বিজ্ঞাপন

‘কারও ক্ষমতার খেলার হাতিয়ার হবে না সিপিবি’

March 13, 2022 | 5:42 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বামজোটের ডাকা হরতালে সর্বাত্মকভাবে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহআলম বলেছেন, আমরা মাঠে আছি, থাকব। মামলা-হামলার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। অনেকবার জেল খেটেছি, কমিউনিস্টদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। অনেক ভয় দেখিয়েছেন, তারপরও তো কমিউনিস্টরা লড়াই করছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা দুনিয়ায় লড়াই করছে।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৩ মার্চ) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় সিপিবি সভাপতি এসব কথা বলেন।

সভায় শাহআলম বলেন, আমরা (সিপিবি) কারও ক্ষমতার বাহন হতে চাই না। আমরা কাউকে ক্ষমতায় রাখতেও চাই না। আমরা কারও ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার হব না। আমরা আর পরগাছাবৃত্তি করব না। বিএনপি যদি গাছ হয়, আওয়ামী লীগ যদি গাছ হয়, তাহলে সেই গাছে পরগাছার ভূমিকা আমরা আর নেব না। আমরা বিকল্প গড়তে চাই, ক্ষমতায় যেতে চাই। আমরা ব্যবস্থা বদল করতে চাই। প্রকৃত গণতন্ত্র কায়েম করতে চাই। এই নিয়ে আমরা মাঠে নেমেছি। গোটা বাংলাদেশে আমাদের পার্টি নেমে গেছে।

‘আমরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। সাম্রাজ্যবাদের দোসর যারা এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে আছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। এটা ফরজ কাজ। এদেশের মেহনতি মানুষের জন্য আমরা এই ফরজ কাজ করে যাব। হামলা-মামলা, চোখ রাঙানি, মাস্তানি, আক্রমণ এসবের আমরা পরোয়া করি না। মাস্তানি আমরা ঊনসত্তর সালেও দেখেছি। জনতার বুলডোজারে মাস্তানি কর্পুরের মতো উড়ে গিয়েছিল। জনগণের বুলডোজারে মাস্তানরা পড়ে যাবে। এরশাদের সময় অভি-নীরুরা জনগণের বুলডোজারে পড়ে টিকতে পারেনি। এখনও টিকতে পারবে না, যতই নিজেকে সাজাক।’

বিজ্ঞাপন

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বামজোটের ডাকা আধাবেলা হরতালে বিএনপির সমর্থন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘২৮ মার্চ হরতাল আমরা (বাম) ডেকেছি। বিএনপির সমর্থন তো আমরা চাইনি। তার (বিএনপি) রাজনীতি সে করুক। তার কোমরে জোর থাকলে সে আলাদা করুক। হরতালে সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু বিএনপি কি মুক্তবাজারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? বিএনপি কি রেশনশপ চালু করার পক্ষে থাকবে? গণবন্টন ব্যবস্থার পক্ষে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সরকারিকরণের পক্ষে সে থাকবে? বিএনপি তো নিজেই মুক্তবাজারপন্থী। বিএনপির সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তো বলেছিলেন যে, বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে শ্রেণিগত কোনো পার্থক্য নেই, ওরা মুক্তবাজারে বিশ্বাস করে, আমরাও করি। আর মুক্তবাজার তো দেশে চালু করেছে জিয়াউর রহমান।’

‘আমাদের হরতাল মানুষের জান বাঁচানোর জন্য। যারা এখানে ঢুকে যেতে চান, তাদের হুঁশিয়ার করছি। আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই, কারও ক্ষমতার খেলার হাতিয়ার আমরা হব না, এটা পরিষ্কার থাকা দরকার। বিএনপির রাজনীতি বিএনপি করুক। কিন্তু আমরা কারও ক্ষমতায় যাবার বাহন হব না। কাউকে ক্ষমতায় রাখতেও চাই না। আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই। আমাদের এই রাজনীতিকে যারা ভণ্ডুল করতে চাচ্ছেন, তাদের হুঁশিয়ার করতে চাই।’

সদ্যগঠিত নির্বাচন কমিশন ও এ সংক্রান্ত প্রণীত আইন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুল হয়েই থাকবে। যে আইনটা হয়েছে, এটা একটা কালো আইন। হাসিনার ক্ষমতা তো চিরস্থায়ী হবে না। কিন্তু স্বৈরশাসক যারাই আসবে, বিশেষ করে সামরিক স্বৈরশাসকদের জন্য এই আইন পোয়াবারো হয়ে গেছে। কারণ নির্বাহী প্রধানই তো নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবেন। এটা চুয়াত্তরের বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো কালো আইন হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার ছিনতাই হয়ে গেছে। এই আইন বাতিল করে জনগণের ভোটের অধিকার ফেরাতে আবার দেশের জনগণকে রক্ত দিতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

তদারকি সরকারের দাবি থেকে সিপিবিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট সরে আসেনি বলেও জানান শাহআলম। সিপিবি আগামী সংসদ নির্বাচনে যাবে কি না?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা গতবারের নির্বাচনে গিয়েছিলাম। বামজোট ১৩৪টি আসনে সম্মিলিতভাবে প্রার্থী দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনটা হয়নি। পরের দিনের ভোট আগেরদিন রাতে হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ একসময় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিল, সেই গণতন্ত্র তারা গিলে খেয়ে নিল। বিএনপির জন্ম গ্যারিসনে, রাস্তা থেকে নয়। অথচ আওয়ামী লীগের জন্ম রাস্তা থেকে; তারাই গণতন্ত্র গিলে খেয়েছে। মানুষ যদি গণআন্দোলনে নেমে যায়, আমরা ভোটে যাব কেন? গণআন্দোলন করে রেজিম পরিবর্তন করে তারপর ভোটে যাব। আর মানুষ যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে আমরা ভোটে যাব। ভোটকেন্দ্র পাহারা দিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার কায়েম করতে হবে।’

আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি থেকে দূরে সরে গেছে। শেখ মুজিবের আদর্শের বিপরীতে কাজ করছে। লুটেরা রাজনীতিবিদ, লুটেরা ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক আমলারা আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক চরিত্র চুষে খেয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার, সেটাকে আওয়ামী লীগ ব্যবহার করবে, কিন্তু সমাধান করবে না। এটা সমাধান করলে আওয়ামী লীগের আর রাজনীতি থাকবে না। বিএনপি-আওয়ামী লীগ একই হয়ে যাবে। সাম্প্রদায়িকতা যদি থাকে, তাহলে সেটা নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি করবে আওয়ামী লীগ।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সবাই মিলে দাঁড়াতে হবে। এই বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। এই বাংলাদেশ কারও বাপের তালুকদারি না। উত্তরাধিকারের রাজনীতি বাংলাদেশকে শেষ করে দিয়েছে।’

লুটেরা সিন্ডিকেট বাংলাদেশের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে মন্তব্য করে শাহআলম বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে আমরা ২২ কোটিপতি পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলাম, আজ ৯৪ হাজার কোটিপতি হয়েছে। এদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা? সামরিক-বেসামরিক আমলা, লুটেরা রাজনীতিবিদ এবং গ্রাম-শহরে গজিয়ে ওঠা সোশ্যাল ক্রিমিনালদের একটা বিশাল সার্কেল বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সার্কেল ভাঙতে না পারলে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সমাজ পরিবর্তন কোনোটাই সম্ভব নয়। এই সার্কেল আমাদের অক্টোপাসের মতো বেঁধে ফেলেছে।’

বিজ্ঞাপন

‘আজ দেশ দু’ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে পঁচানব্বই ভাগ, আরেকদিকে পাঁচ ভাগ। পাঁচ ভাগের থাকার জায়গা, খাওয়ার জায়গা, চিকিৎসার জায়গা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জায়গা সব আলাদা। দেশে দুইটা অর্থনীতি চলছে। পঁচানব্বই ভাগের অর্থনীতি এক, পাঁচ ভাগের অর্থনীতি আরেক। পাঁচ ভাগওয়ালারাই আবার পার্লামেন্ট দখল করে রেখেছে। যারা শেয়ার মার্কেট লুট করে, যারা শ্রমিকের ঘামের পয়সা দেয় না, যারা সাংবাদিকদের ঠকায় তারাই পার্লামেন্ট মেম্বার। সুতরাং এটা যদি ভাঙা না যায়, তাহলে গণতন্ত্র তো হা হুতাশ করে আসবে না।’

দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দুই হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দুই হাজার কোটি টাকা লুটপাট শেষের পর সরকার তেলের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিল। সরকার ভ্যাট মওকুফ আগে করল না কেন? যে সিন্ডিকেট সংসদে আছে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আছে, রাজনীতিবিদের মধ্যে আছে, তারা আগে হিসাব করল যে কীভাবে লুটপাট করা যাবে। দুই সপ্তাহের মধ্যে লুটপাট শেষ করল এরপর ভ্যাট মওকুফ হলো। আজ টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রির নামে আইওয়াশ করা হচ্ছে। স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হয় না কেন? তথাকথিত মুক্তবাজারও তো এদেশে নেই। স্বাস্থ্য, খাদ্য, শেয়ার মার্কেট, ব্যাংকে- সবখানে সিন্ডিকেট। এরা জগদ্দল পাথরের মতো ১৭ কোটি মানুষের বুকের ওপর বসে আছে। এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে।’

লুটেরা সিন্ডিকেটের লুটপাটের তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে সরকার সাংবাদিকতার স্বাধীনতা খর্ব করেছে বলেও মন্তব্য করেন শাহআলম।

সভায় চট্টগ্রাম জেলা সিপিবির সভাপতি অশোক সাহা ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর এবং দক্ষিণ জেলার সভাপতি কানাইলাল দাশ ও সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী উপস্থিত ছিলেন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন