বিজ্ঞাপন

অনিশ্চয়তায় ভুগছেন নারী উদ্যোক্তারা

April 12, 2020 | 1:21 pm

তিথি চক্রবর্তী।।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বব্যাপী মন্দার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে দেশেও যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবে, সে কথা বলছেন অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই সংকটের আঁচে পুড়তে হবে কমবেশি সবাইকেই। এর মধ্যেও বিশেষভাবে বলতে হবে নারীদের কথা। কারণ মহামারির ইতিহাস বলে, যেকোনো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগে তাদেরই সবচেয়ে বেশি ধকল সামলাতে হয়। করোনাকালের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নেই তার।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাসে অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি আরও বেশি প্রকট হয়েছে এই ভাইরাসের আবির্ভাবের সময়টিকে ঘিরে। বাংলা নববর্ষ প্রায় চলেই এসেছে, ক’দিন পরেই ঈদুল ফিতর। এই দুইটি উপলক্ষকে ঘিরে আবর্তিত হয় দেশের অর্থনীতির সিংহভাগ। নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যেও যারা ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল পণ্য বা সেবা নিয়ে কাজ করছেন, তাদের ক্ষেত্রেও  প্রযোজ্য সেই একই কথা। এমনিতেই তাদের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। করোনা তাদের জন্য বাড়তি কী চ্যালেঞ্জ এনেছে— এমন প্রশ্ন নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন অনলাইনভিত্তিক নারী উদ্যোক্তার।

অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছেন ইসরাত জাহান তাতিয়া। গড়ে তুলেছেন অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘তাঁতী আর তাঁত’। তার ব্যবসা মূলত শাড়িকেন্দ্রিক। পহেলা বৈশাখ আর ঈদ— বছরের এই দু’টি সময়ে প্রচুর শাড়ি বিক্রি করেন। শুধু তাই নয়, সারাবছরের আয়ের একটি বড় অংশ এই দু’টো উৎসবের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এবছর পাল্টে গেছে সব হিসাব। উৎসবকে ঘিরে পরিকল্পনা, আনুষঙ্গিক কাজ ও অর্থ বিনিয়োগ করা যখন শেষ, ঠিক তখনই থমকে দাঁড়াতে হলো।

ইসরাত জাহান তাতিয়া বলেন, ‘ব্যবসায়িক এই ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে কত বছর লাগবে, জানি না। তবে কিছুটা আশা পাই যখন আমার নিয়মিত ক্রেতারা পাশে থাকার অঙ্গীকার দেন।’ প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছানোর আশাও এই মুহূর্তে দেখছেন না ইসরাত জাহান তাতিয়া।

বিজ্ঞাপন

‘হঠাৎ করে আসা সাগরের প্রকাণ্ড ঢেউ যখন সবকিছু তলিয়ে নিয়ে যায়, ঠিক তেমনই একটা কঠিন সময় পার করছি,’— বললেন অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘গুটিপা’র প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি।

মূলত চামড়াজাত পণ্য ব্যাগ ও জুতার জন্য গুটিপা পরিচিত। দীর্ঘদিনের গুছিয়ে আনা ব্যবসায় হঠাৎ করেই বড় ধাক্কা লেগেছে। তবে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক এই সংকটে এখন সুস্থ থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তাসলিমা মিজি।

বিজ্ঞাপন

শুধু তাই নয়, তার কথায় অন্যরকম একটি বার্তাও রয়েছে। বললেন, ‘আমরা প্রকৃতির ওপর অনেক অবিচার করেছি। মানবিকতা, মূল্যবোধ, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা সর্বোপরি জীবনের প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) কী হবে, তা আমরা ভুলেই গেছি। করোনার পর যারা নতুন পৃথিবীতে বাঁচবে, তারা নিশ্চয়ই সেই মূল্যবোধের শিক্ষাগুলো অর্জন করবে।’

করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পর প্রকৃতির কাছ থেকে নতুন শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করতে চান তাসলিমা মিজি। নিজের পণ্যগুলো যেন আরও পরিবেশবান্ধব উপায়ে তৈরি করা যায় সেই ব্যাপারে সজাগ থাকবেন— দিলেন সে প্রতিশ্রুতিও।

আরেক নারী উদ্যোক্তা লাখিয়া হাবিবা। দেশীয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘রসুইঘর’ এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। পহেলা বৈশাখে করোনা তার জন্যও বড় ধাক্কা বলে জানালেন।

লাখিয়া বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ আমার জন্য বড় ইভেন্ট। আমি যেহেতু পুরোপুরি দেশীয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিই, ফলে পহেলা বৈশাখে প্রচুর অর্ডার পাই। শাক, চচ্চড়ি, ভর্তা, গরুর মেজবানি, ইলিশ, পিঠা ও নানারকম দেশীয় খাবারের অর্ডার পাই। কিন্তু এবার পুরোপুরি বন্ধ।’

বিজ্ঞাপন

ক্রেতার চাহিদামতো খাবারের অর্ডার নেওয়া, এরপর বাজার করা, রান্না ও সময়মতো খাবার পৌঁছে দেওয়া— পুরো প্রক্রিয়ার তদারকিতে থাকেন লাখিয়া হাবিবা। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ পর্যায়ে  দু’টো ব্যাপার অত্যন্ত কঠিন বলে ব্যবসার কাজ পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হয়েছে তাকে। প্রথমত, রান্না করা খাবার পাঠানো, দ্বিতীয়ত, ক্রেতার জন্যও বাইরের খাবার সংগ্রহ করা এখন ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া বাজার করা, রান্নার জন্য সেগুলো প্রস্তুত করার ঝামেলা তো আছেই।

অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘রমনী’ এক্সওয়াইজেডের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আরমিন খান। তিনি বলেন, ‘আমার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ প্রায় ৫০০ নারী উদ্যোক্তা কাজ করেন। করোনার কারণে সবার কাজ বন্ধ আছে। তবে খরচ তো বন্ধ নেই। টাকার প্রয়োজন প্রতিদিনই হয়। অথচ আমরা এই নারীদের আর্থিক সুবিধা দিতে পারছি না।’

এই প্রতিষ্ঠানের সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ নারীরা বাসায় গিয়ে সৌন্দর্য সেবা দেন। করোনা পরিস্থিতিতে এই নারীদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না কেন— জানতে চাই  আরমিন খানের কাছে। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের নিজস্ব কর্মী নন। কেবল আমাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের মতো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। মাস শেষে তাদের কাছ থেকে আমরা নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন পাই। এখন আমাদের নিজেদেরই কোনো উপার্জন নেই।’

তবে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করলে এই সময় যৌথভাবে নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দেবেন বলে জানান আরমিন খান।

করোনাকালে নারী উদ্যোক্তাদের সমস্যা মোকাবিলার নানা দিক নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত। আলাপচারিতার শুরুতেই তিনি ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের লড়াই ও আত্মপ্রচেষ্টাকে তুলে ধরেন এভাবে, ‘ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড়— আমাদের সমাজে এই চার ধরনের নারী উদ্যোক্তা দেখা যায়। যারা বড় উদ্যোক্তা অর্থাৎ যাদের বেশি পুঁজি আছে, তারা সাধারণত উত্তরাধিকার সূত্রে তা পেয়ে থাকেন। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নিজের তাগিদে কাজ শুরু করেন এবং ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেন। ফলে যিনি যত বেশি ছোট, তিনি তত বেশি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।’

প্রত্যেক নারীর ‘উদ্যোক্তা’ হওয়ার পেছনে থাকে কঠিন এক বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার নাম ‘সংস্কৃতিগত বাধা’। নারীকে আমরা নির্দিষ্ট কিছু ভূমিকায় দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু সময় পালটে গেছে। বাধা অতিক্রম করা নারীরা এগিয়ে গেছেন, জয় করেছেন ক্রেতার মন। সেই নারীদের অগ্রযাত্রায় এবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা। এ পরিস্থিতি নারী উদ্যোক্তারা সামলাবেন কীভাবে— জানতে চাই আবুল বারকাতের কাছে।

তিনি বলেন, করোনাকালে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার বরাদ্দ অনুযায়ী, ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দিতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ রাখা হয়েছে। তবে ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনের ভিত্তিতে। এই ঋণ সুবিধা নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে আনুপাতিক হারে বেশি দিলে সামগ্রিকভাবে নারীরা যে সংকটে আছেন, তা থেকে উত্তরণের পথ খুলে যাবে। দ্বিতীয়ত, একেবারে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা যারা আছেন, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাও থাকতে পারে। তাদের কথা আলাদাভাবে ভাবতে হবে। অন্তত এই অংশের জন্য কিছু টাকা (হতে পারে ৫ হাজার কোটি টাকা) আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখা যেতেই পারে।

ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি রাষ্ট্রের বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক আবুল বারকাত। বলেন, ‘ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা দিন আনে দিন খায় এবং খানার মোট আয়ে তাদের অবদান অনেক। সেই সঙ্গে তাদের ঋণ ব্যবহারের ফলপ্রদতা অন্য উদ্যোক্তাদের তুলনায় বেশি। ফলে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়ন প্রভাব বেশি।’

‘এরই মধ্যে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে গেছেন। ফলে তাদেরকে উদ্ধারের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ খুবই জরুরি,’— মন্তব্য অধ্যাপক আবুল বারকাতের।

সারাবাংলা/টিসি/টিআর

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন