বিজ্ঞাপন

গর্ভপাত করাতে গিয়ে ‘হত্যা’, পরে করোনায় মৃত্যু বলে প্রচার

November 12, 2020 | 5:28 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চিকিৎসার নামে অবৈধ গর্ভপাত ব্যবসা চালিয়ে আসছিল চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার থানার চট্টেশ্বরী সড়কের বেসরকারি সিটি হেলথ ক্লিনিক। চিকিৎসকের বদলে নার্স দিয়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গর্ভপাত করানো হতো সেখানে। যাদের ছিল না কোনো ক্লিনিক পরিচালনার বৈধ অনুমতি। ছয়মাস আগে এভাবে গর্ভপাত করাতে গিয়ে এক কলেজ ছাত্রীর মৃত্যু হয় ওই ক্লিনিকে। কিন্তু ছাত্রীর অভিভাবকের কাছে তারা বিষয়টি গোপন রেখে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করে তারা।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা তদন্তে নেমে পুলিশ মৃত্যুর সঠিক রহস্য উদঘাটন করে। পরে বুধবার (১১ নভেম্বর) রাতে অভিযান চালিয়ে ক্লিনিকটি বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয় ক্লিনিকের মালিকসহ তিনজনকে। একই ঘটনায় এর আগে গ্রেফতার করা হয় ক্লিনিকের এক নার্সসহ দুজনকে।

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান বলেন, ‘মৃত কলেজ ছাত্রীর পরিবারকে ক্লিনিকের মালিক জানিয়েছিলেন, তার মেয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এমনকি বিভিন্নভাবে মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে দ্রুত দাফন করতেও বাধ্য করেন। কিন্তু এতে সন্দেহ হওয়ার পরবর্তী সময়ে তার বাবা একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।’

‘ওই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি, চিকিৎসার নামে ক্লিনিকে মূলত অবৈধ গর্ভপাত করানো হতো। এটাই ছিল তাদের মূল ব্যবসা। ক্লিনিক পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো অনুমোদন তাদের কাছে ছিল না। শুধুমাত্র তাদের কাছে একটি ট্রেড লাইসেন্স আছে। আমরা সিভিল সার্জনকে অভিযানে যাই এবং ক্লিনিকের মালিকসহ তিনজনকে গ্রেফতার করি। এ নিয়ে মোট পাঁচজন এই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে। ক্লিনিকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে’— বলেন এস এম মেহেদী হাসান।

বিজ্ঞাপন

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ সারাবাংলাকে জানান, ঘটনার শিকার ২৫ বছর বয়সী তরুণী নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় একটি বেসরকারি কলেজের বিবিএস শেষবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। ছোট বোনকে নিয়ে তিনি চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাসায় থাকতেন এবং আগ্রাবাদে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের কাজ করতেন। গত ১৫ মে ওই ছাত্রী ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার সংবাদ পায় তার পরিবার।

গ্রেফতার পাঁচজন হলেন- আবুল কালাম মো. সেজান (২৬), অলকা পাল (৩২), হারুন অর রশীদ (৬০), গীতা দাস (৪৫) ও সাবিনা ইয়াসমিন চম্পা (৪৩)।

বিজ্ঞাপন

নগর পুলিশের চকবাজার জোনের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ রাইসুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, গ্রেফতার সেজান ছিলেন মৃত কলেজ ছাত্রীর বন্ধু। হারুন ক্লিনিকের মালিক। অলকা ও চম্পা নার্স হিসেবে ওই ক্লিনিকে কর্মরত ছিলেন। গীতা দাস ক্লিনিকের আয়া। সেজানকে গত মে মাসে মামলা দায়েরের পরই গ্রেফতার করা হয়। সেজান আদালতে জবানবন্দি দেন। সেই সূত্রে বুধবার (১১ নভেম্বর) গ্রেফতার করা হয় অলকাকে। তিনিও আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন এবং বিস্তারিত বর্ণনা দেন। মূলত তার জবানবন্দির ভিত্তিতেই বুধবার রাতে ক্লিনিকটিতে অভিযান চালিয়ে বাকি তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।

মৃত কলেজ শিক্ষার্থী ছোট বোন সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর গত ১০ মে আমি বাড়ি চলে যাই। ১৪ মে আমার বোনের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন তাকে আর মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরদিন বিকেল চারটার দিকে আমি মোবাইলে কল করলে সেজান ভাই ধরেন। তিনি আমার আপুর সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের কাজ করতেন। সেজান ভাই জানান, আমার আপু করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। একথা শোনার পর আমার বাবা ও মা হাসপাতালে আসেন।’

ওই কলেজ ছাত্রীর বাবা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্লিনিকে যাবার পর অলকা নামে এক মহিলা জানায়, আমার মেয়ে আগেরদিন বিকেলে ক্লিনিকে ঢুকে আমাকে বাঁচান, বাঁচান বলে চিৎকার দিয়ে পড়ে যান। এরপর তার আর পালস পাওয় যায়নি। সেই অবস্থাতেই নাকি সে মারা গেছে। সে করোনায় আক্রান্ত ছিল বলে আমাদের জানানো হয়। এরপর ক্লিনিকের মালিক এসে আমাকে দ্রুত মৃতদেহ গ্রামে নিয়ে দাফন করে ফেলতে বলেন। আমাকে কোনো ডেথ সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়নি। আমি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে মৃতদেহ নিয়ে যাই। করোনা শুনে লোকজন কেউ ভয়ে কাছেও আসেনি। দাফনের সময় তার মাথার পেছনে থ্যাতলানো এবং হাতে জখম দেখি। এতে আমার সন্দেহ হয়।’

তিনি অভিযোগ করেন, ১৫ মে লাশ দাফন করা হয়। ২৬ মে তিনি মামলা করার জন্য চকবাজার থানায় আসেন। প্রথমে মামলা নেওয়া হয়নি। তাকে পাঠানো হয় চান্দগাঁও থানায়। সেখান থেকে পাঠানো হয় পাঁচলাইশ থানায়। সেখানেও মামলা না নেওয়ায় তিনি সরাসরি চলে যান তৎকালীন সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমানের কাছে। তার নির্দেশে পরে হত্যা মামলা নেওয়া হয় চকবাজার থানায়।

বিজ্ঞাপন

চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমীন সারাবাংলাকে জানান, অপু ও সেজান নামে মেয়েটির দুই বন্ধুকে আসামি করে মামলা করে তার বাবা। মামলা দায়েরের পর আদালতের নির্দেশে মৃতদেহ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়। ২৬ মে মামলা দায়েরের পরই সেজানকে গ্রেফতার করা হয়। তবে মৃত্যুর ঘটনায় অপুর কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। সেজান জবানবন্দিতে জানান, মেয়েটিকে গর্ভপাত করানের জন্য তিনিই সিটি হেলথ ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে মারা যাওার পর ক্লিনিকের মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা করোনায় মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করেন। এরপর অ্যাম্বুলেন্সের চালককে শনাক্ত করে সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি নেওয়া হয়।

ওসি রুহুল আমীন বলেন, ‘তদন্তে আমরা তথ্য পাই, নার্স অলকা ও চম্পা, আয়া গীতা দাসের সহযোগিতায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মেয়েটির গর্ভপাতের চেষ্টা করে। কোনো ডাক্তার ছিলেন না। এই গর্ভপাত করাতে গিয়ে মেয়েটির শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় এবং তার মৃত্যু হয়। এই তথ্য পেয়ে আমরা প্রথমে অলকাকে গ্রেফতার করি। অলকা জবানবন্দিতে সব স্বীকার করে। পরে তার তথ্যের ভিত্তিতে ক্লিনিকে অভিযান চালানো হয়।’

উপ-পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্লিনিকটিতে অভিজ্ঞ কোনো ডাক্তার নেই। রাতে সেখানে কোনো ডাক্তারই থাকে না। যাদের নার্স বলা হচ্ছে, তাদেরও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। সিভিল সার্জন আমাদের জানিয়েছেন, শুধুমাত্র ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে তারা কীভাবে ক্লিনিক পরিচালনা করেছে, সেটা তিনি খতিয়ে দেখবেন। এছাড়া তারা কোনো রোগীর তথ্যও সংরক্ষণ করে না। মূলত অবৈধ গর্ভপাত তাদের কাজ। এজন্য রোগীর কোনো তথ্য রাখে না তারা।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন