বিজ্ঞাপন

ঢাবির হল কমিটি ঘোষণার পর বেপরোয়া ছাত্রলীগ

April 5, 2022 | 9:18 pm

রাহাতুল ইসলাম রাফি, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী রাজিমুল হক রাকিব। ২০১৭-১৮ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এই শিক্ষার্থীকে প্রোগ্রামে ও গেস্টরুমে যেতে অপারগতা প্রকাশ করার ‘অপরাধে’ সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে মারধর করে বের করে দেয় হল শাখা ছাত্রলীগ। রাকিবের অভিযোগ— হল শাখা ছাত্রলীগের নতুন সভাপতি তানভীর শিকদার নিজে সরাসরি এই ঘটনায় যুক্ত ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলে আংশিক কমিটি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। প্রত্যেক হলের শীর্ষ দুই পদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নাম ঘোষণা করে সংগঠনটি। এর পর থেকেই শিক্ষার্থী নির্যাতন, চাঁদাবাজিসহ নানান অভিযোগ আসতে থাকে বেশ কয়েকটি হলের নেতাদের বিরুদ্ধে। নতুন কমিটি হওয়ার দু’মাসের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বিজয় একাত্তর হল, অমর একুশে হলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন ও চাঁদাবাজির মতো অভিযোগ আসে।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, নতুন নেতৃত্ব শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করছে। বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততায় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেখা হচ্ছে’ বলে দাবি করছেন তারা। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ফরমাল অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় গত শুক্রবার (১ এপ্রিল) হল প্রাধ্যক্ষ বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী রাকিব। ওই ঘটনার জের ধরে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তানভীরের ছয়/সাত জন কর্মী গত ৪ এপ্রিল ইফতারের পর তাকে হল থেকে বের করে দেন। পরে ব্রিটিশ কাউন্সিল সংলগ্ন গেইটের ওয়াচম্যানের কক্ষের বাইরে রাকিবের বইপত্র ও মালামাল স্তুপ আকারে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এছাড়া তার পড়ার টেবিলটি ছিল উল্টানো। রাকিব প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টাৎ হলের বাইরে ফুলার রোডে অবস্থান করেন।

বিজ্ঞাপন

গণমাধ্যমকে রাকিব বলেন, ‘ইফতারের পর রাত সাড়ে সাতটার দিকে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তানভীর শিকদারের ছয়/সাত জন কর্মী রুমে প্রবেশ করে আমার জিনিসপত্র বের করে দেয়। এ সময় ওরা মারমুখী অবস্থানে ছিল বলে আমি তখন প্রতিবাদ করতে পারিনি। আমি চুপচাপ বেরিয়ে আসি।’

বঙ্গবন্ধু হলে শিক্ষার্থী নির্যাতন

গত ১০ মার্চ রাতে আবু তালিব নামে দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে ‘সিনিয়রের সামনে সিগারেট খাওয়ায়’ বঙ্গবন্ধু হলের ২০১ (ক) নম্বর রুমে ডেকে নিয়ে স্টাম্প দিয়ে মারধর করার অভিযোগ উঠে হল শাখা ছাত্রলীগের চার কর্মীর বিরুদ্ধে। এ সময় ওই শিক্ষার্থীকে হাতে না ধরে সিগারেট খাওয়ার নির্দেশ দেন তারা।

বিজ্ঞাপন

অভিযুক্ত চার ছাত্রলীগ কর্মী হলেন— সমাজ কল্যাণ বিভাগের শেখ শান্ত আলম, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শাহাবুদ্দিন ইসলাম বিজয়, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ইমদাদুল হক বাঁধন ও আইন বিভাগের নাহিদুল ইসলাম ফাগুন। এদের সবাই তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদি হাসান শান্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিৎ চন্দ্র দাসের অনুসারী বলে জানা গেছে।

এদিকে ঘটনার পর ভয়ে হল ছাড়েন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আবু তালিব। আর ঘটনার পরদিন হলের সিনিয়র হাউজ টিউটর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সোবহান তালুকদারকে (উপল তালুকদার) প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

বিজয় একাত্তর হলের কক্ষে ঢুকে শিক্ষার্থী নির্যাতন

গত ২৬ মার্চ দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয় একাত্তর হলের একটি কক্ষে ঢুকে থিয়েটার অ্যান্ড পারফর্ম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের এক শিক্ষার্থীর উপর সংঘবদ্ধ হামলার অভিযোগ ওঠে হল শাখা ছাত্রলীগের ১০/১২ জন কর্মীর বিরুদ্ধে। পরে হামলার শিকার শিক্ষার্থী আখলাকুজ্জামান অনিক হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করলে গত ৩ এপ্রিল তদন্তসাপেক্ষে হামলার ঘটনায় ছয় জনের সম্পৃক্ততা পায় হল প্রশাসন।

বিজ্ঞাপন

এই ঘটনায় ৬ ছাত্রলীগ কর্মীকে হল থেকে আজীবন বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। বহিষ্কৃতরা হলেন— বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাসফিউর রহমান, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শফিউল্লাহ সুমন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিক বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈমুর রাশিদ, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাব্বির আল হাসান কাইয়ুম, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ফিরোজ আলম অপি ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মারুফ। এদের সবাই হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সজিবুর রহমান সজীব ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের অনুসারী বলে জানা গেছে।

একুশে হল ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি

এদিকে, চাঁদা না দেওয়ায় আনন্দবাজারের সাতটি দোকান বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। আনন্দবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, গত ১২ মার্চ রাতে নেতাকর্মীর বহর নিয়ে আনন্দবাজারে যান অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা এনায়েত এইচ মনন ও ইমদাদুল হাসান। ব্যবসায়ীদের কয়েকজন জানান, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ও চাঁদার জন্য হুমকি-ধামকি দেন। এক পর্যায়ে সাতটি দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন তারা।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ওই ঘটনার ছয় দিনের মাথায় ১৮ মার্চ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে একটি হোটেলে ডেকে নিয়ে এককালীন ১০ লাখ ও প্রতি মাসে এক লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করেন একুশে হলের সভাপতি এনায়েত ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল। তবে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করেন দুজন।

যা বলছেন ঢাবি ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা

গত দুই মাসে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন নির্যাতন ও চাঁদাবাজির ঘটনাকে সংগঠনের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস। এসব ঘটনা নিয়ে কাজ করছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

সনজিত চন্দ্র দাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তো এই ধরনের অভিযোগ আসে না। তাছাড়া এ ধরনের কাজ তো আমাদের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী। যারা এসব করে ছাত্রলীগের বদনাম করতে চায়, তাদের অবশ্যই আমরা সাবধান করে দেব। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের দাবি, এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকের সম্পৃক্ততার প্রশ্নই আসে না। তার মতে, এসব ঘটনা সামনে আনাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না! প্রত্যেকটি হলে ছাত্রলীগ মতবিনিময় সভা করেছে, ক্যান্টিনের খাদ্যমান তদারকি থেকে শুরু করে ইন্টারনেট ব্যবস্থা— সার্বিক সব বিষয়ে তারা কাজ করছে।’

তিনি বলেন, ‘যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিষয়টি দেখতে চায় এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কোনো বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে এবং কোনো বিষয়কে আনে না- তারা হয়তো এভাবে ভাবতে পারে। কিন্তু হলের শিক্ষার্থীরা জানে যে, হল কমিটি হওয়ার পর ছাত্রলীগ আধুনিক, যুগোপযোগী ও স্মার্ট কর্মসূচি প্রণয়ন করছে।’

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যা বলছে

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী সারাবাংলা বলেন, ‘যেসব ঘটনায় ফরমাল অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট হল প্রশাসন কাজ করছে। আর যেখানে আপনাদের কথা বলবার সুযোগ আছে, সংশ্লিষ্ট হল প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে, আপনারা কনক্রিট তথ্য নিয়ে লিখবেন— এটাই পরামর্শ।’

সারাবাংলা/আরআইআর/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন