বিজ্ঞাপন

তিস্তার হঠাৎ বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি লালমনিরহাটে

October 24, 2021 | 8:14 am

আলতাফুর রহমান আলতাফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

লালমনিরহাট: তিস্তার পানি হঠাৎ বেড়ে সৃষ্ট বন্যায় লালমনিরহাটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গতকাল বুধবার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানিতে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে নদীর পানি প্রায় বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এতে তিস্তা ব্যারেজের ফ্লাড বাইপাস সড়কটি ভেঙে যায়।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে, শেখ হাসিনা সেতুর লালমনিরহাটের কাকিনা-মহিপুর সংযোগ সড়কের প্রায় ১৫০ মিটার অংশ ধসে যায়। ফলে রংপুরের সঙ্গে জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর আগেই তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড বাইপাস ভেঙে নীলফামারির সঙ্গে লালমনিরহাটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। হঠাৎ বন্যার কবলে পড়ে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় হাজারো মানুষকে।

তিস্তা ব্যারাজের দায়িত্বে থাকা ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাত থেকে তিস্তার পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। বুধবার সকাল ৯টায় ওই পয়েন্টে ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দুপুর ১২টায় তা আরও বেড়ে গিয়ে বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি গেট খুলে দেওয়া হলেও প্রচণ্ড চাপের কারণে ব্যারজের ফ্লাড বাইপাসটি ভেঙে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তার পানির তোড়ে জেলার ৫টি উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকাগুলোর বেশ কিছু কাঁচাপাকা সড়ক ভেঙে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে হাতিবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চারদিকে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে অনেকেই নৌকায় চলাচল করছেন।

বিজ্ঞাপন

গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামল জানিয়েছেন, তিস্তা নদীর পানি তোড়ে বড়খাতা-হাতিবান্ধা বাইপাস সড়কটির বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে। এতে তার ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ফসলি জমি, মৎস্য খামারেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় বলেও জানান তিনি।

বন্যায় পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন সিংঙ্গীমারীর বাঁধও ভেঙে গেছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে তিস্তা ব্যারাজের উজানে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রামে পানির চাপে রাস্তার পাশাপাশি চলাচলের জন্য ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দহগ্রাম ইউনিয়নের প্রায় ১০ গ্রামের ১ হাজার ২৬৩ পরিবারের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে আবাদি জমিতে লাগানো রোপা আমনের কাঁচা, পাকা ধানসহ অনান্য রবি ফসল।

উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়ন সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা নদীর বন্যার পানি কমে গেলেও ওই ইউনিয়নের আশপাশের মহিমপাড়া, গুচ্ছগ্রাম, সদার্রপাড়াসহ ১০ গ্রামের চলাচলের আঞ্চলিক সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ওই এলাকার বঙ্গেরবাড়ি-নতুনবাজার আঞ্চলিক সড়ক সেতু ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়াও কাতিপাড়া থেকে মতিয়ারের বাড়ি কাবিখার সড়ক, গুচ্ছগ্রাম, বঙ্গেরবাড়ি-নতুনহাট, হাড়িপাড়া-সৈয়দপাড়া, গুচ্ছগ্রাম বাজার থেকে কাজীপাড়া এলাকায় পাকা ও কাঁচা সড়ক বন্যায় ভেঙে চলাচল বন্ধ রয়েছে। শিষ্টিয়ারপাড়-কলোনি গ্রাম পযর্ন্ত সড়কের ছয় স্থানে বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে ৪, ৫, ৬, ৭নং ওয়ার্ডের গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন প্রধান জানান, তার ইউনিয়নে প্রায় দুই হাজার মানুষ পানিবন্দিসহ বাড়ি-ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। ত্রাণ হিসেবে চাল ও শুকনো খাবার বরাদ্দ পেয়েছেন। তাছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছে।

পাটগ্রাম উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) উত্তম কুমার নন্দী বলেন, ‘বন্যা কবলিত এলাকায় ইতিমধ্যে ২০ মেট্রিক টন চাল ও শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়াও পানিবন্দি পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য সহায়তা রয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

এছাড়া কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, তুষভাণ্ডার ও কাকিনা ইউনিয়নে প্রায় ২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। সেখানে কাকিনা-মহিপুরের সংযোগ সড়কের প্রায় ১৫০ মিটার ধসে গেছে। কাকিনার রুদ্রেশ্বর স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবন পানির তোড়ে ধসে গেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উঠতি ফসলের।

আদিতমারী উপজেলার দু’টি বাধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মহিষখোচা থেকে স্পার বাঁধ যাওয়ার সড়কের ৩টি স্থানে ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে। পানির তোড়ে প্রায় ৫০টি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। ফসলেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

লালমনিরহাট এলজিইডি‘র নিবার্হী প্রকৌশলী আশরাফ আলী খাঁন বলেন, ‘বন্যায় কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে, তা এখন জানা যায়নি। তবে হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলায় সবথেকে বেশি রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রায় ৭/৮ কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে।’

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম নবী জানিয়েছেন, হঠাৎ বন্যায় মোট ৪৬টি স্কুলে পানি উঠেছে। এরমধ্যে হাতিবান্ধা উপজেলায় ২২টি স্কুলে বন্যার পানি প্রবেশ করে।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ জানিয়েছেন, বন্যার কারণে জেলায় মোট ৩ হাজার ৩৮০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে ডুবে গেছে। এরমধ্যে ২ হাজার ৯৫৫ হেক্টর আমন ধান। পাশাপাশি ভুট্টা ১৯২ হেক্টর, বাদাম ৫২ হেক্টর, আলু ৬৪ হেক্টর, মাশকলাই ৫ হেক্টর, মরিচ ৫ হেক্টর, পেঁয়াজ ১৬ হেক্টর, সবজি ৯১ হেক্টর জমি পানিবন্দি হয়ে পড়ে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম জানান, হঠাৎ বন্যায় প্রায় ১১৭ হেক্টর জমির ক্ষতিগ্রস্ত পুকুরের সংখ্যা ৯৩৬টি। এরমধ্যে মাছ ২২৪ মেট্রিক টান, পোনা ৩৫ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে মাছ ও পোনা মিলে আনুমানিক ক্ষতি প্রায় ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বলে উল্লেখ করেন তিনি।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানিয়েছেন, প্রায় ১৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এসব পরিবারের ত্রাণ সহায়তার জন্য ১৭৪ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সারাবাংলা/এমও

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন