বিজ্ঞাপন

দুদকের ‘ভুলে’ অপরাধ না করেও ১৫ বছরের সাজার মুখে!

January 27, 2021 | 12:23 am

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নোয়াখালী জজ কোর্টের কর্মচারী কামরুল ইসলাম। বাবা মো. আবুল খায়ের। গ্রাম নোয়াখালী সদর উপজেলার সুধারামপুর থানার পূর্ব রাজারামপুর। কোনো ধরনের অপরাধ না করেও এক মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। তার কারণ, প্রকৃত অপরাধীর নামও কামরুল ইসলাম, বাবার নামও একই— আবুল খায়ের। জেলা, উপজেলা পর্যন্ত এক। তবে অপরাধী কামরুলের বাড়ি পশ্চিম রাজারামপুরে। এই পূর্ব ও পশ্চিমের পার্থক্য ধরতে না পারার কারণেই পশ্চিম রাজারামপুরের কামরুলের জায়গায় পূর্ব রাজারামপুরের কামরুলের মাথার ওপর ঝুলছে ১৫ বছরের সাজার খড়গ।

বিজ্ঞাপন

বিষয়টি নিয়ে শেষ পর্যন্ত কামরুল উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হলে দুদক তাদের ‘ভুল’ স্বীকার করেছে। দুদক বলছে, গ্রামের নামেও মিল থাকায় পূর্ব ও পশ্চিমের পার্থক্য করতে না পারায় তাদের ভুলটি হয়েছে ‘সরল বিশ্বাসে’। অথচ তাদের এই ‘সরল বিশ্বাসে’র কারণে ১৫ বছরের শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল কামরুলকে।

ভুক্তভোগী কামরুল ইসলামের আইনজীবী জানিয়েছেন, তারা আদালতের কাছে দুদকের ভুলের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দাবি করবেন। একইসঙ্গে ক্ষতিপূরণও চাইবেন। যদিও দুদক আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে— এই আদেশের অধীনে দায়িত্ব পালনের সময় সরল বিশ্বাসে কোনো কাজ করা হলে তার ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে এর জন্য কমিশন, কোনো কমিশনার বা কমিশনের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনি কার্যধারা গ্রহণ করা যাবে না।

আগামী বৃহস্পতিবার (২৯ জানুয়ারি) বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

এর আগে, দুদকের একই ধরনের ‘সরল বিশ্বাসে’র তদন্তের জেরে ১ হাজার ৯২ দিন জেল খেটে মুক্তি পান নিরাপরাধ পাটকল শ্রমিক জাহালম। ২০১৯ সালে জাহালমের সাজা খাটার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে তা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। উচ্চ আদালত জাহালমকে মুক্তির আদেশ দেওয়ার সময় দায়িত্বহীনতার জন্য দুদককে তিরস্কার করেছিলেন।

দুদকের তদন্তে একই ধরনের ভুলের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে হয়রানির শিকার নোয়াখালীর কামরুল ইসলাম হাইকোর্টে রিট করার পর। দুদক আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়ে বলেছে, মামলা তদন্তের সব পর্যায়েই তাদের ভুল হয়েছে।

এ বিষয়ে রিটকারীর আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, নোয়াখালী সদর উপজেলার সুধারামপুর থানার পশ্চিম রাজারামপুরের আবুল খায়ের কামরুল ইসলাম এসএসসি পরীক্ষার মার্কশিট জাল করে ১৯৯৮ সালে নোয়াখালী পাবলিক কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তার কলেজের ভর্তি ফরমেও গ্রামের নাম পশ্চিম রাজারামপুর লেখা আছে। কিন্তু এ কারণে ২০০৩ সালে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো পূর্ব রাজারামপুরের কামরুল ইসলামের (যার জন্ম ১৯৯০ সালে) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। আর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত ব্যক্তি হলো পশ্চিম রাজারামপুরের কামরুল ইসলাম (যার জন্ম ১৯৭৭ সালে)।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ওই মামলায় প্রায় ১০ বছর পর ২০১৩ সালে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। সেখানেও অভিযুক্ত কামরুল ইসলামের ঠিকানা পশ্চিম রাজারামপুর লিখেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর মামলা যুক্তিতর্কের (ট্রায়াল) আগে তারা প্রথম এসে জানায়, আসামির ঠিকানা ভুল হয়েছে।

মিনহাজুল হক চৌধুরী বলেন, নিরাপরাধ কামরুল ইসলাম বাবার চাকরির সুবাদে ১৯৯৪ সালের দিকে সপরিবারে লক্ষ্মীপুরে চলে যান। সেখানে ২০০৮ সালে লক্ষ্মীপুর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের সহকারী হিসেবে চাকরি পান কামরুল। পরে ২০১৯ সালে ২৯ জানুয়ারি তিনি নোয়াখালীতে বদলি হয়ে আসেন। গত বছর কামরুলের বিরুদ্ধে পরোয়ানার জারির আদেশ নিয়ে পুলিশ তাকে খুঁজতে নোয়াখালী পূর্ব রাজারামপুর গ্রামে যায়। তখন কামরুল বিষয়টি জানতে সংশ্লিষ্ট আদালতে খোঁজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে ১৫ বছর সাজা হওয়ার তথ্য জানতে পান। তখন ‍নিরাপরাধ কামরুল সাজা থেকে মুক্তিপেতে গত বছরের নভেম্বরে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন।

পরে ২০২০ সালে ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে এ বিষয়ে প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন আদালত রুল জরি করেন। পাশাপাশি আদালতে একটি অন্তুর্বতীকালীন একটি আদেশ দেন। ওই আদেশে আদালত পূর্ব রাজারামপুরের কামরুলকে ওই পরোয়ানা মূলে গ্রেফতার বা হয়রানি না করতে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাকে রিট আবেদনকারীর পরিচয়ের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত। ওই আদেশের পর প্রতিবেদন দাখিল করতে দুদক কয়েকবার সময় নিয়েছে। পরে গত ২৪ জানুয়ারি প্রতিবেদন দিয়ে দুদক বলেছে, তারা ‘সরল বিশ্বাসে’র বশে ‘ভুল’ করেছেন।

রিটকারীর আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দুদকের তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তি চাইব। একইসঙ্গে ভুক্তিভোগী কামরুলে জন্য ক্ষতিপূরণ চাইব।’

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান সারাবাংলাকে বলেন, আমরা আদালতকে বলেছি,

আমরা পুরো ঘটনাটি তুলে ধরেছি। গ্রামের নামে সামঞ্জস্যের কারণে আসল অপরাধীর পরিবর্তে ভুল ব্যক্তির নামে প্রতিবেদন এসেছে। এটা আমাদের ভুল হয়েছে। আমাদের ‘সরল বিশ্বাসে’ এ ভুল হয়েছে।

প্রকৃত অপরাধীর সাজা চাইবেন কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে দুদকের এই আইনজীবী বলেন, আমরা অবশ্যই সাজা চাইব। তবে তার আগে আদালতের আদেশের জন্য অপেক্ষা করব। কারণ আদালত এখন এ বিষয়ে একটি আদেশ দেবেন। সে রায়ের অপেক্ষায় আছি।’

দুদক সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় জড়িত প্রকৃত যে অপরাধী, সেই কামরুলের জন্ম ১৯৭৭ সালে। ঘটনার পর তিনি বিদেশে চলে যান। তবে বছর দুয়েক আগে পশ্চিম রাজারামপুর গ্রামের নিজ ঠিকানায় ফিরেছেন। এখন তিনি সেখানেই আছেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০৩ সালের সালের জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কুমিল্লা অঞ্চলের প্রসিকিউটিং পরিদর্শক মো. শহীদুল আলম একটি এজাহার দায়ের করেন। মামলায় বলা হয়, নোয়াখালী সদর থানার পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের আবুল খায়েরের ছেলে কামরুল ইসলাম নোয়াখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৫৭৬ নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাশের জাল/ভুয়া মার্কশিট ও প্রশংসাপত্র সৃজন/সংগ্রহ করে ১৯৮৯-৯৯ সেশনে মাইজদী পাবলিক কলেজে ভর্তি হন।

মামলাটির তদন্ত করেন দুর্নীতি দমন কমিশন নোয়াখালীর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মাহফুজ ইকবাল। পরে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি এই মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন। মামলার বিচার শেষে নোয়াখালীর বিশেষ জজ শিরীন কবিতা আখতার ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর রায় দেন। রায়ে কামরুল ইসলামকে পেনাল কোডের ৪৬৭ ধারায় ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, ৪৬৮ ধারায় ধারায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং ৪৭১ ধারায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন।

রায়ে বলা হয়, সব কারাদণ্ড একসঙ্গে চলবে, কিন্তু অর্থদণ্ড পৃথক পৃথকভাবে পরিশোধ করতে হবে। অনাদায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

সরাবাংলা/কেআইএফ/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন