বিজ্ঞাপন

উঁচু হচ্ছে হিল? ধরে নিন অর্থনৈতিক সংকট কাটছে না শিগগিরই

April 9, 2021 | 9:24 pm

রাজনীন ফারজানা

জুতার হিলের উচ্চতা যত বাড়ে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিধারা তত নিম্নমুখী হয়! শুনলে মনে হতে পারে, হাই হিল জুতা কিনতে কিনতেই বুঝি মানুষ ফতুর হয়ে যায়। আর তার প্রভাবেই অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি তেমন নয়। কিছু কিছু ব্র্যান্ডের জুতার দাম আকাশছোঁয়া, তাতে ভুল নেই। তবে হিল জুতার দামের সঙ্গে অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক ওই অর্থে নেই। এটি এমন একটি তত্ত্ব যেখানে কোনো জনগোষ্ঠীর নারীরা যে হিল পরিধান করছেন, সেই হিলের উচ্চতার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস-বৃদ্ধির সম্পর্ক খুঁজে বের করে!

বিজ্ঞাপন

না, নিছক কথার কথা না। রীতিমতো গবেষণা করে এ বিষয়টি বের করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার অধ্যাপক ড. ইনসুক আন। নিউ মেক্সিকো স্টেট ইউনিভার্সিটর ফ্যামিলি অ্যান্ড কনজ্যুমার সায়েন্স বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপক ২০১৫ সালে বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল বিষয়ক ম্যাগাজিন আমেরিকান ভোগের ফ্যাশন সম্পাদনা বিভাগ বিশ্লেষণ করে তিনি এই গবেষণা চালান। এর উদ্দেশ্য ছিল বেকারত্ব ও মন্দার মতো ম্যাক্রো অর্থনীতির নানা সূচকের সঙ্গে হিলের উচ্চতার সম্পর্ক খুঁজে দেখা। আর ড. ইনসুকের সেই গবেষণা বলছে, মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যখন কমেছে, ঠিক সেরকম সময় বেড়েছে জুতার উচ্চতা!

আবার ২০১১ সালে হাফিংটন পোস্টে তারা কেলির এক আর্টিকেলে হাই হিলকে অর্থনৈতিক অবস্থার নতুন নির্দেশক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কেলি বলছেন, প্রকৃতপক্ষে হাই হিল অর্থাৎ জুতা ফ্যাশনের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। আর ফ্যাশনের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে অর্থনীতি। আর সেই সম্পর্ক খুঁজে বের করেছেন আইবিএমের (ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিন করপোরেশন) বিশেষজ্ঞরা।

ওই নিবন্ধে বলা হয়, আইবিএমের গবেষকরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেন। তাতে দেখা যায়, হিলের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো অর্থনৈতিক অবস্থা পড়তির দিকে। আর ফ্ল্যাট জুতা ও কিটেন হিলের (ছোট্ট হিল) ব্যবহার বাড়তে থাকার অর্থ হলো অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

আইবিএমের ভোক্তা বিশেষজ্ঞ ট্রেভর ডেভিসের মতে, অর্থনীতির চাকা যখন নিম্নমুখী তখন, হিলের উচ্চতা বেড়ে যায়। এর কারণ হিসেবে তিনি ভোক্তাদের বাস্তবতা থেকে মুখ লুকিয়ে থাকার প্রবণতার কথা তুলে ধরেন। বলেন, অতিরিক্ত সাজসজ্জার মাধ্যমে মানুষ একধরনের কাল্পনিক জগতের মধ্যে ডুবে থাকতে চায় এবং রূঢ় বাস্তবতা থেকে পালিয়ে স্বস্তি খুঁজতে চায়।

এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ শতাব্দীর প্রথম দশকে হানা দেওয়া মহামন্দার উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক সংকট যখন চরমে, তখন নারীদের হিলের গড় উচ্চতা মোটামুটি সাত ইঞ্চি পর্যন্ত পৌঁছেছিল। আবার মন্দা কাটিয়ে যখন অর্থনীতিকে ইতিবাচক ধারা ফিরছিল, তখন ২০১১ সালের দিকে মেয়েদের জুতার সেই উচ্চতা নেমে আসে দুই ইঞ্চিতে।

হিলের গড় উচ্চতা কমে আসার পেছনে নারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা বা অন্য কারণও থাকতে পারে। কিন্তু ফ্যাশনের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক একেবারেই নতুন নয়। বরং যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দার মতো ঘটনাগুলো যখন পৃথিবীতে ঘটেছে, তার প্রত্যক্ষ প্রভাব সবসময়ই পড়েছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে।

বিজ্ঞাপন

এ তো গেল নিকট অতীতের কথা। কিন্তু বর্তমান সময় কী বলছে? দীর্ঘদিন ধরেই হাই হিল জুতা ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ। এই যে বিশ্বজুড়ে একবছরেরও বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ, এর মধ্যে আরামদায়ক অ্যাথলেইজার ও স্নিকারের চাহিদা বাড়লেও উঁচু হিলের আবেদন কিন্তু কমেনি। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আরেকটু পরিবর্তন লক্ষণীয়। হাই হিল বলতেই স্টিলেটো (চিকন হিলের উঁচু জুতা) বেঝানো হলেও এখন কিন্তু স্নিকার, কেডস, প্ল্যাটফর্ম হিলের উচ্চতাও আকাশ ছুঁতে চায়। অর্থাৎ যারা স্টিলেটো ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ নয়, তারা স্নিকার-কেডসের মাধ্যমেও নিজেদের উঁচুতে তুলতে চাইছেন। তবে কি করোনা মহামারি থেকে সৃষ্ট দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ উঁচু হিলের জুতা পরে কমফোর্ট খোঁজার চেষ্টা করছে!

আসলে ফ্যাশনের সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থার মাপকাঠি বিচার নতুন কিছু নয়। কখনো জামার ঝুল, কখনো লিপস্টিক বা অন্যান্য ফ্যাশন উপকরণের ব্যবহারের মাত্রা দেখেও অর্থনীতিবিদরা বোঝার চেষ্টা করেছেন সেই সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থার গতিপ্রকৃতি।

ওয়ার্টন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক জর্জ টেইলর এর আগে ‘হেমলাইন (জামার ঝুল) থিওরি’ আবিষ্কার করেন। এই তত্ত্বে তিনি বলছেন, ১৯২০ সালে নারীদের স্কার্টের ঝুল কমে গিয়েছিল, যা আবার ওই দশকের শেষ ভাগ থেকে পরবর্তী একদশক ধরে চলমান মহামন্দার সময় নিচের দিকে বেড়ে যায়। জর্জের মতে, অর্থনৈতিক অবস্থা যখন ভালো ছিল, ওই সময় নারীরা তুলনামূলকভাবে ছোট স্কার্ট পরতেন যেন স্কার্টের নিচে থাকা পায়ে পরিহিত দামি সিল্কের মোজাটি সবাই দেখতে পারে। আবার ঠিক যখন মন্দা চলছে, তার প্রকোপে সিল্কের মোজা কেনার মতো বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ ছিল না অনেকেরই। কম দাবি কাপড়ে মোড়ানো কিংবা মোজাবিহীন পা যেন না দেখা যায়, সেটি নিশ্চিত করতেই তখন লম্বা হয়ে পড়ে স্কার্ট। আর এই ধারা চলতে থাকে প্রায় পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত। আর দীর্ঘ প্রায় চার দশকে স্কার্টের সঙ্গে সিল্কের মোজা পরার চলই প্রায় নাই হয়ে যায়।

ফ্যাশন ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের অনেকেই আবার বলে থাকেন, লিপস্টিকের মতো ভালো অর্থনৈতিক অবস্থার নির্দেশক নাকি আর কিছু নেই। এসটে লডারের চেয়ারম্যান লিওনার্ড লডার এই ধারণার সঙ্গে পরিচয় করান। তিনি দেখান, ২০০১ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর লিপস্টিক কেনার প্রবণতা বেড়ে যার রাতারাতি। তার মতে, নারীরা তখনই তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল প্রসাধন লিপস্টিক কেনায় ব্যয় বাড়িয়ে দেয়, যখন তারা ভবিষ্যত সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে কম নিরাপদ বোধ করে।

বিজ্ঞাপন

প্রকৃতপক্ষে ১৯১১-১৪ সাল পর্যন্ত স্থায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত পুষিয়ে আমেরিকার অর্থনীতিতে তখন ছিল ঊর্ধ্বগতি। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীরা কাজের ফাঁকে পাচ্ছিলেন অবসর। ফলে নাচের আয়োজন বা পার্টি করার মতো সময়ও পাচ্ছিলেন তারা। আর এসব অনুষ্ঠানের সুবাদেই জুতা, বিশেষ করে উঁচু জুতা হয়ে ওঠে তাদের অন্যতম ফ্যাশন অনুষঙ্গ। ত্রিশের দশক আসতে আসতে স্পোর্টস শুগুলোর উচ্চতাও বাড়তে থাকে।

এর মধ্যে ১৯২৯ সালে বিশ্বজুড়ে মহামন্দা দেখা দিলে তার প্রভাবও পড়ে ফ্যাশনে। টাকার অভাব যেমন ছিল, তেমনি ছিল পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাব। পোশাকে তুলনামূলক জৌলুস কমে গেলেও তখনো হিলের উচ্চতা কিন্তু কমেনি। বরং ওই সময় হিলের উচ্চতা গড়ে তিন ইঞ্চির বেশি হওয়ার পাশাপাশি হিলে কারুকার্যও বেড়ে যায়। ধারণা করা হয়, ওই সময়েই প্ল্যাটফর্ম হিলের উদ্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ওই ভঙ্গুর অর্থনীতির সময়ে পুরো পোশাকের দিকে নজর দেওয়ার মতো সক্ষমতা না থাকার কারণেই তাদের মনোযোগটা ছিল উঁচু জুতার মধ্যে, যা পরে তারা নিজেদের আর্থিক দুরবস্থার কথা ভুলে থাকার চেষ্ট করতেন।

আবার ১৯৩০ সাল থেকেই আমেরিকান জনপদে সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিল জনপ্রিয় অবসর বিনোদনের মাধ্যম। এসময় চলচ্চিত্র তারকাদের জীবন ছিল সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। ওই সময়কার ম্যাগাজিনগুলোও তারকাদের সাজগোজের খুঁটিনাটি বিস্তারিত পরিসরে লিখতে থাকে, আর সেগুলো অনুসরণ করতেন নারীরা। এভাবে পুরো তিরিশের দশকজুড়েই জনপ্রিয় ছিল হাই হিল। এমনকি আগে শুধু রাতের অনুষ্ঠানে হাই হিল পরার চল থাকলেও এই সময়ে এসে দিনের বেলার সব অনুষ্ঠানেও সবাই পরতে শুরু করেন হাই হিল।

এভাবে পঞ্চাশ-ষাটের দশক পর্যন্ত কখনো অর্থনৈতিক কারণ, আবার কখনো স্বাভাবিক গতিপ্রক্রিয়ায় হিলের উচ্চতা কমবেশি হতে থাকে। তবে সত্তরের দশকে আচমকা বেড়ে যায় হিলের উচ্চতা। ওই সময় কাউন্টার কালচার অর্থাৎ প্রচলিত সভ্যতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্ম তাদের চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ওই সময়কার তারুণ্য অবস্থান নেয় যুদ্ধের বিপক্ষে, নারী-পুরুষের সমতার ভাবনাও তারা সামনে নিয়ে আসেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন মাত্র শেষ হয়েছে। এর ফল হিসেবে তেলের মূল্য বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আর তখনই ফ্যাশনে বৈচিত্র্যের মাত্রা চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে। শুধু নারীরা নয়, পুরুষরাও ওই সময় উঁচু হিলের জুতা পরতে শুরু করেন।

অন্যদিকে আশির দশকে নারীরা ব্যাপকহারে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে শুরু করলে তার প্রভাবও পড়ে ফ্যাশনে। নিত্যদিনের কর্মস্থলের কথা ভেবেই নারীরা আরও বেশি আরামদায়ক পোশাক ও ফ্ল্যাট জুতা পরতে শুরু করেন, যা মোটামুটি নব্বইয়ের শেষ পর্যন্ত ফ্যাশন ট্রেন্ড হিসেবে প্রচলিত ছিল। নব্বইয়ের শেষ দিকে নামি ডিজাইনারদের হাত ধরে নারীদের ফ্যাশনে আবার হাই হিলের প্রবেশ ঘটে, যা সেসময়কার জনপ্রিয় সংগীত তারকাদের কল্যাণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। নব্বইতেই শুরু হয় ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রচলন। তবে ডটকমের যাত্রার এই দশকে অর্থনীতির যতটা এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা ছিল, সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। উল্টো কাজ হারায় অনেকে। বাড়তে থাকে বেকারত্বের হতাশা। আর অর্থনীতির দুরবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়েই বাড়ছিল হিলের উচ্চতা। নতুন শতাব্দীর শূন্য দশকের শেষ দিকে ফের অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে তখনো হিলের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত ছিল।

দশের দশক থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করে। তবে গত বছরের বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস ফের গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। হোম কোয়ারেনটাইন, আইসোলেশনের মতো কোভিড বাস্তবতা মানসিকভাবে ব্যাপক চাপ তৈরি করছে মানুষের মধ্যে। এমন সময়েও দেখা যাচ্ছে— ভারসাচি, প্রাডা, মাসকিনো, মিউ মিউয়ের মতো হাই-এন্ড ফ্যাশন হাউজগুলো উঁচু জুতার নতুন কালেকশন নিয়ে হাজির হয়েছে ভোক্তার সামনে। গত একবছরের বেশি সময় ধরে চলমান মহামারি পরিস্থিতি ফ্যাশনের চেয়ে আরামকে প্রাধান্য দেওয়ার একধরনের প্রবণতা ছিল। কিন্তু এই মহামারির মধ্যেই ফের সাজগোজ বা হাই হিল পরার মাধ্যমে নিজেকে স্টাইলিশ দেখিয়ে বাস্তবতা থেকে কিছুটা হলেও পালিয়ে থাকার প্রবণতা বাড়তে শুরু করেছে— এটিও এক চরম বাস্তবতা বটে।

ফ্যাশন হাউজগুলোর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় থাকলে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন— হিলের উচ্চতাকে আরও কতদিন বা কতটুকু বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন তারা। সহসাই হিলের উচ্চতা কমানোর পরিকল্পনা না থাকলে হয়তো ধরেও নিতে পারেন— করোনা বাস্তবতার অর্থনৈতিক করুণ দশাও হয়তো সহসাই কাটছে না!

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন