বিজ্ঞাপন

হঠাৎ আলোচনায় ‘অ্যাকটেমরা’ ইনজেকশন, আসলে কতটা জরুরি

April 25, 2021 | 10:17 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ফেনীতে থাকেন রাহেলা বেগম (৫৬)। ৭ ফেব্রুয়ারি নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্তের পরে পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির পরবর্তীতে তাদের একটা প্রেসক্রিপশনে লিখে দেওয়া হয় ‘Inj Actemra 200mg’। দ্রুততার সঙ্গে ইনজেকশনটি যোগাড় করতে বলা হয় তাদের। কোনো ফার্মেসিতে না পেলেও সেখান থেকে তাদের একটি ঠিকানা লিখে দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

ধানমন্ডি-২ এর সেই ঠিকানায় গিয়ে তারা জানতে পারে এই ইনজেকশনটি দেশে আনে র‍্যাডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস। তাদের এখান থেকেই এটা কেনা যায় প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে। কিন্তু সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে জানতে পারে ইনজেকশনের সাপ্লাই নেই। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইনজেকশন যোগাড় করে একটি ফার্মেসি থেকে। কিন্তু রোগীকে তাও বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ইনজেকশনও প্রয়োগের পরেও মারা যান রাহেলা বেগম।

রাহেলা বেগমের সন্তান আজিজুল ইসলাম (৩৯) সারাবাংলাকে বলেন, আমাকে বলা হয়েছে ইনজেকশনটি খুবই জরুরি ভিত্তিতে লাগবে। আর তাই আমি আম্মুকে বাঁচাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। ইনজেকশনের আসল দাম তো আর জানি না তবে আমি ৮৪ হাজার টাকা দিয়ে নিয়েছি। আম্মুর সিটি স্ক্যান রিপোর্টে ফুসফুসে ২০ শতাংশ ইনফেকশন দেখা যায়। ডাক্তার বলেছিল এটা দিলে উন্নতি হবে পরিস্থিতির। আম্মুর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ছিল ৮১। কিন্তু কোনোভাবেই আম্মুকে বাঁচাতে পারলাম না।

রাজধানীর পুরান ঢাকা নিবাসী জাভেদ পাটোয়ারির (৬১) কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৩ এপ্রিল। কোমর্বিডিটি থাকায় তাকে রাজধানীর একটি বেসরকার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে জাভেদ পাটোয়ারির পরিবারের সদস্যদের জানানো হয় এইচআরসিটি রিপোর্টে ফুসফুসের ৪০ শতাংশের বেশি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার তথ্য। একই সঙ্গে ‘Inj Actemra 200mg’ যোগাড় করে আনার জন্য বলা হয়। ইনজেকশন দ্রুততার সঙ্গে ৪২ হাজার টাকার বিনিময়ে যোগাড় করে আনলেও তার পরদিনই মারা যায় জাভেদ পাটোয়ারি।

বিজ্ঞাপন

জাভেদ পাটোয়ারির বড় ছেলে নাজমুল পাটোয়ারি সারাবাংলাকে বলেন, আব্বার ডায়াবেটিস ছিল। এর আগে একবার স্ট্রোক করেছিল। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯১ এর নিচে নেমে আসা দেখার পরে আমরা আর কোনো রিস্ক নেইনি। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করি। ইনজেকশনটা দিলে নাকি অবস্থার উন্নতি হবে এমনটা বলা হয়েছিল। কিন্তু কপাল খারাপ আমাদের। পরদিনই মারা গেছে তিনি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সোহেল মাহমুদ (ছদ্মনাম)। একজন নিকটাত্মীয়ের কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে বলা হয়, আইসিইউতে নেওয়ার পরেও অবস্থা খারাপ। তাই ‘Inj Actemra 200mg’ যোগাড় করতে বলা হয়। নানাস্থানে যোগাযোগ করে ৭৮ হাজার টাকা দিয়ে ইনজেকশনও যোগাড় করা হয়। তার দুই দিন পরেই মারা যান তার রোগী।

সোহেল মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, রোগীর সাইটোকাইন স্ট্রোম প্রিভেন্ট করার জন্য ইনজেকশনটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেলো না।

বিজ্ঞাপন

৮ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা নিবাসী সোহেল ইসলাম (৪৭) কে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের পরে পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার ফুসফুসে ৪৮ শতাংশ সংক্রমণ ছড়িয়ে বলে পরিবারের সদস্যদের জানানো হয় হাসপাতাল থেকে। ৯ ফেব্রুয়ারি পরিবারের সদস্যদের বলা হয় দ্রুততার সঙ্গে ‘Inj Actemra 200mg’ যোগাড় করে আনার জন্য। রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসে গিয়ে তারা জানতে পারে ১২ এপ্রিলের দিকে ইনজেকশনটি আসবে। রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসে না পেলেও বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করার পরে জানতে পারে একজন ব্যক্তির কাছে ইনজেকশনটি আছে কিন্তু দাম বেশি। এক লাখ টাকা দিয়ে ইনজেকশনটা নিয়েছি তাদের কাছ থেকে।

সোহেল ইসলামের বোন সাবিহা ইসলাম সারাবাংলা’র এই প্রতিবেদকের কাছে বলেন, কী করবো ভাই? আমরা দুই বোন ও দুই ভাই। পারিবারিকভাবে সামর্থ্য যে আমাদের খুব বেশি তা না। কিন্তু সব ভাই বোন মিলে টাকা যোগাড় করে এখন ভাইয়ের জন্য চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসক যখন বলেছে তখন এটা তো লাগবেই, তাই না? বিভিন্ন ফার্মেসিতে চেষ্টা করেছি। পরে একজন একটা ঠিকানা দিয়েছে। সেখান থেকে আপাতত যোগাড়ের ব্যবস্থা হয়েছে।

শুধুমাত্র রাজধানীতেই না, ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও কিছু ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে এখন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসাধীন রোগীদের জন্য ‘টসিলিজুমাব’ গ্রুপের একটি ইঞ্জেকশন স্বল্প পরিসরে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ওষুধ হিসেবে পরিচিত অ্যাকটেমরা (Actemra) ব্র্যান্ডের ইঞ্জেকশনটি বিশ্বব্যাপী ‘ইমার্জেন্সি অথোরাইজেশন’ অনুমোদনের উপরে ভিত্তি করে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। আর এই চাহিদার কারণে এই ইনজেকশন নিয়ে নানারকমের ‘অরাজকতা’। চোরাই পথে আনা অনুমোদন ছাড়া ঔষধও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যেহেতু কোভিড-১৯ এর কোনো নির্দেষ্ট চিকিৎসাব্যবস্থা এখনো নেই তাই ইমার্জেন্সি অথোরাইজেশনের ওপর ভিত্তি করে ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দেশের জাতীয় গাইডলাইনেই টসিলিজুমাব ব্যবহারের বিষয়ে বলা আছে। তবে সেটি শুধুমাত্র বিশেষ পরিস্থিতিতে রোগীর সাইটোকাইন স্ট্রোম প্রিভেন্ট করার জন্য ইনজেকশনটা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এটি ব্যবহারের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে যায় বা কেউ ঝুঁকিমুক্ত হয়ে যায় তা এখনো কোনো গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত না। তবুও ট্রায়ালে থাকা অন্যান্য ওষুধের মতন এটা ট্রায়াল বেসিসেই এখন পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এটি না হলেই রোগী আরও ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে বা এটি দিলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে এমন কোনো কিছুই কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রমাণিত না।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ বিভিন্নভাবে পাওয়ার চেষ্টা করছে এই ইনজেকশন। কিন্তু এর ফলে একটা অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। যার সুযোগ নিতে পারে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর তাই সবার উচিত বিকল্প পদ্ধতিগুলো নিয়েও ভাবা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সরকারি হাসপাতালে এর ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম হলেও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য এই ইনজেকশনের এখন চাহিদা বাড়তি অনেক। বাজারে বাড়তি চাহিদার কারণে ইতোমধ্যেই দেশে এই ইনজেকশন নিয়ে গড়ে উঠেছে নানা রকমের সিন্ডিকেট। অধিক মূল্যে বিক্রি ছাড়াও বাজারে তারা বিক্রি করছে অনুমোদনহীন ইনজেকশনও। ভারত থেকে লাগেজ করে এনে এই ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে উচ্চমূল্যে যা সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসআই) ও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অভিযানে ধরা পড়ে। টসিলিজুমাবের দেশে একমাত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন ফার্মাসিউটিক্যালসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা যাচাই-বাছাই করেই এটি বিতরণ করছে নিজেদের মাধ্যমেই আর তাই বাইরে কেউ বিক্রি করলে তার দায় তাদের না।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোভিড-১৯ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পরে ভাইরাস বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করে। তখন মানবকোষ বা সেল চেষ্টা করে ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণের জন্য। তখন কিছু বায়োকেমিকেল বের হয়ে IL-6. এটা Inflammation কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোভিড সহ কিছু রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় সে নিজেই মানব কোষকে ধ্বংস করা শুরু করে। একে বলা হয়ে থাকে Cytokines storm বা সাইকোটাইন স্ট্রোম। এই কাজে সম্পূর্ণ Compassionate background থেকে কেভিডের ক্ষেত্রে অ্যাকটেমরা ব্যবহার শুরু করা হয়। পরে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ৮০০ রোগীর ওপর গবেষণা করে দেখে যে এটি কার্যকর পদ্ধতি নয়। RCT দিয়েও প্রমাণ করা যায়নি এটি Golden bullet। এরপর শুরু হয় অ্যাভাস্তিন বা Avastin এর ব্যবহার। সাম্প্রতিক সময়ে ন্যাচার জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে Standard care এর সঙ্গে এর ব্যবহার Critical stage এ কার্যকর বলে দাবি করা হলেও তারা RCT ছাড়া এটি ব্যবহারকে উৎসাহিত করেনি।

বাংলাদেশের ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এম এ ফয়েজ সারাবাংলাকে বলেন, যেহেতু কোভিড-১৯ পুরো বিশ্বের জন্য এমন একটা রোগ যার সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনো অজানা। আর তাই এর কোনো নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। এর চিকিৎসার জন্য প্রথমদিকে কোনো গবেষণাভিত্তিক গাইডলাইন ছিল না। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম না। প্রথমদিকে কিছু গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কিছু নির্দেশনা দেয়। সেখানে কিছু ওষুধ ইমার্জেন্সি অথোরাইজেশনে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়। সেই নির্দেশনার আলোকেই কিন্তু তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে চিকিৎসা দেওয়ার ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনটি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো সেই ম্যানেজমেন্ট গড়ে উঠে নাই যেখানে গাইডলাইন ফলো করে চিকিৎসা দেওয়া যায়। গাইডলাইন সেসব দেশে দেখা যায় যেখানে ইনস্যুরেন্স মেকানিজম আছে। অর্থাৎ কেউ যদি গাইডলাইন না মেনে থাকে তবে ইনস্যুরেন্সের কাভারেজ পাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত কিছু ঔষধ ব্যবহারের কথা বলেছে। যার মধ্যে কম সংক্রমণ দেখা গেলে কী হবে, মোডারেট হলে কী হবে বা সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে কোন ঔষধ দিতে হবে সেসব বিষয়ে ধাপে ধাপে নির্দেশনা দেওয়া আছে। সেখানে দেখা যায় কিছু আছে ওষুধ, কিছু আছে উপদেশ ও কিছু আছে খাবারের বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অক্সিজেন দিয়ে রোগীদের মনিটর করা এবং তার পরে যদি মারাত্মক হয় তবে সেক্ষেত্রে ওষুধ। যার মধ্যে একটা হচ্ছে স্টেরয়েড। এর পরে কিছু আছে গবেষণার ওষুধ। যার মাঝে একটা হলো টসিলিজুমাব। এটি দেওয়া হয় হাসপাতালে ভর্তি থাকা গুরুতর রোগীদের জন্য। কিন্তু এটা দিলে যে খুব বেশি লাভ হবে তাও কিন্তু বলা হয়নি। এটি একটা অপশন মাত্র। এমন কিছু না যে এটা দিতেই হবে রোগীদের সুস্থ করার জন্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাঝখানে আমাদের দেশে একটা জোয়ার দেখা যায় প্লাজমা দেওয়ার জন্য। অনেক রোগীকে তখন প্লাজমা দিতেই হবে এমনটাও দেখা গেছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্লাজমা দিতে কিন্তু বলেনি। আর তাই বলছি যে কিছু ওষুধ আছে যেগুলো গবেষণার ভিত্তিতে ব্যবহার করা যাবে বা গবেষণার জন্য ব্যবহার করা যায়। যেমন একসময় বলা হয়েছিল যে ক্লোরোকুইন দিতে হবে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে যে এই ক্লোরোকুইনে কোনো বেনিফিট নাই। তারা কিন্তু আইভারম্যাক্টিনের ব্যবহারেও কোনো বেনিফিট না পাওয়ার বিষয়ে জানায়। কিন্তু তারা আবার এটা বলছে যে এগুলো গবেষণার জন্য ব্যবহার করা যাবে।’

ডা. ফয়েজ বলেন, ‘আমাদের গাইডলাইন অনুযায়ী এই ঔষধ সব পর্যায়ে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। শুধুমাত্র একটা পর্যায়ে পৌছানোর পরে এটা ব্যবহার করা যেতে পারে। এখন সবাই যদি এটা ব্যবহার করতে শুরু করে তখন আসলে চাহিদা বাড়বে। আর রোগীর স্বজনরা যখন হাসপাতালে যায় তখন তার প্রিয়জনকে বাঁচানোর জন্য সব চেষ্টা করে। এই সুযোগে আসলে বাজারে অস্থিরতা শুরু হয় যেটা এখন দেখা যাচ্ছে। তবে এই টসিলিজুমাব ব্যবহার করলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে বা তার ভ্যান্টিলেটর লাগবে না এমন কোনো প্রমাণ যেহেতু পাওয়া যায় নাই তাই শুধুমাত্র এর ওপরে নির্ভর না করাই ভালো।’

জানতে চাইলে দেশে কোভিড-১৯ বিষয়ক ট্রিটমেন্ট প্রটোকল কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘টসিলিজুমাব কোনোমতেই ঢালাওভাবে ব্যবহার করা যাবে না। এটা যদি রোগীর অবস্থা না বুঝে বা সংক্রমণের মাত্রা না জেনে ব্যবহার করা হয় তবে তা আরও ক্ষতি হবে। এটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করি। এটা খুব কম সংখ্যক রোগীরই লাগে যাদের সংক্রমণের মাত্রার মার্কার দেখে প্রোপার জাজমেন্ট করে দিতে হয়। এটা খুবই রেস্ট্রিকটেড একটা ড্রাগ। যদি র‍্যান্ডমলি ব্যবহার করা হয় তবে বিপদ বয়ে আনতে পারে।’

কোভিড-১৯ বিষয়ক ট্রিটমেন্ট প্রটোকল কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যখন রোগী হাই ফ্লো নজল ক্যানোলা দিয়ে রেসপন্স করে না বা ভ্যান্টিলেটরে চলে যাওয়ার মতন অবস্থা হয় তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে টসিলিজুমাব ব্যবহারের বিষয়ে ইন্ডিকেশন দেওয়া হয়েছে আমাদের গাইডলাইনে। এটা দেশের বাইরেও এভাবে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শুধুমাত্র ক্রিটিকাল পর্যায়েই এটা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গাইডলাইনে এটার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে দেওয়া যেতে পারে কিছু ক্ষেত্রে কিন্তু দিতেই হবে এমনটা বলা হয়নি। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই ডোজ পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে রোগীর অবস্থার ওপর নির্ভর করে।’

তিনি বলেন, ‘দেশে এখন যদি বলা হয় তবে ওষুধ দেওয়ার প্র্যাকটিসটা অনেকটা বাজে ভাবে হচ্ছে। দেখা গেলো বাংলাদেশে অধিকাংশ লোকজন আইভারম্যাকটিন খাচ্ছে। কিন্তু এটা কেনো খাচ্ছে? কোথাও কী এটা খেতে বলা হয়েছে? আমাদের গাইডলাইনে আছে? কোনো চিকিৎসক কী বলেছে এই ঔষধ দিকে কেউ সুস্থ হয়ে যাবে? এখন কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে খেয়ে থাকে বা কোনো চিকিৎসক দিয়ে থাকে তবে তো আর কিছু বলার নাই। কিন্তু এটা সায়েন্টিফিক না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কিন্তু সবাইকে বলছি ন্যাশনাল গাইডলাইন ফলো করার জন্য। এখন যদি কেউ ফলো না করে তবে সেটা মনিটরিং করার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। কিন্তু আমরা সবসময় মানুষকে নানাভাবে এ সব বিষয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করছি। এখন যদি কিছু হাসপাতাল এগুলোর উপরে নির্ভর করেই চিকিৎসা চালায় তবে সেটা দুঃখজনক। কারণ এই একটেমরা বা এভাস্তিন কিন্তু যে কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। আমাদের দেশে এখন এটা নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে এক ধরনের। কিন্তু এটা তেমন কার্যকর ঔষধ তা কিন্তু এখনো প্রমাণিত না। এমনকি একটেমরা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রোশ নিজেরাও গবেষণা শেষে যে ভালো ফলাফল পেয়েছে তা কিন্ত না। কিন্তু তাও ব্যবহার হচ্ছে। কারণ ওই যে বললাম কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে সে জন্য।’

ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘টসিলিজুমাব বা অ্যাকটেমরা ব্যবহারের বিষয়ে আমাদের গাইডলাইনে পরিষ্কারভাবে কিছু নির্দেশনা আছে। হাই ফ্লো নজল ক্যানোলা বা অন্যান্য সকল চিকিৎসা দেওয়ার পরেও যদি রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে বা কোনো রোগী যদি ভ্যান্টিলেটরে চলে যাওয়ার মতন অবস্থায় পৌছায় তখনই শুধুমাত্র টসিলিজুমাব ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে। এখন এটা যদি আসলে সবার ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে থাকে তবে সেটা দুর্ভাগ্যজনক।’

রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এম এইচ লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘টসিলিজুমাব বা অ্যাকটেমরা এখন পর্যন্ত প্রমাণিত কোনো ওষুধ না। এটি দিলে রোগীর অনেক ভালো কিছু ঘটবে এমনও প্রমাণিত হয়নি। অনেকগুলো ওষুধ আছে বেনিফিট অফ ডাউট। এটা তেমন একটা ওষুধ যেটা দিতেই হবে এমন কোনো কথা নাই। এই ওষুধ এমন জরুরি কিছু না যে এটা প্রথম মানের, দ্বিতীয় মানের বা তৃতীয় মানের জরুরি ওষুধ হিসেবেও পরিচিতি দেওয়া যায়। এটা একটা চতুর্থ মানের ওষুধ বলা যেতে পারে যার কোনো সিগনিফিকেন্ট ডেভেলপমেন্ট হয় বলে কোনো গবেষণা নেই।’

তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়ত এই ইনজেকশনকে কেন্দ্র করে সম্ভবত এক ধরনের একটি চক্র গড়ে উঠেছে। এই দেশে একটি মাত্র সংস্থা এই ইনজেকশন সরবরাহ করা থাকে। একটি চক্র গড়ে ওঠা বিষয়ে আমাদের সন্দেহ হয়। এই চক্র নানা ধরনের মার্কেটিং করছে। এর কারণে এই ইনজেকশন নিয়ে বর্তমানে বাজারে একটি হাহাকার তৈরি হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষকে একটা বিষয় জানানো উচিত যে এই অ্যাকটেমরা ঔষধ নিয়ে তীব্রভাবে আবেগগ্রস্ত হওয়ার কিছু নাই। বেশি টাকা দিয়ে কেনার মতন কোনো জরুরি ওষুধ এটা না। এটি কোনো অতি প্রয়োজনীয় বা ন্যুনতম প্রয়োজনীয় কোনো ওষুধ না। আর তাই এটা ব্যবহার করতেই হবে বা বেশি দামে কিনতে হবে এমন ভাবনা বা চিন্তার কোনো দরকার নেই।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রিউম্যাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘টসিলিজুমাব সবার জন্য কোনোভাবেই কোনো জরুরি ওষুধ না। যখন রোগীর সাইটোকাইন স্ট্রোম হয় বা অবস্থা খুব দ্রুত খারাপ হয় বা অন্যান্য ওষুধ কাজ করছে না এমন মনে হয় তখনই শুধু এই অ্যাকটেমরা ইনজেকশন দেওয়া হয়। এছাড়া এটি ব্যবহার করা ঠিক না। অন্য সময় এটি নিলে কোনো কাজও করবে না। অনেকে দেখা যায় ওষুধের নাম গাইডলাইনে দেখে নিজেরাই ঔষধ নিয়ে নিচ্ছে এমনটা কিন্তু ঠিক না।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। তার বাইরে বিএসএমএমইউতে কোনো মেডিসিন দেওয়া হয় না। যখন শরীর বেশি খারাপের দিকে চলা যায় তখন কিছু ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে এটা ব্যবহার করা হয়। কারণ আমার কিন্তু রোগীর সামর্থ্য আছে কিনা সেটিও ভাবা দরকার। আর বিনা কারণে এই ওষুধ দেওয়ার কোনো দরকারই নেই। এই ওষুধ না দিলে কেউ সুস্থ হবে না এমনটা কিন্তু পুরো বিশ্বে কেউ দাবি করে নাই। আর এই করোনার সময়ে তাই যদি এই ঔষধের উপরে নির্ভর করে বাজারে সংকটের সৃষ্টি করা হয় তবে সেটি ভুল হবে।’

রাজধানীর কোভিড-১৯ বিশেষায়িত কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর এই ওষুধের বিষয়ে শোনা যায়। তখন আমিই প্রথম এটা আমাদের এখানে ব্যবহার করি ২০২০ সালের এপ্রিলের দিকে। রোগীর সাইটোকাইন স্ট্রোম প্রিভেনশন করবে এই ভেবে এটা দেওয়া হয় তাদের যারা এটা এফোর্ট করতে পারবে। কিন্তু এবার ব্যবহার করা হয়নি। এটি দিলেই যে কেউ ভালো হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা কিন্তু নাই। তাহলে তো কোনো রোগীই মারা যেতো না।’

তিনি বলেন, ‘কোভিডে যারা মারা যায় তাদের সাইটোকাইন স্ট্রোম হয়। এই স্ট্রোমটা প্রিভেন্ট করার জন্য অ্যাকটেমরা দেওয়া হয়। এটা দেওয়ার জন্য টাইমিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দিতে হয়। এছাড়া এটা আর দিয়ে লাভ নাই। এই ইনজেকশন আগে বাংলাদেশে যে কোম্পানি দিতো তাদের কাছে পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দুই দিন, তিন দিন পাওয়া যাচ্ছে কিন্তুই সবসময়ে না।’

তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কিন্তু কোনো ওষুধ এখনো প্রমাণিত না। এক্ষেত্রে অ্যাকটেমরা বলেন বা অ্যাভাস্তিন বা প্লাজমা থেরাপি কোনোটা দিয়ে যে রোগী একবারে সুস্থ হয়ে যাবে তা কিন্তু না। এগুলো সবগুলোই এখনো পরীক্ষা বা গবেষণার আওতায় আছে। ইমার্জেন্সি অথোরাইজেশনের মাধ্যমে এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ অল্প সময়ে এগুলোর ট্রায়াল কিন্তু সম্ভব না। তাই রোগী অ্যাকটেমরা দিলেই ভালো হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা না। আর আমাদের দেশে নতুন কিছু একটা আসলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গতবছর প্লাজমা থেরাপির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। আর এগুলো যখন মানুষ দেখে তখন তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ছুটোছুটি করে। আর এই ফাঁকে দেশে গজিয়ে ওঠে অসাধু ব্যবসায়ী।

ডা. আসাদ বলেন, ‘কোভিডের মূল চিকিৎসা হচ্ছে অক্সিজেন, স্টেরয়েডটাইপ দুই তিনটা বিষয়। ধরুণ দেশে ১০০ জন কোভিড রোগী আছে তাদের সবার সাইটোকাইন স্ট্রোম পর্যায়ে কিন্তু যাবে না। এ জন্য অ্যাকটেমরা কিন্তু সবার দরকার নাই। আমরা বারবার বলছি যে আতঙ্কিত না হয়ে সবাই যেনো সচেতন হই ও সতর্ক হই। কিন্তু আমরা সতর্ক বা সচেতন না হলেও আতঙ্কিত খুব দ্রুত হয়ে যাচ্ছি। আর তাই সবাইকে আবার সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাই।’

২০২০ সালে অ্যাকটেমরা ইনজেকশনটি বাজারে ৮০, ১৬০, ২০০, ৪৫০, ৫০০ মিলিগ্রামের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পাওয়া যায়। বাজারের পরিমাণভেদে এর দাম ছিল ১৫ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা। কিন্তু সম্প্রতি এই ইনজেকশনটি বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়েও।

আন্তর্জাতিক গবেষণা কী বলে?

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কোভিড রোগীদের প্রায় অর্ধেকই আর্থ্রাইটিসের এই ওষুধের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন। এক গবেষণার অংশ হিসেবে চার হাজার রোগীর ওপর এই ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়েছিল।

গবেষণায় চার হাজার রোগীর অর্ধেককে স্বল্পমূল্যের স্টেরয়েড ডেক্সামেথাসনের পাশাপাশি ‘টসিলিজুমাব’ প্রয়োগ করা হয়েছিল। বাকি অর্ধেক রোগীকে এই ‘টসিলিজুমাব’ দেওয়া হয়নি। ২৮ দিন পর দেখা গেছে, যাদের ‘টসিলিজুমাব’ দেওয়া হয়নি, তাদের মধ্যে ৬৯৪ জন (৩৩ শতাংশ) মারা গেছেন। অন্যদিকে ‘টসিলিজুমাব’ প্রয়োগ করা গ্রুপের মধ্যে মারা গেছেন ৫৯৬ জন (২৯ শতাংশ)। সে হিসাবে ‘টসিলিজুমাব’ প্রয়োগের ফলে মৃত্যু কমেছে আট জনের বা ৪ শতাংশ।

গড়ে উঠেছে প্রতারক চক্র

দেশে অ্যাকটেমরা ইনজেকশনটির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এর মূল্য এখন আকাশচূম্বী। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী অনুমোদন ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অথবা হাসপাতালের মাধ্যমে চড়া মূল্যে ইনজেকশনটি বিক্রি করছে। ভারত থেকে চোরাইপথে আনা এই ইনজেকশনটি কোনো প্রকারের কোল্ড চেইন মেইনটেইন করা ছাড়াই আনা হচ্ছে। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফার্মেসীর ব্যক্তিদের ও ফার্মেসিতে কাজ করে এমন তরুণদের সাহায্য নিয়ে বাইরে বিক্রি করা হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর গুলশানে যৌথভাবে চালানো এক অভিযানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘গ্লোবাল ফার্মা সল্যুশন’ নামের একটি পেজের মাধ্যমে অ্যাকটেমরা ইনজেকশন বিক্রি করা হচ্ছিল। দেশের বাজারে সংকট থাকা এই ইনজেকশনের একেকটি ভায়ালের দাম চাওয়া হচ্ছিল এক লাখ ৬০ হাজার টাকা করে। গুলশানের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে সেই ইনজেকশন দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে এনএসআইয়ের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়। ক্রেতা সেজে ওই পেজে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, রেস্টুরেন্টে ওষুধটি ডেলিভারি দেওয়া হবে। পরে সেখান থেকে ডেলিভারি দিতে আসা দু’জনকে আটক করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মূল অভিযান চালানো হয়।

মূল অভিযানে তিনজনকে আটক করা হয়। তাদের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। তারা জানায়, মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করে এই ইনজেকশনটি তারা বিক্রি করে থাকত। পেজে যোগাযোগ করা হলে এই চক্রের মূল হোতা তাদেরকে পাঠাতো টাকা নেওয়ার জন্য। গুলশানের একটি দোকানে এই ইনজেকশন সংগ্রহ করে রাখা হতো যা আনা হতো ভারত থেকে। চোরাইপথে বিভিন্ন কসমেটিকস ও অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে টসিলিজুমাব ইনজেকশনও আনা হতো। পেজে যোগাযোগের পরে কোনো একটি রেস্টুরেন্টে তারা যোগাযোগ করতো টসিলিজুমাব কিনতে আগ্রহী ব্যক্তির সঙ্গে। টাকা নিশ্চিত করার পরে ইনজেকশন সরবরাহ করা হতো। এ ক্ষেত্রে এই ইনজেকশনের একেকটি এক লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়েও বিক্রি করত তারা।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের উপ-পরিচালক ডা. আকিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘গুলশানের রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের নিচতলায় সেলিম এন্টারপ্রাইজে অভিযান শুরু করা হয় বিকেল ৩টার দিকে। সেখান থেকে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত টসিলিজুমাব জেনেরিকের একটেমরা ব্র্যান্ডের ইনজেকশনসহ ৩০ ধরনের অনুমোদনহীন ওষুধ পাওয়া যায়। এগুলো ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই এখান থেকে বিক্রি করা হচ্ছিল। এই ওষুধগুলো ভারত থেকে অবৈধভাবে আমদানি করা হয়েছে।’

এভাবে ভারত থেকে অবৈধভাবে ওষুধ এনে বিক্রি করাকে বিপজ্জনক বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রিউম্যাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘টসিলিজুমাব সংরক্ষণের জন্য একটি কোল্ড চেইন মেইনটেইন করতে হয়। এক্ষেত্রে চোরাই পথে এই ইনজেকশন আনলে তো সেটির গুণগত মানেও পরিবর্তন আসবে। যদি এভাবে কেউ অবৈধভাবে কোল্ড চেইন মেইনটেইন করা ছাড়াই ওষুধটি বিক্রি করে তবে সেটি ক্ষতিকর। কারণ স্বজনকে বাঁচানোর জন্য সবকিছু করতে চাওয়া ব্যক্তি হয়তোবা জানেই না এই কোল্ড চেইন পদ্ধতি নিশ্চিত করা হয়েছিল কি না?’

অ্যাকটেমরা ব্র্যান্ডের ওষুধটির নির্মাতা সুইজারল্যান্ডের রোশে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে দেশে ওষুধটি আমদানি করে থাকে র‌্যাডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস।

অ্যাকটেমরা নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশে এর পরিবেশক র‍্যাডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান মার্কেটিং কর্মকর্তা শোয়েব আল আশরাফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘টসিলিজুমাব আমরাই এনে থাকি। তবে এই ইনজেকশনটি আমরা কেবল চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দেখে সরবরাহ করে থাকি ক্রেতাদের কাছে। বাইরে কোনো স্থানে আমরা এই ইনজেকশন বিক্রির জন্য দেই না।’

তিনি বলেন, ‘এর মূল্য বাড়তি কোনো জায়গায় চাওয়া হচ্ছে বলে আমাদের জানা নেই। এটি শুধুমাত্র আমরাই এনে থাকি তাই আমরা সম্পূর্ণ তথ্য যাচাই বাছাই করে সরবরাহ করে থাকি। এক্ষেত্রে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো রকমের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’

সারাবাংলা/এসবি/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন