বিজ্ঞাপন

ফসলের মাঠে ‘হলুদ আলপনা’য় কৃষকের মুখে হাসি

December 31, 2020 | 8:11 am

কামরুল হাসান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

সাতক্ষীরা: বিঘার পর বিঘা ছিল সবুজ জমিন। সবই ফসলি মাঠ। তবে শীত তার চাদর বিছিয়ে দিতে না দিতেই সেই সবুজ উধাও। যতদূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ জমিনজুড়ে কেবল হলুদ আর হলুদ। মনে হয়, কেউ হলুদ বরণ আলপনা দিয়ে ঢেকে রেখেছে এই প্রান্তর। তবে সেই হলুদ বরণে আপত্তি নেই কৃষকদের। বরং ক্ষেতজুড়ে সরিষার এমন ফুলের মেলায় কৃষকের চোখে হাসির ঝিলিক খেলে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সাতক্ষীরার কয়েকটি উপজেলায় এমনই দৃশ্য এখন ফসলের মাঠজুড়ে। প্রান্তরজুড়ে উঁকি দিচ্ছে শীতের শিশির ভেজা সরিষা ফুলের দোল খাওয়া গাছগুলো। সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুল শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকিমিকি করছে। যেন প্রকৃতিকন্যা সেজেছে ‘হলুদ বরণ সাজে’। চির সবুজের বুকে এ যেন কাঁচা হলুদের আলপনা। মনে হয় পৃথিবী বুঝি তার রঙ হারিয়েছে। শুধু কালের বিবর্তনে হলুদ রঙটাই এখনো টিকে আছে। আর তার সঙ্গে এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে সরিষা ফুলের মৌ মৌ গন্ধ।

মূলত গত কয়েক বছর ধরেই সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ ফসলের প্রান্তরে শীতের মৌসুমে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষার আবাদে চাষিরা ধারাবাহিকভাবে লাভবান হতে থাকায় তারা এই ফসলটি চাষে ঝুঁকে পড়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেলা কৃষি কার্যালয় আট হাজার ৯০৪ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এই জেলায়। তবে সাতক্ষীরায় সরিষা চাষ লাভজনক ফসল হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চাষ হয় ৯ হাজার ৯০৪ হেক্টর জমিতে। পরবর্তী সময়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আগের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়েও ২৬ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ বেশি হয়। ওই বছর মোট চাষাবাদ হয় ৯ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে।

বিজ্ঞাপন

২০১৯-২০ অর্থবছরে আরও বাড়ে সরিষার আবাদ। আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় কয়েকশ হেক্টর জমিতে আবাদ বেড়ে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার চাষাবাদ হয়। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে অবশ্য এই পরিমাণ বেশ খানিকটা কমেছে। প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ কমে গিয়ে এবারে ৯ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করছেন কৃষকরা।

বিগত বছরের তুলনায় এ বছর চাষাবাদ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে অসময়ের বৃষ্টি, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন কারণকে দায়ী করছে কৃষি বিভাগ। এ বছর সরিষার চাষাবাদ কম হলেও কলারোয়া, সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায়, কৃষকদের আবাদ করা জাতের মধ্যে রয়েছে বারি ৯, ১৪, ১৫ ও ৪, টরি-৭ ও স্থানীয় জাত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হচ্ছে বারি-১৪ ও ১৫ জাতের সরিষার চাষ।

বিজ্ঞাপন

নানা কারণে আবাদ কম হলেও শেষ মুহূর্তে এসে অনুকূল আবহাওয়া পাওয়ায় এবার ভালো ফলনের আশা করছেন কৃষকরা। সদর ও আশাশুনি উপজেলার কয়েকজন কৃষক বললেন, এ বছর অসময়ে বৃষ্টি হওয়ার কারণে অনেকেই আবাদ করতে পারেনি। তবে আমরা যারা আবাদ করেছি, আশা করছি ফলন ভালো হবে, আমরাও লাভের মুখ দেখব। বাকি সময়টুকুতে বড় কিছু না ঘটলে এবার গত বছরের চেয়েও ভালো ফলন আশা করছি।

স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, সাতক্ষীরায় গত কয়েক বছর ধরে সরিষা চাষে লাভের মুখ দেখায় অনেকেই এই ফসলটি আবাদ করতে উৎসাহিত হয়েছেন। কেউ কেউ সরিষার বীজ তৈরি করেও লাভবান হচ্ছেন।

এবার সাতক্ষীরা জেলায় মোট ৯ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে জানা গেল, চলতি রবি মৌসুমে হেক্টর প্রতি ১৩৫ মেট্রিক টন ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সে হিসাবে জেলার সাত উপজেলার এক লাখ ৮০ হাজার ৫৪০ জন কৃষকের ১১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৫২৫ মেট্রিক টনে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে তিন হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে চার হাজার ৯৯৫ মেট্রিক টন, কলারোয়ায় পাঁচ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে সাত হাজার ৪৩৯ মেট্রিক টন, তালায় ৪৬০ হেক্টর জমিতে ৬২১ মেট্রিক টন, দেবহাটায় এক হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে এক হাজার ৫২৫ মেট্রিক টন, কালিগঞ্জে ৪৫০ হেক্টর জমিতে ৬০৮ মেট্রিক টন, আশাশুনিতে ১৯০ হেক্টর জমিতে ২৫৬ মেট্রিক টন ও শ্যামনগরে ৬০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষে ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮১ মেট্রিক টন।

তবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি পাঁচ উপজেলায়। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে তিন হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে হচ্ছে সরিষার আবাদ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৮০ হেক্টর কম। কলারোয়াতে আবাদ হচ্ছে তিন হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক হাজার ৮১০ হেক্টর কম। এছাড়া দেবহাটায় ৯৫০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮০ হেক্টর কম; কালিগঞ্জে ৩৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫০ হেক্টর কম এবং শ্যামনগরে ৫৫ হেক্টর জমিতে এবার সরিষার চাষ হয়েছে, যা কৃষিবিভাগের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পাঁচ হেক্টর কম।

বিজ্ঞাপন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানাচ্ছে, তবে জেলার সাত উপজেলার মধ্যে বাকি দুই উপজেলা— তালা ও আশাশুনিতে কৃষি বিভাগের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ীই সরিষার আবাদ হয়েছে।

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (খামারবাড়ি) সাতক্ষীরার উপপরিচালক নুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এ বছর জেলায় সরিষা চাষে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। তবে একদিকে করোনার সংক্রমণ, অন্যদিকে চলতি বছরে বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে কৃষকদের মূলধন কমে যাওয়ায় ৯ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষাবাদ হয়েছে। তবে অল্প সময়ে উচ্চ ফলনশীল সরিষা চাষে বেশি ফলন পাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে সরিষা চাষ নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। ফলে দিনে দিনে লাভজনক ফসল হিসেবে সরিষার কদর বেড়েছে জেলার কৃষকদের কাছে।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন