বিজ্ঞাপন

যে পথের সূচনা করে দিয়ে গেছে ঐশ্বর্য

February 24, 2023 | 4:01 pm

হাসান মাহবুব

ঐশ্বর্য মারা গিয়েছে দেড় মাস হলো। বয়স কত ছিলো তার? উনিশ বা কুড়ি? না কি আরও কম? আমার সঠিক মনে পড়ছে না। শুধু জানি যে সে মারা গিয়েছিল অত্যন্ত কম বয়সে, এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে। সে মারা যাওয়ার পর আমার ফেসবুক নিউজফিডে প্রচারিত হলো তার মৃত্যুসংবাদ, কিছু মিউচুয়াল বন্ধুর সুবাদে তা জানা গেল। তাদের পোস্ট মারফত জানতে পারলাম ঐশ্বর্য ছিল এক প্রাণবতী কিশোরী। হিমু নামে এক অনুজের লেখা থেকে জানলাম, সে বইমেলায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করত। সিমু নাসের লিখল, কিশোর আলোর সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা। আফটারম্যাথ নামে একটা জনপ্রিয় রক ব্যান্ড প্রকাশ করল তাদের ইনবক্সে ঐশ্বর্যের অনুরাগমিশ্রিত মেসেজের কথা।

বিজ্ঞাপন

এসব থেকে আমরা জানতে পারি ঐশ্বর্য ছিলো প্রাণের ঐশ্বর্যে ভরপুর। সে ভালোবাসতো গান এবং বই। সে ভালোবাসতো মানুষের সাথে মিশতে। সে ভালোবাসতো পশু-পাখিদেরও। তার ফেসবুকের কভার পিকচার হিসেবে ছিলো একটা রাস্তার কুকুরকে আদর করার ছবি। ঐশ্বর্যকে তাই ভালো না বেসে পারা যায় না। বেশিরভাগই আবেগীয় কারণ। গান, বই বা পশুপাখি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে নাই হতে পারে। ভালো লাগার যেসব কারণ বলছি সেগুলি হয়তো সর্বজনগ্রাহ্য না। কিন্তু আমাদের ঐশ্বর্য এমন একটা কাজ করে গেছে, যেটা ওকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে সবার মাঝে।

ঐশ্বর্য মৃত্যুর আগে তার শরীর দান করে গিয়েছিল। আর তার শরীরের অংশ নিয়ে কিডনির জটিল রোগে ভোগা দুজন রোগীকে দেশে প্রথমবারের মতো দেওয়া হয়েছে শল্য চিকিৎসা। তার দেওয়া কর্নিয়ায় আলো দেখেছে অন্ধ দুজন। সেই রোগীরা কেমন আছে,তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে কি না, তাদের আয়ু বর্ধিত হয়েছে কি না, অথবা তারা পুরোপুরি সুস্থতার পথে ফিরে গেছে কি না এ সমস্ত তথ্যের হালনাগাদ আমরা পাইনি। পত্রিকায় নতুন খবরের ভীড়ে হারিয়ে গেছে। ঐশ্বর্যও কি তেমন করে ফেসবুকের ট্রেন্ডিং টপিক হয়ে হারিয়ে যাবে? ক’দিন ভাইরাল থাকার পর ওর কথা কি আর কারও মনে থাকবে না? তা হয় না। আর সেজন্যেই তার মৃত্যুর দেড় মাস পর এই লেখাটা লিখতে বসেছি। সে চলে যাওয়ার সাথে সাথেই লিখে ফেলার তাড়া ছিল না আমার। ঐশ্বর্য অধিগ্রহণ করেছে আমার অস্তিত্ব। আপ্লুত করেছে আমার মানবিকবোধ। আমার একচল্লিশ বছরের জীবনে এমন কোনো অর্থপূর্ণ কাজ কখনো করিনি, ঐশ্বর্য যা করে গেছে। আমি করিনি, আপনিও করেননি, আমাদের চারপাশের খুব কম মানুষেরই এমন কিছু করার সাহস বা মানসিকতা আছে।

ঐশ্বর্যকে নিয়ে এতক্ষণ বললাম আমার অনুভূতির কথা। এবার কিছু হার্ড ফ্যাক্টের কথা জানা যাক। গুগলিং করলাম তার সম্পর্কে। ঐশ্বর্যের যে রোগটা হয়েছিলো, তার নাম ‘টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস’। দূরারোগ্য এক ব্যাধি। চিকিৎসা তেমন নেই। মৃত্যু অনেকটাই নিশ্চিত এই ব্যাধিতে। তার দেহ থেকে কর্নিয়া এবং কিডনির অংশ নিয়ে দেওয়া হয়েছে চারজন রোগীকে। মৃত্যুর আগে সে তার দেহ দান করে যেতে বলেছিল। ব্রেইন ডেড অবস্থায় দিনকতক ছিলো সে। অবশেষে তার বাবা-মাকে সেই সিদ্ধান্তটি নিতে হয়, লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়ার। ঐশ্বর্যের দেহ ছেড়ে চলে যায় তার প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু সে রয়ে যাবে অন্যদের জীবনের গল্পে, গানে, আনন্দে। প্রত্যক্ষভাবেই। যে অপারেশনটি সেদিন করা হয়েছিলো, সেটি বাংলাদেশে এই প্রথম। এর পরে নিশ্চয়ই আরও এ রকম অপারেশন হবে, আরও অনেক মানুষের জীবন বাঁচবে, আরও অনেক মানুষ আশ্চর্য সুন্দর এই পৃথিবীকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করবে। ঐশ্বর্যের কল্যাণে সেই আন্দোলনের সূচনা হলো।

বিজ্ঞাপন

সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই, তবে এই অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে না পারার কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর বহু মানুষ মারা যায়। শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলালের ভাষ্যমতে সংখ্যাটা ‘লাখ লাখ’ হতে পারে। পরিসংখ্যানের দ্বারস্থ না হয়ে, একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ভাষ্য অনুযায়ীই আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে এটা একটা বিপুল সংখ্যা। বাংলাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। আমাদের যেরকম খাদ্যাভ্যাস, আর চারপাশে যেমন দূষণ, তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই সংখ্যাটা এমন বিকট আকার ধারণ করেছে। আমি জানি, নিশ্চিতভাবেই জানি, আপনার আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন অথবা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও কিডনি রোগী আছে। না থেকে পারেই না। কিডনি রোগের মতো ক্রনিক কষ্টকর রোগ আর হয় না। বিশেষ করে একবার ডায়ালিসিস শুরু হলে সারাজীবন এটা টেনে নেয়ার কষ্ট যে কী, তা ভুক্তভোগী এবং পরিবারমাত্রই জানেন। এদিকে ডায়ালিসিসের খরচও বাড়ছে। কদিন আগে হাসপাতালে এটা নিয়ে বিক্ষোভ, মারামারি, গ্রেফতার পর্যন্ত হয়ে গেলো।

মানবিকবোধে ভাস্বর ঐশ্বর্য আর আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রযুক্তিতে ঋদ্ধ আমাদের চিকিৎসকেরা মিলে যে অসাধারণ ঘটনাটির সূচনা করলেন, তার পুনরাবৃত্তি হোক বারবার। আর এজন্যে আমাদের ব্রতী হতে হবে কর্নিয়া এবং দেহদানে।

মরণোত্তর দেহ অথবা চক্ষু প্রদান বাংলাদেশে খুব সুলভ ঘটনা নয়। এ নিয়ে তেমন প্রচারণা নেই, আমাদের তেমন আগ্রহও জাগে না। অথচ কী অসাধারণ বিষয় এটি! মৃত্যুর পরেও আমার দেহাংশ বেঁচে থাকবে অন্য একজনের শরীরে। সে দেখতে পাবে জারুল ফুলের রং। তার শরীরে যন্ত্রণাদায়ক শল্যকার্যের প্রয়োজন হবে না। সে পাবে আরও কিছু অথবা অনেক বছর সুন্দর জীবনের আস্বাদ, এর চেয়ে সুন্দর কিছু কি আর হতে পারে? মানুষ এর থেকে ভালোভাবে কি অন্যের জীবনে অবদান রাখতে পারে? মানুষ সভ্য হচ্ছে, উন্নত হচ্ছে, মানুষ বানিয়ে ফেলতে পারে সুঊচ্চ দালান অথবা অতিক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক চিপ। কিন্তু মানুষ এখনও প্রতিস্থাপন করতে শেখেনি শরীরের ভেতরকার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। মানুষকে তাই ফিরতে হয় মানুষের কাছেই। দেহের অংশ অথবা পুরো দেহ দান করে আমরা হতে পারি এই অবিনশ্বর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কর্নিয়া দানের অঙ্গীকারকারি হয়েছেন আটত্রিশ হাজার মানুষ। আর কর্নিয়া প্রতিস্থাপন অপারেশন হয়েছে চার হাজারের মতো। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে সংখ্যাটি খুব বেশি নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, এই সংখ্যাটি বাড়ছে। খুব দ্রুত না, কিন্তু বাড়ছে। আঠারো বছরের ওপরের যে কেউ কর্নিয়া অথবা দেহ দিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করতে পারে। যেমনটা করেছিল ঐশ্বর্য। বয়স যত কম হবে, অঙ্গ তত সতেজ থাকবে। আর সেজন্যেই কি ঐশ্বর্য নিজেকে উৎসর্গ করে চলে গেলো তার বসন্তদিনে?

আপনার যদি এই লেখাটি পড়ে ইচ্ছে হয় দেহ অথবা কর্নিয়া দানের, তাহলে ইন্টারনেটে একটু ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন নিয়মকানুন। আমি এখানে বিশদ দিলাম না। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার সদিচ্ছা থাকলে একটু ঘেঁটে দেখার কষ্টটুকু তো করবেন, তাই না?

কথা হচ্ছে, আমি যে এতকিছু লিখলাম, আমি নিজে কি এই কাজটা করেছি? না, এখনও করি নি। তবে এই লেখার মাধ্যমে প্রতিজ্ঞা করছি, যাবতীয় আলসামি ভেঙে খুব দ্রুতই আমি কর্নিয়া অথবা দেহদানের জন্যে কাগজপত্র প্রস্তুত করে ফেলবো। যে পথে হেঁটে ঐশ্বর্য চলে গেছে স্বর্গের বাগিচায়, আমিও সে পথ ধরেই সেখানে যেতে চাই।

ফুটনোট: ঐশ্বর্যের পুরো নাম ছিলো সারাহ রহমান ঐশ্বর্য। তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হয় ২০২৩ সালের ১৮ই জানুয়ারি।

বিজ্ঞাপন

লেখক: ব্লগার, কথাসাহিত্যিক

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন