বিজ্ঞাপন

চিকিৎসকরা পেত না পিপিই, জেকেজির জন্য ‘আনলিমিটেড’

June 24, 2020 | 3:38 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরু হলে আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে চিকিৎসকদের কাছে পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) না পৌঁছানো। এই সময়ে বিভিন্ন কারণে ছিল পিপিই সংকট। এ কারণে হাসপাতালে ও রাজধানীর বাইরে স্থাপিত পিসিআর ল্যাবে চাহিদা অনুযায়ী পৌঁছানো যেত না পিপিই। আর তাই তাদের চাহিদাপত্রে কাঁটাছেড়া করে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পিপিই দেওয়া হতো। হাসপাতালের চাহিদাপত্রে কাঁটাছেড়া করলেও জেকেজি হেলথ কেয়ারের চাহিদাপত্রে কোনো রকম কাটাছেড়া না করেই দেওয়া হতো পিপিই। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) বরাবর পিপিইর জন্য আবেদন করলেও জেকেজির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আবেদন করা হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি পায় জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা (জেকেজি) হেলথকেয়ার। ১২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জেকেজির প্রস্তুতি দেখতে যান তিতুমীর কলেজে।

বুথের কাজ শুরু করার আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বরাবর পিপিই চেয়ে আবেদন করে জেকেজি হেলথ কেয়ার। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সমন্বয় কর্মকর্তা পরিচয়ে আরিফুল চৌধুরী স্বাক্ষরিত পত্রে দেখা যায় ১ হাজার ২০০ সেট পিপিই চায় প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া এক হাজার ২০০ পিস গগলস, ১ হাজার ২০০ জোড়া শু কাভার, ৩ হাজার পিস সার্জিকাল মাস্ক ও ৩ হাজার জোড়া সার্জিকাল গ্লোভস চায় প্রতিষ্ঠানটি। এই সকল কিছুই মহাপরিচালকের অনুমোদন ক্রমে জেকেজি হেলথকেয়ারের কাছে সরবরাহ করা হয়।

প্রায় একই সময়ে ১২ এপ্রিল মুগদা মেডিকেল কলেজে করোনা চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন অধ্যক্ষ ডা. শাহ গোলাম নবী স্বাক্ষরিত এক পত্রে পিপিই চাওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) বরাবর করা সেই আবেদন পত্রে ১০০টি কেএন/এন-৯৫ মাস্ক ও ২শ’টি গগলস চাওয়া হয়। কিন্তু সেই চাহিদাপত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে পিপিই সরবরাহ করা হয়নি। এই সময়ে চাহিদাপত্রের ওপরে ২৫ পিস ফেস মাস্ক, ১৫ পিস কেএন ৯৫ মাস্ক ও ২৫ পিস গগলস সরবরাহ করার অনুমতি দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

এর আগে ৩১ মার্চ রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এ কে এম নূরুন্নবীর সই করা এক পত্রে পিপিইর আবেদন জানানো হয়। আবেদনপত্রটি অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বরাবর করা হয়। এই আবেদন পত্রে রংপুর মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজী বিভাগে পিসিআর মেশিন অপারেটিং এর জন্য প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট/যন্ত্রপাতি চাওয়া হয়। এই সময় প্রতিষ্ঠানটিকে দেখা যায় ১০০ পিস এন-৯৫ মাস্ক ও ১০০টি পিপিই সরবরাহ করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলামের কাছে সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে সেই হিসেবে তাদের সরবরাহ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় শুধু ১২ এপ্রিলই নয় বরং কিছুদিন পরপরই এই প্রতিষ্ঠান থেকে এভাবে পিপিই সরবরাহ করা হতো। সরকারিভাবে এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিভিন্ন বুথে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হলেও তারা নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন বাসায় গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করতো। এ সময় এই পিপিইগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকতো বলেও অভিযোগ আছে।

তবে, ১৩ জুন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ৭ হাজার পিপিই সরবরাহ করার অনুরোধ করা হয়। এছাড়া ৫ হাজার গগলসসহ অন্যান্য সবকিছুই চাওয়া হয়। এ দিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম রিজওয়ানের কাছে পাঠানো হয় অতিরিক্ত মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে। জেকেজি হেলথকেয়ারের সাতটি বুথের কথা জানার পরে ডা. শামীম রিজওয়ান সেই পত্রে ১৪টি পিপিই, ১৪টি গগলস সরবরাহ করার সুপারিশ করেন। ১৪ জুন তাদের সেই হিসেবে পিপিই সরবরাহ করা হয় সিএমএসডি থেকে।

বিজ্ঞাপন

ডা. শামিম রিজওয়ানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের প্রস্তাব প্রথমবারের মতো আমার কাছে আসে। আর যেকোনো চাহিদা পত্রে আমাদের আসলে হিসেব করে দিতে হয় যে সেখানে আসলে কতজনের জন্য এই পিপিই চাওয়া হচ্ছে। সাতটা বুথে ১৪ জনের বেশি তো আসলে কেউ কাজ করার কথা না। তাই ১৪টাই লিখে দেওয়া হয়েছে।’

তবে পূর্বে তাদের কেনো আনলিমিটেড পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যেটা এসেছে সেটা আমি ক্রস চেক করে দিয়েছি। পূর্বের বিষয় বলতে পারি না।’

এ বিষয়ে করোনা-সংক্রান্ত সিএমএসডি ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বয়কারী ডা. সামিউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞাপন

এ দিকে জেকেজি হেলথকেয়ারকে এখন পর্যন্ত কত পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে এই তথ্য জানার জন্য সিএমএসডি’র ডেস্ক অফিসার (স্টোর) সাব্বির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ধরনের তথ্য দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। এটা পরিচালক মহোদয়ের অনুমতি ছাড়া আমি দিতে পারবো না।’

এ বিষয়ে সিএমএসডি পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামানের সঙ্গে তার কার্যালয়ে গিয়ে একাধিকবার দেখা করার চেষ্টা করলেও তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে জানা গেছে। মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে জেকেজি হেলথ কেয়ারের এই পিপিই সরবরাহের সময় সিএমএসডিতে পরিচালক হিসেবে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদ উল্লাহ। তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে সিএমএসডি’র সাবেক সহকারী পরিচালক ডা. মেজবাহর মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার কাছে যখনই তাদের চাহিদাপত্র এসেছে আমি তা যাচাই বাছাই করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেছি। সেখান থেকেই বাস্তবতার নিরিখে যাচাই বাছাই করে পিপিই সরবরাহ করা হয়ে থাকে। হ্যাঁ এটা আমিও শুনেছি যে তারা একদিন ৭ হাজার পিপিই’র চাহিদা দিয়েছিল। তবে সেটা যাচাই করে তাদের বাস্তবতার নিরিখে পিপিই দেওয়া হয়। তবে এর আগে যদি তারা অন্য কারও কাছ থেকে নিয়ে থাকে সে বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’

এদিকে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

দেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি দুই প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় নমুনা সংগ্রহের অনুমতি। তার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান ওভাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা তথা ‘জেকেজি হেলথকেয়ার’। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ নমুনা সংগ্রহের অনুমতি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির এবং সেটি করার কথা বিনামূল্যে। তবে সারাবাংলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে— প্রতিষ্ঠানটি নমুনা সংগ্রহ নিয়ে নানা ধরনের জালিয়াতিতে যুক্ত। জেকেজি হেলকেয়ারের এমন সব অনিয়ম-জালিয়াতি নিয়ে সারাবাংলার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্ব এটি। পঞ্চম পর্ব আসছে আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৫ জুন)।

প্রথম পর্ব: করোনা পরীক্ষা নিয়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রতারণার জাল
দ্বিতীয় পর্ব: অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ধমক দিয়ে কাজ করাত জেকেজি হেলথকেয়ার
তৃতীয় পর্ব: সরকারি খরচে বেসরকারি ‘প্রতারণা’ জেকেজি হেলথ কেয়ারের

সারাবাংলা/এসবি/এমআই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন