বিজ্ঞাপন

চাল আমদানিতে বিলম্বের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা বলছেন ‘এলসি’ জটিলতা

January 23, 2021 | 7:59 pm

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: চালের বাজারের লাগাম টেনে ধরতে বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করতে তাদের বিরুদ্ধে বিলম্বের অভিযোগ উঠেছে। চাল আমদানিতে সরকার শর্ত সাপেক্ষে সময় বেঁধে দিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেকেই চাল বাজারে আনতে পারেনি। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, রাজস্ব বোর্ডের কোড জটিলতায় এলসি ওপেনে দেরি হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে বাজারে চালের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে আগামী বোরো ফসল ওঠা পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির দরকার হবে বলে সরকারের নীতি নির্ধারকরা জানিয়েছেন। তবে তারা এও বলছেন, আমদানি করা চাল ব্যাপক পরিমাণে বাজারে এলে দাম কমতে থাকবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য মজুত আছে ৭ দশমিক ২১ লাখ মেট্রিক টন (গত ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত)। এর মধ্যে চাল ৫ দশমিক ৩৭ লাখ মেট্রিক টন এবং গম ১ দশমিক ৮৪ লাখ মেট্রিক টন। আর চলতি আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ গত ৪১ হাজার ৬২৪ মেট্রিক টন (১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত)। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৯২৪ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল, ১ হাজার ৪৬৭ মেট্রিক টন আমন আতপ চাল এবং ৩ হাজার ৩৬১ মেট্রিক টন আমন ধান। এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী ফসল (এপ্রিল- মে) অর্থাৎ বোরো ধানের চাল বাজারে না আসা পর্যন্ত আমদানির বিকল্প দেখছে না সরকার। সে লক্ষ্যে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে শুল্ক কমিয়ে দ্রুত চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, গত ৩ থেকে ১০ জানুয়ারির মধ্যে আবেদন করা প্রায় তিনশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিমাণ ভেদে পর্যায়ক্রমে তাদের এক মাসের মধ্যে চাল আমদানির শর্ত দেওয়া হয়। কিন্তু অনুমতি নিলেও বেশিরভাগ আমদানিকারক ঋণপত্র (এলসি) খোলাসহ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু করেননি বলে সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আর টেন্ডারের মাধ্যমে যারা চাল দিচ্ছে তাদের পাশাপাশি অনেক আমদানিকারকের চাল হিলি স্থলবন্দরের কাছে সীমান্তে এসে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

আরও জানা গেছে, চাল আমদানির জন্য কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের একটা কোড থাকে। সেটাকে এসএস কোড বলে। যার মাধ্যমে ২৫ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে চাল ছাড়াতে হয়। সেই কোড পরিবর্তনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে।

যশোরের বেনাপোল বন্দর দিয়ে চাল আমদানি করেন ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কাস্টমসের নিয়মের কারণে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সে সমস্যার সমাধান হচ্ছে। এতে চাল খালাসে আর অসুবিধা হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি পাঁচ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন পেয়েছি। আমরা সাধারণত আগে চাল কিনি, তারপর এলসি ওপেন করি। এতে বাজারে দ্রুত চাল পৌঁছানো যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বাজার থেকে চাল কিনেছি ১০ দিন আগে। এখন দুয়েকদিনের মধ্যে এলসি খুলব। তবে ভারতের বাজারে হঠাৎ করে মোটা চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের বাজারে লোকসান না হলেও লাভের মুখ দেখা যাবে না।’

বিজ্ঞাপন

বেসরকারি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকার টেন্ডারের মাধ্যমে আড়াই লাখ টন চাল আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সে প্রক্রিয়া এখনো চলছে। যদিও খাদ্য সচিব নাজমানারা খানুম বলেছেন, ‘আমদানি করা চাল দ্রুত বাজারে আসবে। সবাই মিলে কাজ করছেন। আমদানি করা চাল বাজারে এলে দাম আরও কমে যাবে।’

এদিকে সরকারি ও বেসসরকারি উভয় পর্যায়ে চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হলেও খুচরা বাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। ঢাকার বাজারগুলোতে মোটা চাল প্রতিকেজি ৪৪ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হলেও ঢাকার বাইরে পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি এক থেকে দুই টাকা দাম কমেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

দেশের পাইকারি চালের প্রধান দুই এলাকা নওঁগা ও কুষ্টিয়ায় ধান এবং চালের সরবরাহ কমেছে। সেখানে বেচাকেনাও কম। নওগাঁ ও কুষ্টিয়া জেলার হাট ও মোকামগুলোয় প্রতি মণ মোটা চালের ধান ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে ১১শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বুধবার (২০ জানুয়ারি) কুষ্টিয়ার বাজারে আটাশ চাল বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা, মিনিকেট ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা, কাজল লতা ৫৩ টাকা থেকে ৫৫ টাকা, স্বর্ণা ৪১ টাকা, বাসমতি ৬২ টাকা এবং চিনিগুড়া চাল স্পেশাল ৮৮ ও নরমাল ৭০ টাকা। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ধানের দাম বাড়তি বলে চালের দাম কমছে না।

চালের অন্যতম পাইকারি বাজার নওগাঁর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে গত এক সপ্তাহ ধরে ধানের দাম মণপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা ওঠানামা করছে। তবে একমাস ধরে চালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় চালের সরবরাহ কম। প্রায় দুই মাস ধরে সরকারের খাদ্যবান্ধব সহায়তা কর্মসূচির অনেকগুলো বন্ধ। সেজন্য বাজারে মানুষের চাপ পড়ছে। বাজারে সরবরাহ কম থাকায় চালের দামও বেড়েছে। তাছাড়া ধানের দাম কমছে না, বরং বাড়ছে। তাহলে দাম কীভাবে কমবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবারের বাজার পরিস্থিতির কারণে আমরা আশানুরূপ বোরো সংগ্রহ করতে পারিনি। আবার আমনের ক্ষেত্রে তো চুক্তি করতেই অনেকে সাহস পায়নি। কারণ বাজার দরের সঙ্গে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের সমন্বয় ছিল না। এ কারণে এবার ৩৪ হাজার চালকল বন্ধ রয়েছে। আর কিছু সংখ্যক চালকল খোলা রয়েছে। তারাই প্রোডাকশন করছে।

তিনি জানান, আড়ৎ থেকে রিটেইলার এই মাঝপথে চালের দাম বাড়ে। সরকার গঠিত মনিটরিং টিম রয়েছে। তাদের আরও বেশি অ্যাক্টিভিটি থাকা উচিত। তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীরা এই সিন্ডিকেট করতে পারে না।

উল্লেখ্য, এবার একদিকে করোনাভাইরাস, অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও দফায় দফায় বন্যার কারণে সরকারকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি চালু রাখতে হয়েছে। ফলে খাদ্যশস্যের মজুত তলানিতে নেমেছে। এছাড়া এবার সরকারের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো সংগ্রহ করতে পারেনি। প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টনের টার্গেট নির্ধারণ করে অর্ধেক ফসলও সংগ্রহ করা যায়নি।

এদিকে চলমান আমন মৌসুমও শেষের পথে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার এক তৃতীয়াংশও সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্য অধিদফতর। ফলে চাল আমদানিতে জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাজার পরিস্থিতি আর এনবিআরের জটিলতায় বেসরকারিভাবে আমদানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে আমদানিকারকরাই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কুষ্টিয়ার সাংবাদিক শরীফ বিশ্বাস]

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন