইকারদের চক্রের কাছে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি।’
দুপুর ২টার দিকে কর্ণফুলী মার্কেটের সামনে দেখা গেছে, ছাগল ও ভেড়ার চামড়া প্রতি পিস ২০ টাকা করে কিনতে চাচ্ছে পাইকারী ব্যবসায়ীরা। ছাগলের চামড়া নিয়ে আসা কদমতলীর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘৩০টি ছাগলের চামড়া বিক্রি করে লাভ করেছি মাত্র ৩০০ টাকা। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পরিশ্রম করে মাত্র ৩০০ টাকা ইনকাম করেছি। এর চেয়ে ছাগলের চামড়া ফ্রি দিয়ে আসলে ভালো হতো।’
কদমতলী এলাকার বাসিন্দা ফুটবলার মো.মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বাসায় ছাগল কোরবানি দিয়েছি। সেই চামড়া এলাকার ছেলেদের এমনিতেই দিয়েছি। কোনো টাকা নিইনি।’
চৌমুহনীতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে আসা আড়তদারের প্রতিনিধি আলী আকবর সারাবাংলাকে বলেন, ‘একদিনের ব্যবসায়ীরা যেভাবে যে দামে চামড়া কিনছেন, তাতে আমাদের পক্ষে চামড়া কেনা সম্ভব হবে কি না সেটাই ভাবছি। কারণ সরকারের দর হিসাব করে তো কাঁচা চামড়া কিনতে পারব না। আমাদের তো লবণ দেওয়ার পর ওই দামে বিক্রি করতে হবে।’
আড়তদাররা দুইদিন ধরে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করবেন। এরপর লবণ দিয়ে রোদে শুকিয়ে সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত শুরু হবে। তারপর ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করা হবে।
ছবি: শ্যামল নন্দী
সারাবাংলা/আরডি/একে