বিজ্ঞাপন

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ; পরিবারের ভূমিকা এবং সামাজিক সচেতনতা

August 24, 2022 | 3:09 pm

অলোক আচার্য

করোনাকাল দীর্ঘ হওয়ার সাথে সাথে শিক্ষা কার্যক্রম চললেও স্বশরীরে উপস্থিতি না থাকায় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ ছিল। দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি পারষ্পরিক কারণ জড়িত রয়েছে। করোনাকালে দেশে মানুষের আয় কমেছে এবং এর ফলে দারিদ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। বাকিদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে মাউশির পরিবীক্সণ ও মূল্যায়ন শাখা দেশের ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্রমিক বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালের তথ্য সংগ্রহ করেছে। তার আগে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ২০২১ সালের তথ্য সংগ্রহ করেছিল। ব্যানবেইসের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় মোট ১ কোটি ১ লাক ৯০ হাজার ২২ শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ২ লাখ ৫২ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যাবধানে শিক্ষার্থী কমে প্রায় ৬২ হাজার। করোনা মাহামারীর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বশরীরে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ থাকে। অনলাইন,টেলিভিশন ও রেডিওতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এই সময়ে অনেক পরিবার তাদের কন্যা সন্তানকে অপরিণত বয়সেই বিয়ের দিকে ঠেলে দেয়। বাল্যবিয়ে অভিশাপ হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তা এখনও চলছে। নারী শিক্ষার অন্তরায় এবং সর্বোপরি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করে। দেশ হিসেবে আজ আমাদের বহু অর্জন। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে আমরা আজ রোল মডেল। এতসব অর্জনের মাঝেও কিছু খবর আমাদের ভাবতে বাধ্য কওে আধুনিক সভ্যতার অগ্রযাত্রায় নারীর অবদান অনস্বীকার্য। আর এই অগ্রযাত্রায় এখন প্রধান বাধা হলো বাধ্যবিয়ের মতো বাধা। যার জন্য সেই হতভাগ্য কিশোরীর পরিবার দায়ী থাকে।

বিজ্ঞাপন

মহামারীর কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় এবং দরিদ্র পরিবারগুলো আরও দরিদ্র হয়ে পড়ায় বাল্যবিয়ের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে। বাল্যবিয়েও আসলে এক ধরনের ক্যন্সার। যা সমাজে ছড়িয়ে পরেছে। আমরা একজন শিশুর কাছ থেকে তার শৈশব, একজন কিশোরীর কাছ থেকে তার কৈশর কেড়ে নিচ্ছি। তাকে মুক্ত পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ দিচ্ছি না। তার আগেই তার ওপর সংসার নামের এক গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে তাকে ভারে ন্যুজ করে দিচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে সেই প্রাচীনকালে ‘কন্যাদায়’ বলে যে শব্দ প্রচলিত ছিল এখনও অনেক অভিভাবক সেই কন্যাকে আশীর্বাদ হিসেবে না চিন্তা করে দায় হিসেবেই গ্রহণ করছে। ফলে সেই কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে আইনের তোয়াক্কা না করে, নিজের মেয়ের ভবিষ্যত চিন্তা না করে নিজেকে দায় থেকে মুক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। আর তখনি সর্বনাশ ঘটে। যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার কমছে কিন্তু আমাদের লক্ষ্য বাল্যবিয়েমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণ,প্রসব জটিলতা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিতেও বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। কিশোরীর স্বাস্থ্য হুমকির মুখে থাকে। সে একটি খারাপ সময়ের মুখোমুখি হয়। যদিও অনেক পরিবারে বিষয়টি তেমন গুরুত্বসহকারে দেখা হয় না। এটাও এক ধরনেই অন্ধকারে থাকা।

২০১৫ সালে জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গৃহীত হওয়ার সময় বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯০টিরও বেশি দেশ বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী আর অর্ধেক তার নর। নারীর মেধা এবং পারদর্শীতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। বাল্যবিয়ে নামক ব্যাধি গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে আছে। জেএসসি পরীক্ষার সময় দেখা যায় পত্রিকায় অনুপস্থিত মেয়েদের বেশিরভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এমনকি পিইসি পরীক্ষায় অনুপস্থিত অনেকে মেয়ের ক্ষেত্রেই ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাসটি ঘটে। যেখানে একজন ছেলে সন্তানের পরিবার থেকে লক্ষ ঠিক করে দেওয়া হয় লেখাপড়া করে চাকরি করা। সেখানে মেয়ের ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত। স্বামী সন্তান নিয়ে যত তাড়াতাড়ি ঘর কন্যার কাজে লেগে পরা যায় ততই মঙ্গল! এটাই বিপরীত চিত্র। এবং আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিত্য ঘটনা। কিন্তু উন্নয়ন করতে হলে এসব অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা চাই সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘ্ন। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। এই যে একটা শিশুর শৈশব নষ্ট করে তার ওপর সংসার চাপিয়ে দেওয়া হয় যা তার জীবনকে ঝুঁকির মধ্য ফেলছে তা একটি বড় অপরাধ। অনেক সময় সবার অগোচরেই বিয়ের কাজটি সমাধা হয়ে যাচ্ছে। বাল্যবিয়ে আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। বাল্যবিয়ে বিষয়টি উদ্বেগজনক আমাদের জন্য।

আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই উন্নয়নের সহযোগী নারী ও পুরুষ উভয়ই। আমরা যদি নারীকে বাল্যবিয়ের মাধ্যমে উন্নয়নের দ্বার থেকে দূরে রাখি তার আমাদের জন্যই বুমেরাং হবে। নারী শিক্ষা অপরিহার্য এবং বর্তমানে একজন নারী ও পুরুষ উভয়কেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া আবশ্যকতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রধান বাধা বাল্যবিয়ে। এর জন্য শুধু আইন যথেষ্ট নয়। এর জন্য সচেতনতা প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যরা যদি সচেতন না হয় তাহলে এটা ঠেকানো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হবে। মাঝে মধ্যে দু’একটি প্রতিবাদের খবর প্রকাশিত হলেও বেশিরভাগই তা থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। নারীর মেধা এবং পারদর্শীতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। অধিকার ফলানোতেই যেন তাদের আনন্দ সিমাবদ্ধ। নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে আমাদের আরও সুদৃঢ় হতে হবে। অথচ কেবল বাল্যবিয়ে নয় যৌতুক, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রহ, পরিবারে অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রই যেন নারীদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে। পরিবার এবং পরিবারের বাইরে নারীর নিরাপত্তা যেন কোথাও নেই। যৌতুকের আগুনে আজও আমাদের সমাজে বহু নারীর জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শহর বা গ্রাম, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সব প্রকারের পরিবারেই যৌতুক নামের একটি কাঁটা রয়েছে। মূলত বাল্যবিয়ে এক ভয়ংকর প্রাচীন কিন্তু আধুনিক জীবনের আদিমতা থেকে আজও বের হতে পারেনি বিশ্বের অনেক দেশই। কারণ কেবল বাংলাদেশ নয় ভারত, পাকিস্থানসহ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের প্রধান বাধা এই বাল্যবিবাহ। এমন পরিবারও রয়েছে যেখানে বাল্যবিয়ে দেওয়াটাই একধরনের রীতি! বিয়ে দেওয়াতেই যেন মুক্তি! এছাড়াও দারিদ্রতার কারণে মেয়েকে যত দ্রুত বিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল এই ধারণায় বিয়ে দেয়। মোট কথা বাল্যবিয়ের যে কয়েকটি কারণ রয়েছে সেসব ইচ্ছে করলেই দূর করা যায়। শুধু দরকার পারিবারিক সমর্থন। আর বাল্যবিয়ের কারণেই দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং হবে। তাই বাল্যবিয়ে মুক্ত দেশ গড়তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিজ্ঞাপন

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন