বিজ্ঞাপন

ব্রাজিলের কি বিদেশি কোচ প্রয়োজন?

December 27, 2022 | 4:53 pm

মো. সাইফুল আলম তালুকদার

ব্রাজিল কেন ২০০২‌ সালে বিশ্বকাপ জেতার পর থেকে টানা চারটি বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল ও একটি সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় প্রতিপক্ষের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে ধরাশায়ী হওয়ার কারণ বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে তাদের কোচদের ব্যর্থতার ইতিহাস। আমি একজন ব্রাজিল সমর্থক হিসেবে নিজ দলের পোস্টমর্টেম করার চেষ্টা করেছি।

বিজ্ঞাপন

ব্রাজিল যদিও এর আগে পাঁচটি বিশ্বকাপ জিতেছে তাদের স্ব-জাতীয় কোচদের নেতৃত্বে, তবে এখন কি পরিবর্তন আসন্ন? তার আগে দেখা যাক ব্রাজিলীয় কোচদের ইউরোপীয় ফুটবল, নিজস্ব ঘরোয়া লিগ এবং জাতীয় দলের গত কয়েক দশকে তাদের পারফরম্যান্স কেমন ছিল।

ইউরোপে ব্রাজিলিয়ান কোচদের সাফল্য কেমন ছিল

কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা
১৯৯৪ বিশ্বকাপ বিজয়ী পেরেইরা চার দফায় ব্রাজিল দলের কোচ এবং টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ছিলেন প্রায় ৯ বছর। তিনি আদতে বিখ্যাত ছিলেন জাতীয় দলগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য। ব্রাজিল ছাড়াও প্রায় ১৫ বছর কোচ ছিলেন ঘানা, কুয়েত, আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের। বোরা মিলুতিনোভিচ এবং তিনিই পাঁচটি ভিন্ন দলকে বিশ্বকাপে কোচিং করিয়েছেন। ৪৭ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে ১৬টি দলকে কোচিং করানো এই কোচ, স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া এবং তুরস্কের ফেনারবাচের সঙ্গে ইউরোপে ছিলেন এক বছর করে মাত্র দুই বছর। ‌‌‌‌‌

লুইজ ফেলিপ স্কোলারি
এই কোচ ব্রাজিল জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দুইবার। ২০০১-০২ এবং ২০১২-১৪ সালে। ব্রাজিলের সর্বশেষ বিশ্বকাপজয়ী কোচ স্কোলারি। আবার নিজ দেশে ২০১৪তে জার্মানির কাছে বিশ্বকাপে ১-৭ গোলে পরাজয়েরও সাথী ছিলেন এই কোচ। ব্রাজিল দলে দুই দফায় তিন বছরের জন্য কোচ থাকলেও পর্তুগাল জাতীয় দলে ছিলেন পাঁচ বছর। ২০০০ সালের পর থেকে তাকেই ব্রাজিলের সেরা কোচ বলা যায়, কারণ তিনি পর্তুগালকে ২০০৪ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ এবং ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে পর্তুগালকে সেমিফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর চেলসিতে চলে আসেন এবং ‘বিগ ফিল’ ডাকনাম অর্জন করেন। কিন্তু চেলসিতে টিকে ছিলেন মাত্র এক বছর, ফলে সাফল্যের অভাবে তার ইউরোপীয় ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় ২০০৯ সালে। ৪০ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে ২৩টি ভিন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যিনি কিনা কুয়েত জাতীয় দলকেও কোচিং করিয়েছেন ১৯৯০ সালে।

বিজ্ঞাপন

ভ্যান্ডারলেই লুক্সেমবার্গো
১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিল দলের কোচের দায়িত্বে থাকা এই কোচ রিয়াল মাদ্রিদের হাল ধরেছিলেন ২০০৪-০৫ মৌসুমে। রিয়াল মাদ্রিদে তিনি একমাত্র ব্রাজিলিয়ান কোচ ছিলেন। যদিও তার ফলাফল খারাপ ছিল না। তবে তিনি নাকি খেলোয়াড় এবং ক্লাব প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন এবং এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ৭০ বছর বয়সের এই কোচের কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা ৩৮ বছর হলেও স্পেন এবং চীনে কোচিং করিয়েছেন মাত্র এক বছর করে। তিনি সর্বমোট ২২টি ক্লাবের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। ব্রাজিলের পালমেইরাস ক্লাবে সর্বোচ্চ পাঁচ বার কোচিং করিয়েছেন আর চার বার করে যুক্ত ছিলেন ফ্ল্যামেংগো এবং সান্তোস ক্লাবের সঙ্গে।

অ্যাবেল ব্রাগা
৭০ বছর বয়সী এই কোচ তার ৩৭ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে ছোট বড় দল মিলিয়ে প্রায় ২৫টি দলকে কোচিং করিয়েছেন। কিন্তু ২০০০ সালে ফ্রান্সের মার্সেই এবং ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের লুগানোতে স্বল্প সময়ের কোচিং করানো ছাড়া ইউরোপের কোনো ক্লাবকে দীর্ঘমেয়াদে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা তার নেই। শুধু তাই নয়, একমাত্র আরব আমিরাতের ক্লাব আল-জাজিরাতে সর্বোচ্চ চার বছর কোচিং করিয়েছেন দুটি ভিন্ন মেয়াদে, সর্বোচ্চ তিন বছর ছিলেন ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। শুনতে খুবই হাস্যকর লাগলেও এটাই সত্য যে, তিনি ব্রাজিলের ইন্টারন্যাসিওনাল ক্লাবে ৭টি ভিন্ন দফায় কোচিং করিয়েছেন। ব্রাজিলের আর কোনো ক্লাবে এক থেকে দুই বছরের বেশি কোচিং করাতে সক্ষম হননি।

জিকো
ব্রাজিলের কোচ হিসেবে বোধহয় তিনিই ইউরোপে কিছুটা সফল ছিলেন কিন্তু সেটাও মাত্র কয়েক বছরের জন্য। চার বছর তিনি ইউরোপে ছিলেন তুরস্কের ফেনারবাচে, রাশিয়ার সিএসকে মস্কো এবং গ্রিসের অলিম্পিয়াকোস ক্লাবের সঙ্গে।‌ সবচেয়ে ভালো মৌসুম কাটিয়েছেন ফেনারবাচেতে, যাদের তিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে দিয়েছিলেন ২০০৭-০৮ সালে। ৬৯ বছর বয়সী এই কোচ ১১টি দলের সঙ্গে কাজ করেছেন গত ২২ বছরে। এর মধ্যে ১৪-১৫ বছর কাজ করেছেন এশিয়াতে বিশেষ করে জাপানে প্রায় ৯ বছর ছিলেন জাতীয় দল এবং বিভিন্ন ক্লাব দলের সঙ্গে। জাপান দলকে ২০০২ সালের বিশ্বকাপে কোচিং করিয়েছেন। আর ইরাকের জাতীয় দলে ছিলেন এক বছর। এমনকি ভারতীয় ফুটবলেও কাজ করেছেন এক বছর। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় ইউরোপীয় দলে কাজ করার সুযোগ ঘটেনি।

আর্জেন্টিনার কোচদের সাফল্য বেশি
ইউরোপে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে সুপরিচিত দুইজন কোচ হলেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সঙ্গে ১১ বছর ধরে কাজ করা ডিয়েগো সিমিওনে এবং প্যারিস সেন্ট জার্মেইর মাউরিসিও পোচেত্তিনো।

বিজ্ঞাপন

৫২ বছর বয়সী সিমিওনে ২০১১ সালে ইতালির কাতানিয়া ক্লাবের হয়ে ইউরোপে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করার আগে ৪ বছর আর্জেন্টিনার চারটি ভিন্ন ক্লাবে এক বছর করে কোচ ছিলেন। কম বাজেটের দল নিয়েও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে দুই বার লা লিগা ও দুই বার ইউরোপা লিগের শিরোপা এবং এই বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রানার্সআপ করেছেন।

অন্যদিকে ৫০ বছর বয়সী  পোচেত্তিনো তার ১৩ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারের পুরোটাই এখন পর্যন্ত কাটিয়েছেন ইউরোপে।‌‌‌‌‌ পোচেত্তিনো আক্রমণাত্মক ধারায় খেলায় বিশ্বাসী আর সিমিওনে কিছুটা রক্ষণাত্মক মানসিকতার। তবে পোচেত্তিনো এখন পর্যন্ত কোনো শিরোপাই জিতেননি। কিন্তু ২০১৩‌ সালে সাউদাম্পটনকে‌ প্রিমিয়ার লিগের এই পর্যন্ত সেরা অষ্টম স্থানে তুলে এনেছিলেন। তবে তার সেরা সাফল্য হচ্ছে টটেনহামকে ২০১৬-১৭ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের এবং ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রানার্সআপ করানো।‌

কিছুটা পাগলাটে কোচ বলে খ্যাত মার্সেলো বিয়েলসা আর্জেন্টিনা ও চিলি জাতীয় দলের কোচ ছাড়াও ইউরোপের ৬টি বিভিন্ন ক্লাবে ১২ বছর কোচিং করিয়েছেন। তার জীবনী প্রায় ৪৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। হোর্হে সাম্পাওলি‌ বিয়েলসার মতো আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে সফল না হলেও তিনি চিলিকে ২০১৫ সালের কোপা আমেরিকা শিরোপা জিতিয়েছিলেন নিজ দেশ আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করে। জেরার্ডো মার্টিনো মেক্সিকোকে তিন বছর‌ কোচিং করিয়ে এনেছিলেন এই বছরের বিশ্বকাপে। হোসে পেকারম্যানও বিয়েলসা, সাম্পাওলি‌ এবং মার্টিনোর মতো আর্জেন্টিনা দলে সফল না হলেও কলম্বিয়াকে ৬ বছর কোচিং করিয়েছেন এবং ২০১৪ ও ২০১৮ বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি কলম্বিয়াকে ২০১৪ সালে ১৬ বছর পর বিশ্বকাপে ফিরিয়ে আনেন এবং ২০১৮ সালে তাদেরকে দ্বিতীয় রাউন্ডে উন্নীত করেন। তিনি এখন ভেনিজুয়েলা জাতীয় দলের কোচ হিসেবে কাজ করছেন।

রিকার্ডো গ্যারেকা ২০১৮ সালে পেরুকে বিশ্বকাপে ৩৬ বছর পর খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে সাহায্য করেছিলেন, যিনি পেরু জাতীয় দলের সঙ্গে সাত বছর কাজ করেছেন। গুস্তাভো আলফারো‌ ইকুয়েডরকে কোচিং করাচ্ছেন ২০২০ সাল থেকে এবং এবছরের বিশ্বকাপে তিনি ইকুয়েডরকে আকর্ষণীয় ফুটবল খেলতে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

স্প্যানিশ লিগের অন্যতম সফল কোচ ছিলেন, হেক্টর কুপার। যিনি স্পেন এবং ইতালি লিগে ৭টি দলকে ১১ বছর কোচিং করানোর পাশাপাশি মিশরকে ২০১৮ বিশ্বকাপে নিয়ে এসেছিলেন ২৮ বছর পর। স্পেনের রিয়াল‌ মায়োর্কা ও ভ্যালেন্সিয়া ক্লাবকে ১৯৯৮-৯৯, ১৯৯৯-২০০০ ও‌ ২০০০-০১ মৌসুমে উয়েফা উইনার্স কাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রানার্সআপ করান।‌‌ তিনি ২০০০ সালে ইউরোপের বর্ষসেরা কোচ নির্বাচিত হন। এছাড়া এদুয়ার্দ বেরিজো প্যারাগুয়ে এবং চিলিকে কোচিং করানো ছাড়াও স্প্যানিশ লা লিগার তিনটি দলকে পাঁচ বছর কোচিং করিয়েছেন। ‌

সারা বিশ্বে ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, জার্মানির পরে আর্জেন্টিনার কোচরা কোচিং করিয়ে যাচ্ছেন যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে। কারণ তাদের দেশে জাতীয়ভাবে কোচ তৈরি করার কর্মশালা হাতে নেওয়া হয়েছিল সেই ১৯৬৫ সালে। আর তাদের দেশে এসে বিদেশিরা কোচিং করানো শুরু করেছিলেন ১৯১১ সাল থেকে। অথচ ব্রাজিলের কোচরা কোচিং করানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা দশের মধ্যেও নেই।‌

ব্রাজিলের কোচরা কেন পিছিয়ে আছেন

১. জিকো থেকে শুরু করে অ্যাবেল ব্রাগাদের ব্যর্থতার কারণে অন্যান্য কোচরা ইউরোপে যেতে ভয় পান।

২. তারা ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ বা স্প্যানিশ ভাষায় দুর্বল।

৩. অর্থের কারণে বেশিরভাগ সময় তাদের চোখ থাকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ যেমন আরব আমিরাত, কাতার বা সৌদি আরবে কোচিং করানোর দিকে।

৪. অ্যাবেল ব্রাগা বা লুক্সেমবার্গোরা ইউরোপে ব্যর্থ হলেও নিজ দেশে তাদের একটি মার্কেট ছিল, অর্থাৎ ব্রাজিলিয়ান লিগে কোনো কোচ ব্যর্থ হলেই ব্রাগা বা লুক্সেমবার্গোদেরকেই ক্লাবগুলো খুঁজে নিত। ফলে ইউরোপে ফিরে যাবার তাড়না তাদের মধ্যে কখনোই ছিল না।

৫. মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বা নিজ দেশের ক্লাবগুলোতে কোচিং করিয়ে যাবার কারণে তাদের কোচেরা ইউরোপের ফুটবলের মতো চরম পেশাদারিত্ব বা প্রতিদ্বন্দিতামূলক ম্যাচগুলোতে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হচ্ছেন। মোটাদাগে বলা যায়, তাদের কোচিং উৎকর্ষ এ কারণেই সাধিত হচ্ছে না।

৬. ইউরোপে কোচিং করাতে ভিতু এই কোচেরা ইউরোপে আসছেন স্বল্পমেয়াদী কোচিং নিতে। আর এই নিয়ে লিভারপুলের জার্মান কোচ জার্গেন ক্লপ বলেছেন, ‘ব্রাজিলের ক্লাবগুলো যেভাবে কাজ করছে তা অবশ্যই ভুল। প্রশিক্ষক এক সপ্তাহ, এক মাস বা দুই-তিন মাসের জন্য আসেন এই আশা নিয়ে যে তারা বিস্ময়কর কাজ করতে পারবেন। কিন্তু এটা সম্ভব নয়।’

৭. লিভারপুলের হয়ে ক্লপের প্রথম শিরোপা জিততে সময় লেগেছিল প্রায় ৪ বছর। অথচ ২০২০ সালের নভেম্বর মাসের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ব্রাজিলীয় লিগে শীর্ষস্থানীয় ২০টি ক্লাবের মধ্যে ১৪ জন কোচ নভেম্বর মাসের মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন।‌‌ ব্রাজিলে সাধারণত গড়ে ১৫ ম্যাচ পরেই একজন কোচ তার চাকরি হারান। যদিও এক্ষেত্রে তাদের জাতীয় দলের কোচ তিতে ৬ বছর ব্রাজিল দলে থেকেও দুটি বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছেন। ‌‌

৮. অসওয়াল্ডো ডি অলিভেইরার একটি উদাহরণ দিচ্ছি, যিনি তার চাকরি জীবনে ব্রাজিলের শীর্ষ লিগে ১২টি ক্লাবের ১০টিতেই কোচিং করিয়েছেন। তিনি ফ্লুমিনেন্স এবং করিন্থিয়ানসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিন বার করে।‌‌ এছাড়াও দুই বার করে ফ্ল্যামেঙ্গো এবং সান্তোসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ক্লাবেই তিনি দুই বছরের বেশি থাকতে পারেননি। অর্থাৎ, ব্রাজিলের কোচরা নিত্যই একদল থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্য দলে যাচ্ছেন এবং ঘুরেফিরে ব্রাজিলে কাজ করার কারণে তাদের কাজের দক্ষতা এবং মনোবল দুটোই নিম্নগামী।

৯. আরেকজন তরুণ কোচ, ব্রুনো পিভেটির উদাহরণ দেওয়া যায়। ৩৬ বছরের এই কোচ ক্লপ এবং গার্দিওলার অনুসারী হয়ে বিভিন্ন ট্যাকটিকাল বিষয় নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। কিন্তু ভিতোরিয়া ক্লাবের হয়ে কোচ হিসেবে টিকতে পেরেছিলেন মাত্র ৮০ দিন। ‌‌

১০. এ সমস্ত পর্যালোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ব্রাজিলিয়ান লিগের কোচেরা এখন ৩-৪ ম্যাচে পরাজিত হলেই ছাঁটাইয়ের শিকার হচ্ছেন এবং দিনে দিনে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এটাই সত্য যে, ডোরিভাল জুনিয়র নামের এক কোচ একই বছরে ফ্ল্যামেঙ্গো, ভাস্কো দা গামা এবং ফ্লুমিনেন্সের কোচ ছিলেন। এই সংস্কৃতির পরিণতি অত্যন্ত ক্ষতিকর। শুধু যে কোচেরা তাদের সক্ষমতা পূরণ করতে পারছেন না তা নয়। ফলাফল হলো ব্রাজিলীয় ফুটবলের মান দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে, কারণ সব কোচ এখন ঝুঁকিবিহীন খেলা খেলতে বাধ্য হচ্ছেন।

১১. অনেকেই ডিফেন্সকে শক্ত রেখে ইউরোপীয়দের মতো প্রেসিং ফুটবল খেলার দিকে তাড়িত হচ্ছেন, কিন্তু তাতে মিডফিল্ডে ব্রাজিলীয় ফুটবলের সেই পূর্বেকার ঝলক হারিয়ে যাচ্ছে। এবারের বিশ্বকাপেই আমরা যেমনটা দেখেছি, ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলাররা মাঝমাঠ দখল করে ব্রাজিলীয়দেরকে অবশ করে রেখেছিল।

১২. শোনা যাচ্ছে মরিনহো, অ্যানচেলত্তি বা গার্দিওলাদের কাউকে আগামী দেড়-দুই বছরের আগে ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচ হিসেবে পাওয়া যাবে না। তাই অন্তর্বর্তীকালীন কোচদের মধ্যে নাকি এগিয়ে আছেন ফার্নান্দো দিনিজ। ৪৮ বছর বয়সের ফ্লুমিনেন্সের এই কোচ নাকি তার ১৩ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে ১৩টি ক্লাবকে কোচিং করিয়েছেন। অর্থাৎ, দিনিজ আসলে কোথাও সফল ছিলেন না। ব্রাজিল ফুটবল কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা নিশ্চয়ই যথেষ্ট শঙ্কার বিষয়।

ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগে কি ইউরোপীয় কোচের প্রয়োজন আছে?

ফ্ল্যামেঙ্গোকে ২০১৯ সালে ব্রাজিলিয়ান লিগে ও কোপা লিবার্তাদোরেসের শিরোপা উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে পর্তুগিজ কোচ হোর্হে জেসুসের সাফল্য পাবার পর থেকেই সেই চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তিনি ফ্ল্যামেঙ্গোকে ২০১৯ বিশ্ব ক্লাব কাপে রানার্সআপও করেছিলেন। তিনি ব্রাজিলিয়ান ক্লাব দলে প্রথম বিদেশি কোচ ছিলেন যিনি আন্তর্জাতিক শিরোপা (কোপা লিবার্তাদোরেস) জিতিয়েছিলেন এবং ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগের শিরোপা জিতিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিদেশি হিসেবে ৬০ বছর পর। তারপরেও তিনি এক মৌসুম পর ব্রাজিলের ক্লাব থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন দর্শকদের দুয়ো ধ্বনি, মিডিয়া, ভাষ্যকার এবং ফ্ল্যামেঙ্গোর প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সমালোচনায় জর্জরিত হয়ে।

পরবর্তীতে ২০২০ সালে ব্রাজিলের সেরা ১২টি দলের ৪টি দলেই পর্তুগিজ কোচ রিকার্ডো সা পিন্টো এবং অ্যাবেল ফেরেইরাকে দেখেছি যারা ভাস্কো দা গামা এবং পালমেইরাসে ছিলেন আর অন্যদিকে অ্যাটলেটিকো মিনেইরো এবং বোটাফোগোতে দেখেছি আর্জেন্টিনার জর্জ সাম্পাওলি এবং রেমন দিয়াজেকে।

পিন্টো ২ মাসের মধ্যে বরখাস্ত হলেও ফেরেইরা গত ২ বছরে পালমেইরাসকে কোপা লিবার্তাদোরেস শিরোপা ২০২০ এবং ২০২১ সালে পরপর দুবার জিতিয়েছেন। কোনো ব্রাজিলীয় ক্লাবকে কোপা লিবার্তাদোরেস শিরোপা হোর্হে জেসুসের পর দ্বিতীয় বিদেশি হিসেবে তিনিই জিতিয়েছিলেন। অর্থাৎ, এই দুই পর্তুগিজ ব্রাজিল ঘরোয়া ফুটবলে যোগদান করার পর ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের কোপা লিবার্তাদোরেস শিরোপা পরপর তিনবার ব্রাজিলের ক্লাবগুলো জিতেছে। আর্জেন্টিনার সাম্পাওলি ২০১৮ সালে সান্তোসকে ব্রাজিলিয়ান লিগে রানার্সআপ করার পরে অ্যাটলেটিকো মিনেইরোর দায়িত্ব নেন এবং এই দুটি ক্লাবে সর্বমোট দুই বছর কাটান।

বোটাফোগোর‌ দায়িত্ব নিয়েছিলেন আরেক আর্জেন্টাইন রেমন দিয়াজ, কিন্তু টিউমার অপারেশনের জন্য আর্জেন্টিনাতে ফেরত যাবার কারণে তিনি কোনো ম্যাচে কোচিং করাতে পারেননি। তার অবর্তমানে কোচের দায়িত্ব পালন করেছিল তার ছেলে এমেলিয়ানো দিয়াজ। অর্থাৎ, চার বিদেশি কোচের মধ্যে তিনজনই ব্রাজিলিয়ান ক্লাবগুলোতে স্বল্প সময়ের ভেতরে চমকপ্রদ ফলাফল প্রদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে কি প্রমাণিত হয় না ব্রাজিলের ঘরোয়া এবং জাতীয় দলে বিদেশি কোচের প্রয়োজন আছে?

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে গত কয়েক যুগ যাবত শিরোপা জিতিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন বিদেশি সব কোচরা।‌ ইংলিশদের এই ব্যর্থতাই আবার অন্যদিকে তাদের বিশ্বকাপ বা ইউরোর শিরোপা জিততে সাহায্য করছে না, যদিও ইংলিশ দলে ব্রাজিল জাতীয় দলের মতো গত কয়েক যুগে প্রতিভার কোনো অভাব ছিল না।

সারাবাংলা/আইই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন