বিজ্ঞাপন

পিয়াসা-মৌ চক্রে শতাধিক নারী, মূল কাজ ব্ল্যাকমেইল

August 4, 2021 | 12:16 pm

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ— গোয়েন্দা পুলিশের হাতে এই দুই মডেল আটক হয়েছেন বিপুল পরিমাণ মদ-ইয়াবাসহ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলায় তারা দু’জনেই রিমান্ডে রয়েছেন। তাদের আটকের সময়ই গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছিল, তারা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য।

বিজ্ঞাপন

রিমান্ডে প্রথম দিনের জিজ্ঞাসাবাদে এই দুই মডেল জানিয়েছেন, এই চক্রের নারী সদস্যের সংখ্যা শতাধিক। তাদের কাজই ছিল তরুণদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে পার্টির নামে বাসায় ডেকে নিয়ে আসা। এরপর মদ-ইয়াবাসহ নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে তাদের ‘আপত্তিকর’ অবস্থার ছবি ও ভিডিও ধারণ করা। পরে সেই ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েই ব্ল্যাকমেইল করা হতো তরুণদের।

মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) রিমান্ডের প্রথম দিন মডেল মৌ ও পিয়াসাকে জিজ্ঞাসাবাদেই মূলত এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রথম দিনের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ সারাবাংলাকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, এই চক্রের মাধ্যমে যেসব তরুণদের ব্ল্যাকমেইল করা হতো, সেগুলোর রফা করতেন পিয়াসা ও মৌ। পিয়াসার নেতৃত্বে এই চক্রের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মৌ।

যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, পিয়াসা-মৌয়ের একটি বড় চক্র রয়েছে। তারা সংঘবদ্ধ অপরাধে লিপ্ত। বাসায় ও বিভিন্ন ক্লাব-বারে পার্টির আয়োজন করেন। সেখানে উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণদের নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করেন। সেখান থেকে আমন্ত্রণ জানান নিজেদের বাসায়। আর সেই আমন্ত্রণে যারাই সাড়া দেন, তারাই মূলত ফাঁদে পড়ে যান।
গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, এই চক্রের কোনো নারী সদস্যের বাসায় কোনো তরুণ এলে নানা ধরনের মাদক সেবন করানো হয়। ‘ফূর্তি’র এক পর্যায়ে তাকে কৌশলে নির্জন কক্ষে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে তার ছবি ও ভিডিও ধারণ করা হয়, যা পরিণত হয় ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ারে। সেই ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে পরিবারের কাছে ছবি-ভিডিও পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। এভাবেই এই চক্রটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসছে।

বিজ্ঞাপন

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, একটি স্বনামধন্য বিপণী বিতানের মালিকের স্ত্রীর কাছে ভিডিও পাঠানোর ভয় দেখিয়ে পিয়াসা মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেছিলেন। কিছু টাকা দিয়ে ওই ব্যক্তি ক্ষমা চাইলেও পিয়াসা পিছু ছাড়েননি। বাধ্য হয়ে ওই ব্যক্তি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। এরপর তদন্তে নামে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তে বেরিয়ে আসে তাদের চক্রের সন্ধান। সে অনুযায়ী চালানো হয় অভিযান।

জানা যায়, পিয়াসার জন্মদিন উদযাপনের সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। নানা শ্রেণিপেশার মানুষকে দাওয়াতও করা হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর আগেই ডিবি পুলিশ গিয়ে হাজির। পিয়াসা পুলিশকেও ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছেন। অভিযানে যাওয়া কর্মকর্তাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আটক করেছে ডিবি। একইসঙ্গে তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যও উদ্ধার করা হয়েছে। এরপরই অভিযান চালানো হয় মৌকে ধরার জন্য।

হারুন অর রশীদ বলেন, এই চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকে পথে নেমেছেন। সম্মানও হারিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকের সংসারে দুর্যোগ নেমে এসেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হলেও সম্মানের কথা চিন্তা করে তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন-

এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ বলেন, এই চক্রে ১০০ থেকে ১৫০ জন সদস্য রয়েছেন। তাদের সবার কাজই হলো ব্ল্যাকমেইল করা। পিয়াসার মাধ্যমে এসব নারীদের বিভিন্ন ব্যক্তির বাসায় পাঠানো হতো। আবার বিভিন্ন বার বা ক্লাবেও তারা পিয়াসার হয়ে কাজ করতেন। পিয়াসা চক্রের সদস্যদের কাজ করানোর সময় শরীরে গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করতেন বলেও জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশ জানাচ্ছে, পিয়াসা-মৌ চক্রটি রাজধানীর বারিধারা, উত্তরা, ধানমন্ডি, মিরপুর এলাকায় বেশিরভাগ সময় পার্টি করে থাকে। এছাড়া এদের ওপর কেউ আছে কি না, কেউ তাদের পৃষ্টপোষকতা দিত কি না— এ বিষয়গুলো না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর চক্রের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ। চক্রের মূলোৎপাটন করাই লক্ষ্য তাদের।

জানা যায়, এনটিভির একটি রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে মিডিয়া জগতে উঠে আসেন পিয়াসা। ২০১০ সালে দেশীয় কোম্পানি ওয়াল্টন ফ্রিজের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নজর কাড়েন মডেল হিসেবে। মডেলিং ক্যারিয়ারে বেশি দূর আগাতে না পারলেও মডেল পরিচয় ব্যবহার করেই নানা ধরনের কাজ করতেন। অন্যদিকে মৌ মিডিয়াতে ক্যারিয়ার গড়তে না পারলেও নিজেকে মডেল পরিচয় দিতেন। ক্রমেই তিনি পরিণত হন পিয়াসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ডে। তার বাসাতেই বারের আদলে বসত মদের আসর।

বিজ্ঞাপন

ডিবি সূত্র জানায়, মৌ ও পিয়াসার বাসার বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা বসানো আছে। সেই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কারা কারা তাদের বাসায় যেতেন, কেন যেতেন— এ সংক্রান্ত তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এছাড়া রিমান্ডের প্রথম দিন জিজ্ঞাসাবাদে মৌ ও পিয়াসা নানা রকম তথ্য দিয়েছেন। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে যুগ্ম কমিশনার হারুন বলেন, পিয়াসা-মৌ লাখ টাকা ভাড়া বাসায় থাকেন। তাদের মাসিক খরচ আরও দুই থেকে তিন লাখ টাকা। গাড়ি চালান বিএমডব্লিউ। পোশাকে, চলাফেরায় হুলুস্থুল ব্যাপার। অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর পরিবারের সদস্যদের জীবনযাপনও এত বিলাসী নয়! এত বিপুল পরিমাণ খরচের টাকা আসে কোথা থেকে! আমরা সবকিছুই খতিয়ে দেখছি।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনার মামলায় পিয়াসার নাম ছিল। ওই ঘটনায় পিয়াসার কোনো দায় ছিল কি না, সে বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আরও অনেকে ঘটনায় পিয়াসার নাম শোনা গেছে। তিনি কোন ঘটনায় কতটুকু দায়ী, তাও আমরা বের করে আনব— বলেন ওই কর্মকর্তা।

রোববার (১ আগস্ট) রাতে পিয়াসার বারিধারার ধারায় অভিযানে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। রাত পৌনে ১২টার দিকে ওই বাসা থেকে পিয়াসাকে আটক করা হয়। সেখান থেকে বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সীসা জব্দ করে গোয়েন্দা পুলিশ। ওই দিনই দিবাগত মধ্যরাতে মৌ আক্তারের মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসায় অভিযান শুরু করে ডিবি। পরে রাত সোয়া ১টার দিকে তাকে আটকের তথ্য জানানো হয়। তার বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ জব্দ করে ডিবি।

মৌ আক্তারকে আটকের পর ডিবি’র যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর-রশীদ বলেন, তারা দু’জন (পিয়াসা ও মৌ) একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। দু’জনের বাসায় বিদেশি মদ, ইয়াবা, সিসা পাওয়া গেছে। তারা দিনের বেলা ঘুমাতেন, রাতে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। তাদের কাজই ছিল উচ্চ পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে পার্টির নামে তাদের বাসায় ডেকে আনা। এরপর মাদক খাইয়ে তাদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও তুলে রাখতেন তারা। পরে সেসব ভিডিও-ছবি ভিকটিমদের পরিবারকে পাঠাবে বলে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নিতেন।

পরে পিয়াসা ও মৌ— দু’জনের বিরুদ্ধেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা মাদকের উৎস, বেচাকেনার প্রক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উদঘাটন এবং সহযোগীদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনার জন্য মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তারা তাদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। সোমবার রিমান্ড আবেদনের শুনানি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আশেক ইমামের আদালত মৌ আক্তার ও ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলামের আদালত পিয়াসার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন