বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধুর প্রথম গুচ্ছগ্রাম ‘চর পোড়াগাছা’র নিঃস্বদের মুখে হাসি

July 20, 2022 | 10:32 am

নৃপেন রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

রামগতি, লক্ষ্মীপুর থেকে: ‘নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে/ এই তো নদীর খেলা/ সকালবেলা আমির যে ভাই/ ফকির সন্ধ্যা বেলা…’। নদীর ভাঙা-গড়ার খেলায় দিশেহারা মানুষগুলো ছিল খোলা আকাশের নিচে। মেঘনাপারের ভূমিহীন মানুষের দুর্ভোগ ছিল অন্তহীন। দেখতে আর দশটি সাধারণ গ্রামের মতো হলেও এই এলাকা একসময় ছিল বিরানভূমি, চর।

বিজ্ঞাপন

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছার সেই দুর্ভোগ পোহানো মানুষদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিজে মাটি ভরাটের কাজে অংশ নিয়ে ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য উদ্বোধন করেছিলেন ‘গুচ্ছগ্রাম’ প্রকল্প। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর এখন সেই গুচ্ছগ্রামের অনেক সড়ক পাকা হয়েছে। সেই পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলেই শান্ত নিরিবিলি বাড়িঘর। রাস্তার দুই পাশের বাড়িগুলোর বেশিরভাগই ইটের। বাড়ির উঠোনে নারিকেল, ডাব, সুপারি, কড়ই, পেয়ারাসহ নানা প্রজাতির গাছগাছালি। স্বাধীনতা পূর্ব বিরানভূমি এখন মানুষের কোলাহলে ভরপুর।

পাকিস্তানে দীর্ঘ কারাবাস শেষে স্বাধীনতার পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু পদধূলি দিয়েছিলেন সেই চর পোড়াগাছায়। এখনো সে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান গুচ্ছগ্রামের প্রবীণ বাসিন্দারা। বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেই এখনো চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে তাদের। পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তারা ছড়িয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সেই স্মৃতি।

স্থানীয়দের কথা বলে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম তৎকালীন নোয়াখালী জেলার রামগতি থানার চর বাদাম ইউনিয়নের চর পোড়াগাছা গুচ্ছগ্রামে এসেছিলেন। বর্তমানে রামগতি লক্ষ্মীপুর জেলার একটি উপজেলা। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু ও তার সফরসঙ্গীরা দু’টি হেলিকপ্টারে করে মেঘনা নদীর এই উপকূলে পৌঁছান।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা জানান, ওই সময় উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেশ আমাদেরই গড়তে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে। প্রত্যেক বাড়িতে একটি করে লাউ গাছ হলেও লাগাতে হবে। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে।

সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু নিজেই কোদাল হাতে নিয়ে মাটি কাটতে শুরু করেন রাস্তা নির্মাণের জন্য। এই দৃশ্য দেখে স্বেচ্ছায় ওড়া-কোদাল হাতে রাস্তা নির্মাণের কাজে নেমে পড়ে সহস্রাধিক মানুষ। চর পোড়াগাছা নামের সেই গুচ্ছগ্রাম বর্তমানে শেখের কিল্লা নামে সুপরিচিত। সেখানে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্তৃতিস্তম্ভ।

বিজ্ঞাপন

চর পোড়াগাছায় নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ২১০টি পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রতিটি পরিবারকে ২ দশমিক ৫ একর করে ভূমি বন্দোবস্ত করে দেন। ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রমের সেই শুরু বাংলাদেশে। জাতির পিতার হাতে গড়া সেই প্রথম গুচ্ছগ্রাম ‘চর পোড়াগাছা’। এখন সেখানকার প্রতিটি বাড়ির সামনেই রয়েছে পুকুর। যেন পুরোদস্তুর গৃহস্থ বাড়ি। দেখে বোঝার উপায় নেই, এই গ্রামের মানুষরা এক সময় নদী ভাঙনে সর্বহারা, দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। এক সময়ের নিঃস্ব পরিবারগুলোর দু’চারটি বাদে প্রায় সবাই এখন বেশ স্বাবলম্বী। প্রথম প্রজন্মের হাত ধরে অনেকেই বংশ পরম্পরায় তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে এখন এই গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা। কিছু অপূর্ণতা, আক্ষেপ থাকলেও দেশের প্রথম গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা সচ্ছল জীবনের অধিকারী।

মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) দুপুরে লক্ষ্মীপুরের রামগতির চর পোড়াগাছা গ্রাম সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আশ্রয়ন ভাবনার গুচ্ছগ্রাম এখন সবুজ ছায়াঘেরা, শান্ত-কোলাহলমুক্ত একটি গ্রাম। এখানকার সেই ২১০ পরিবার থেকে এখন এই গ্রামে বসবাস ছয় শতাধিক পরিবারের।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, তখন ২১০ পরিবারকে আড়াই একর করে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাড়ির জন্য ছিল ৩০ শতক। কৃষিজমি ছিল ২ একর ২০ শতক। মোট ৬০০ একর জমির মধ্যে ৫০০ একর ছিল ব্যক্তিদের নামে। বাকি ১০০ একর সবার। সেখানে প্রতিটি বাড়িতে পুকুর, প্রতি ১০ পরিবারের জন্য একটি করে দিঘী ছাড়াও মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা, বাজার, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল আলাদা জায়গা। একেকটি পুকুরের ভাগিদার ছিল ১০ পরিবার। তারা সবাই মিলে দিঘীতে মাছ চাষ করতেন।

বঙ্গন্ধুর দেওয়া জায়গা পেয়েছিলেন এই গ্রামের মাইনুদ্দিন দুলাল। তখন তার বয়স ছিল ২৫-২৬। পাশের চরগাজী ইউনিয়নের বাসিন্দা দুলালের বাদ-দাদার বাড়ি-জমি সব বিলীন হয়েছিল নদী ভাঙনে। দুলালের সংসার ছিল তিন ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে। করতেন দর্জির কাজ। তার ছেলে-মেয়েরাও এখন প্রতিষ্ঠিত।

বিজ্ঞাপন

দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের তখন বাঁচার ঠিকানা দিয়েছিলেন। এখন অনেক ভালো আছি। আল্লাহর কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য সবসময় দোয়া করি।

গুচ্ছগ্রামে কথা হয় ষাটোর্ধ্ব মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বাড়ির আঙিনায় গোসল করছিলেন। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। বললেন, সত্তরের সাইক্লোনে আমরা সব হারিয়েছি। সর্বহারার মতো অবস্থা। বঙ্গবন্ধু দেখতে এসেছিলেন। আজ যেই সুন্দর গ্রাম দেখছেন, সেই গ্রাম ছিল তখন মরুভূমির মাঠের মতো। ধূধূ চর। বঙ্গবন্ধু তখন আমাদের প্রতি পরিবারকে আড়াই একর করে জায়গা দিয়েছিলেন। এখানে দেখবেন প্রতিটি বাড়ি অনেক বড়। সামনে পুকুর আছে, সেটাও সরকারি। ১০ পরিবারের জন্য একটি করে দিঘী। আর মসজিদ-মাদরাসা, বাজার, বিদ্যালয় তো আছেই। আমাদের এখান থেকে শুরু করার পর বঙ্গবন্ধু সারাদেশে মোট সাতটি গুচ্ছগ্রাম করেছিলেন। উনি থাকলে আরও বহু কিছু হয়তো করতেন আমাদের মতো নিঃস্ব মানুষের জন্য।

আব্দুল হালিম নামের স্থানীয় বাসিন্দা বললেন, আশপাশের অন্য গ্রামগুলোর তুলনায় এই গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা বেশি সচ্ছল। তাদের অনেকেই এখন বড় গৃহস্থ। ইউরোপ-আমেরিকাতেও থাকেন কয়েকটি পরিবারের সদস্য।

হালিমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, পাশেই ছিলেন পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা তাজল হক ব্যাপারী। গুচ্ছগ্রামে তার মুদি দোকান রয়েছেন। তাজল হকও বললেন একই কথা— এই গ্রামের মানুষেরা এখন অনেক ভালো আছেন। প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত।

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা শরীফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এখন খুব সুখে আছি। আমরা ছিলাম মেঘনার নদী ভাঙনে দিশেহারা, সর্বস্বান্ত। বঙ্গবন্ধু এসে আমাদের জায়গা দিলেন। তিনি সেদিন এই ব্যবস্থা করে না গেলে আমাদের জীবনের দুঃস্বপ্ন হয়তো কখনো কাটত না। তাই বঙ্গবন্ধুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি, আর নামাজে বসলে দোয়া করি। আকাশের দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলি— বঙ্গবন্ধু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার সর্বস্বান্ত-সর্বহারা-নিঃস্ব বান্দারা ভালো আছে, সুখে আছে।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান চেয়ারম্যান নুরুল আমিন হাওলাদার বলেন, এখানকার বর্তমান জমির মূল্য প্রতি কানি ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। সেই হিসাবে বঙ্গবন্ধু যাদের বাড়ি ও জমি দিয়েছিলেন, তার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় কোটি টাকার মতো।

নিরাশ্রয়দের আশ্রয় দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলতে বঙ্গবন্ধুর সেই উদ্যোগের সুফল ভোগ করছেন এখন চর পোড়াগাছার সবাই। তবে সরকারের কাছে এই গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের কিছু দাবিও আছে। তারা জানান, বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত এ গুচ্ছগ্রামে অবকাঠামোগত উন্নয়ন তেমন হয়নি। গুচ্ছগ্রামের অনেক রাস্তা এখনো কাঁচা। বৃষ্টি-বাদলের দিনে চলাফেরা কঠিন হয়ে যায়।

বাসিন্দারা বলেন, সময়ের প্রয়োজনে এখানে বাসিন্দা বেড়েছে। আমরা চাই, আশপাশে একটি হাসপাতাল হোক। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই সবুজ-শ্যামলে ভরপুর গ্রামের উন্নয়নে সরকার আরও সুদৃষ্টি দিয়ে সহায়তা করলে এটি পর্যটকদের জন্যও একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর গুচ্ছগ্রামের মাধ্যমে ভূমিহীন, ঘরহীন মানুষদের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্পের সূচনা করলেও দেশ স্বাধীনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় আততায়ীর গুলি তার সব উদ্যোগকে থামিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তী সরকারগুলোও নিঃস্ব এসব মানুষের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠনের সুযোগ পেলে ফের আশ্রয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছেন। বর্তমানে ‘আশ্রয়ন-২ প্রকল্পে’র মাধ্যমে শেখ হাসিনার ঘোষণা— বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তথ্য বলছে, এরই মধ্যে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে দেশের ৫২টি উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত করেছে সরকার। আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ লাখ ৯ হাজার ৩৭০ পরিবারকে ভূমি ও সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্বাহী সেলের মাধ্যমে ৭ হাজার ৮০৯ পরিবার, ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৭২ হাজার ৪৫২ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৪ হাজার ২৩৭ পরিবার, বাংলাদেশের গৃহায়ন তহবিল থেকে ৮৮ হাজার ৭৮৬ পরিবার এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২৮ হাজার ৬০৯ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এভাবে সারাদেশে মোট ৭ লাখ ১১ হাজার ৬৩ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর এই আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই ইউনিয়নে কলাকোপা আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ দশমিক ১৫ একর অবৈধ দখলে থাকা জমি উদ্ধার করে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জেলে, ভিক্ষুক, বিধবা ও অসহায় ১৪২ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।

সারাবাংলা/এনআর/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন