বিজ্ঞাপন

৯ মাসে ৩ কোটি টাকা লোপাট, এটিএম জালিয়াতি চক্র র‌্যাবের জালে ধরা

March 6, 2022 | 8:58 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বুথে টাকা লোড-আনলোডসহ মেইনটেন্যান্সের দায়িত্ব পালন করছে গার্ডা শিল্ড। সেখানকারই কর্মী আব্দুর রহমান। চাকরিতে ঢোকার পর আলাপ হয় আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে। সব মিলিয়ে ২০ জনের একটি দল তৈরি করেন তারা। আর এই দলটির লক্ষ্য ছিল একটাই— কৌশলে এটিএম বুথ থেকে টাকা লোপাট করা। এর জন্য প্রতিদিন এটিএম মেশিনে কৃত্রিম জ্যাম তৈরি করতেন, হাতিয়ে নিতেন ৬০ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত। এভাবে গত ৯ মাসেই চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, এটিএম মেশিনে কৃত্রিম জ্যামের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন গ্রাহক। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তারা ব্যাংক থেকে টাকা ফেরত পেতেন। তবে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে ধরা পড়ে আর্থিক গরমিলের বিষয়টি। ব্যাংক মামলা করলে সেই মামলা তদন্তে নামে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র‌্যাব)। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করতেই বেরিয়ে আসে আব্দুর রহমানের নেতৃত্বাধীন জালিয়াতি চক্রের কার্যক্রম। শনিবার (৫ মার্চ) দিবাগত রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আব্দুর রহমানসহ চক্রের আট সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

রোববার (৬ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এটিএম জালিয়াতি এই চক্রকে গ্রেফতারের তথ্য তুলে ধরেন।

বিজ্ঞাপন

খন্দকার আল মঈন বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংক এটিএম বুথের ব্যবস্থাপনা থার্ড-পার্টি বা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করে থাকে। থার্ড-পার্টি টাকা স্থাপন, নিরাপত্তা, কারিগরি ত্রুটিসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের অডিটে এটিএম বুথের টাকার হিসাবে গরমিল দেখা যায়। ফলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ থার্ড-পার্টি আগের একটি সিকিউরিটি এজেন্সির (জি-৪ সিকিউরিটি গার্ড এজেন্সি) সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে। নতুন করে চুক্তি হয় গার্ডা শিল্ডের সঙ্গে। কিন্তু অনিয়ম ও অর্থের গরমিল বন্ধ হয়নি। ব্যাংক অডিটে বিষয়টি আসার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও থার্ড-পার্টি সিকিউরিটি এজেন্সি গার্ডা শিল্ড র‌্যাবের শরণাপন্ন হয়।

তিনি বলেন, র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে র‌্যাব উদঘাটন করে, থার্ড-পার্টি পরিবর্তিত হলেও টাকা লোডার ও অন্যান্য কারিগরি দলে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে র‌্যাব তদন্ত অব্যাহত রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র‌্যাব সদর দফতর গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৪-এর একটি দল রাজধানীর মিরপুর, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আট জনকে গ্রেফতার করেছে।

গ্রেফতার আট জন হলেন— আব্দুর রহমান বিশ্বাস (৩২), তারেক আজিজ (২৫), তাহমিদ উদ্দিন পাঠান ওরফে সোহান (২৮), রবিউল হাসান (২৭), হাবিবুর রহমান ওরফে ইলিয়াস (৩৬), কামরুল হাসান (৪৩), সুজন মিয়া (৩১) ও আব্দুল কাদের (৪৩)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে দু’টি চেকবই, একটি এটিএম কার্ড, চারটি আইডি কার্ড, একটি সোনার নেকলেস, এক জোড়া বালা, এক জোড়া কানের দুল, একটি আংটি এবং নগদ ৯ লাখ ৪১ হাজার ৫৫৫ টাকা জব্দ করে।

বিজ্ঞাপন

যেভাবে এটিএম বুথে জালিয়াতি

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ব্যক্তিরা সংঘবদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকটি এটিএম বুথ থেকে টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য স্বীকার করে নিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, গত দুই-তিন বছর ধরে একসঙ্গে চাকরির সুবাদে তাদের মধ্যে পরিচয় গড়ে ওঠে। এরপর আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে তারা এটিএম জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন। আর আব্দুর রহমান তার এক সাবেক সহকর্মীর কাছ থেকে এই জালিয়াতির বিষয়টি রপ্ত করেন।

আব্দুর রহমানসহ অন্যরা র‌্যাবকে জানিয়েছেন, আব্দুর রহমানের সহযোগীরা কন্ট্রোল রুম, লোডিং, কলিং এবং মেইনটেন্যান্সের দায়িত্ব পালন করেন। তারাই ব্যাংকের এটিএম বুথে টাকা স্থাপন ও মনিটরিং করতেন। ১৯ জন লোডার মিলে তারা ঢাকা শহরের ২৩১টি এটিএম বুথ মেশিনে টাকা লোড করে থাকেন। এছাড়া কারিগরি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন আরও কয়েক জন।

বিজ্ঞাপন

চক্রের সদস্যরা জানিয়েছে, তারা লোডিং ট্রে-তে টাকা রাখার সময় এক হাজার টাকার ১৯টি নোটের পরপর অথবা অন্য কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ইচ্ছাকৃতভাবে জ্যাম করে রাখতেন। কোনো গ্রাহক টাকা তোলার জন্য এটিএম বুথে কার্ড ঢুকিয়ে পিন নম্বর প্রবেশ করানোর পর টাকা তোলার কমান্ড দিলে ওই নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে আর টাকা ডেলিভারি হতো না। টাকা জমা হতো পার্স বিনে। সেই টাকা পার্স বিন থেকে এই চক্রের সদস্যরা সরিয়ে নিতেন। এভাবেই বিভিন্ন বুথ থেকে লাখ লাখ টাকা সরিয়ে নিতেন তারা। আর গ্রাহককে সেই টাকা ফেরত নিতে হতো ব্যাংকে অভিযোগ করে।

চক্রের মূলহোতা আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি তিন-চার বছর আগে জি-৪ সিকিউরিটিতে চাকরি করতেন। আর্থিক অনিয়ম ও টাকা লোপাটের অভিযোগে ওই কোম্পানির সঙ্গে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের চুক্তি বাতিল হলে পুরো চক্রটি নিয়ে তিনি নতুন চুক্তিবদ্ধ গার্ডা শিল্ড সিকিউরিটিজ এজেন্সিতে চাকরি নেন। তার অধীনে রয়েছে মিরপুর, কালশী, বেনারশি, সেনপাড়া, ইব্রাহিমপুর ও কচুক্ষেত এলাকা। এসব এলাকার এটিএম বুথগুলোকেই তিনি ও তার সহযোগীরা টাকা আত্মসাতের জন্য ব্যবহার করে আসছিলেন।

চক্রের সব সদস্যই শিক্ষিত

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব কমান্ডার মঈন বলেন, চক্রটির সবাই শিক্ষিত। তবে বেতন পেতেন ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা। এটিএম বুথ থেকে আত্মসাৎ করা টাকা দিয়ে অবশ্য তারা বিলাসী জীবনযাপন করতেন।

জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা গেছে, আব্দুর রহমান, সোহাগ পাঠান, হাবিব ও কামরুল এটিএম বুথে লোডিং, কলিং ও মেইনটেন্যান্সের কাজ করেন। অন্যদিকে কাদের, সুজন, রবিউল ও তারেক আজিজ এটিএম বুথে শুধু লোডিংয়ের কাজ করেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

৯ তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ

গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানাচ্ছে, চক্রটি প্রতিদিন ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত কৃত্রিম জ্যাম তৈরির পর আটকে রেখে আত্মসাৎ করত। এভাবে ৯ মাসে প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে দাবি করেছে।

দায় ছিল সিকিউরিটি এজেন্সি-ব্যাংকের

কমান্ডার মঈন বলেন, থার্ড-পার্টি হিসেবে গার্ডা শিল্ডের দায় ছিল। কারণ তারা লোকবল নিয়োগে অতীতের তথ্য ঘাঁটেনি। শুধু অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক টাকা লোড-আনলোডের ক্ষেত্রে নজরদারি করেনি। ব্যাংকের ও সিকিউরিটি এজেন্সির কারও সংশ্লিষ্টতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চক্রে জড়িত পলাতক অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন