বিজ্ঞাপন

আমাদের উৎসব আজকের আনন্দ

April 22, 2023 | 7:57 pm

অজয় দাশগুপ্ত

তখন মোবাইল বলে কিছু ছিল না। আমাদের আমলে কম্পিউটার বলে যে কিছু হতে পারে স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ। বাড়িতে একটি টেলিফোন সেট আর ফ্রিজ থাকা মানেই সে পরিবার বড়লোক। তখন আমরা ধনীদের বড়লোক বলতাম। আসলে তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন বড়লোক। তখনকার দিনে মানুষ সভ্য, শিক্ষিত আর ভদ্রলোক হলেই বড়লোক বলে গণ্য হতেন। হাতে গোণা বড়লোকের দেশে তখন যে কোনও উৎসব ছিল অপার আনন্দের উৎস কিন্তু নিতান্তই সাদামাটা। কেমন ছিল উৎসব?

বিজ্ঞাপন

মানুষে মানুষে যোগাযোগ ছিল সরাসরি। না ছিল কোনও বায়বীয় মিডিয়া না তেমন কিছু। সে কারণে আমাদের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল নিবিড়। কী আশ্চর্য! কোনও মোবাইল ছাড়া ফোন ছাড়াই আমরা ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যেতাম। কোনওদিন তার কোনও ব্যতিক্রম হতো না। বললে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে অথচ এটা সত্য যে আমরা পার্কে বসে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করার সময় বলে দিতে পারতাম কোনও রিকশায় তারা আসছে বা আসতে পারে। নব্বই ভাগ সত্য হতো আমাদের অনুমান। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে যাওয়া ব্যতীত আমাদের সাথে যোগাযোগহীন অভিভাবক মা বাবারা জানতেন ঠিক সময়েই ফিরে আসব আমরা। দেখা নাই কথা নাই তারপর ও কী বিশ্বাস আর কী নিশ্চিত নির্ভার জীবন। এখন প্রতি মূহুর্তে যোগাযোগ থাকার পর ও সে নির্ভরতা বা নিশ্চয়তা নাই।

আমাদের সহজ সরল জীবনযাপনে একটা নতুন জামা নতুন শাড়ি কিংবা পাতলুন কেনাটাই ছিল যথেষ্ট। চট্টগ্রাম শহরের বিলাসবহুল শপিং সেন্টার তখন নিউমার্কেট বা বিপণি বিতান। তার ভেতরে থাকা দু’খানা চলন্ত সিঁড়ি দেখার জন্য মানুষের সে কি আগ্রহ। আজ অনেকেই মনে করতে পারে অনাধুনিক পশ্চাৎপদ কোনও দেশ বা সমাজে বাস করতাম আমরা। কথাটা একেবারেই অসত্য। আমাদের শহর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হলেও রাজধানী নয় অথচ এই শহরের সিনেমা হল মাতিয়ে চলত হলিউডের নতুন নতুন যত মুভি। সোফিয়া লরেন থেকে ব্রিজিত বার্দোতের সমস্ত খবরাখবর ছিল আমাদের নখদর্পণে। আমাদের অগ্রজেরা স্বপ্নে সুচিত্রা সেন বা শবনমের প্রেমে পড়তেন। নারীদের স্বপ্নে ছিলেন দীলিপ কুমার বা ওমর শরীফের মতো নায়কেরা। আমরাও পিছিয়ে ছিলাম না। একটু বয়স হতে না হতেই আমাদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন মেধাবী অপর্ণা সেন বা দেশের কবরী।

ভাবতে অবাক লাগে একটা মাত্র টিভি চ্যানেল ছিল আমাদের। তাও সাদা কালো। একটি রেডিও কেন্দ্র। অথচ নাটক গান কবিতা সব মিলিয়ে আশ্চর্য! সুন্দর এক বিনোদন জগত। শুদ্ধতা তখন অধরা কিছু ছিল না। বরং শুদ্ধতার কাছে অতি জনপ্রিয়তা বা অপপ্রতিভা মাথা নুয়ে থাকতে বাধ্য হতো। সে কারনেই আমাদের আমলে কোনও হিরো আলমের জন্ম হতে পারত না। আমি হিরো আলমকে ব্যক্তিগতভাবে স্যালুট জানাই। সমাজের অতি প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ হিরো আলম। আশরাফুল থেকে হিরো হয়ে ওঠাটা আশ্চর্যের! কিন্তু আপত্তি হচ্ছে গান ভিডিও রাজনীতি সব তাকেই করতে হবে কেন? সেই কেন হবে টক অফ দ্যা কান্ট্রি? এ হচ্ছে পতনের ঈঙ্গিত। আমাদের না ছিল জমকালো রঙ্গিন টিভি পর্দা না সন্দেহ সংশয় তো ক্যামেরার কারসাজি। অথচ তখন হুমায়ূন আহমদ আমাদের দেশকে উপহার দিচ্ছিলেন নামকরা সব নাটক। এই হুমায়ূন আহমদই বেঁচে ছিলেন যুগের ডিজিটাল সময়ে। কিন্তু তখন আর পারেন নি। আর পয়দা হয়নি ‘বহুব্রীহি’ বা ‘কোথাও কেউ নাই’।

বিজ্ঞাপন

আমাদের ঈদের আনন্দ ছিল সত্যিকারের পারিবারিক। সকাল থেকেই শুরু হতো বাড়ি বাড়ি আনন্দযাত্রা। কি আশ্চর্য! অতি সাধারণ পোশাক আর সাধারণ খাবারেই বাঙালির ঈদ ছিল অসাধারণ। তখন হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান নির্বিশেষে উৎসব ছিল সবার। আজকের দিনে যেমন বিভেদ ফতোয়া আর ধর্ম ব্যবসায়ীদের বাতলে দেওয়া নানা তরিকা তখন এগুলোর নাম নিশানা ছিল না কোথাও। সন্দেহ সংশয় সংকোচের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল না জীবন। সত্যিকারের আনন্দ আর ভালবাসার কারণে উৎসব ছিল সর্বজনীন। তার মানে কি এখন আর তা সর্বজনীন না? এখনও হয়তো তা-ই কিন্তু এখন তো অনেক খটকা। এখন কে কার ছোঁয়া খাবে, কে খাবে না; কার জাত যাবে, কার দেওয়া খাবার খেলে ধর্ম লাটে উঠবে এসব নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নাই। এসব চিন্তা দুশ্চিন্তার ফাঁকে জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। ফলে উৎসবের বাহ্যিক জৌলুশ যাই হোক মনের রং ফিকে হয়ে আসছে ক্রমশ।

মাঝে মাঝে ভাবি, কেন এই দুর্দশা আমাদের? বিত্ত যখন চিত্ত থেকে বড় হয়ে যায় তখন কি এমন হয়? বিগত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের শরীরে নতুন হাওয়া লেগেছে। মানতে হবে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে জীবনে। সবচেয়ে বড় কথা দুনিয়ার আর সব দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশ এগুচ্ছে। কিন্তু মানুষ? যখনকার কথা লিখছি তখন একটা ভাল জামা বানানো বা কেনা ছিল স্বপ্নের মতো। আমার মনে আছে ঈদে আমরাও নতুন পোশাক পরার বায়না করতাম। কাপড় কিনে দেওয়ার জন্য মা বাবার কাছে আকুতি করতাম। ঈদ বা পূজায় এমন জামা কত কষ্ট করে পেতাম তা এখনকার প্রজন্ম ভাবতেও পারবে না। সে বাংলাদেশে পোশাক ছিল না। বিদেশ থেকে আসা সেকেন্ড হ্যান্ড বা পুরনো কাপড়ের স্তুপ থেকে বেছে বেছে মন্দের ভালটা নেওয়াই ছিল কৃতিত্ব। সে সময় আমার পিতা ছিলেন ব্যাংক চাকুরে। তাতে কি? নুন আনতে পান্তা ফুরায় তখন। প্রায় সবারই এক হাল। সরকারি ব্যাংকের সমবায় সমিতির মাধ্যমে কাপড় কেনার ব্যবস্থা ছিল। এক দুপুরে ব্যাংকের তিনতলায় গিয়ে তেমন এক ফালি সার্টের কাপড় কিনে যে নতুন জামা বানিয়েছিলাম তার গন্ধ এখনও নাকে লেগে আছে। তিনরাত প্রায় নিদ্রাহীন কাটিয়ে দর্জি বাড়ি থেকে নিয়ে আসা বেলবটম পাতলুনের মতো প্যান্ট ইহজীবনে আর পেলাম না। কত দেশ ঘুরলাম কত ব্র্যান্ডের পোশাক পরলাম কিন্তু তেমনটি আর কোনওদিন হল না, হল না তেমন আনন্দ।

অনেকে মনে করে আমরা বয়সের কারণে স্মৃতিভূক মানুষ। হয়তো। আমি একবার ও অস্বীকার করি নি যে, এখনকার প্রজন্ম- এখনকার সমাজ অনেক বেশী আগুয়ান। কিন্তু প্রযুক্তি আগুয়ান হলেই কি মানুষ আসলে এগিয়ে চলে? তা ছাড়া প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মগজ সীমাবদ্ধ। তার একটা ধারণ ক্ষমতা আছে। সে ধারণ ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কিছু নিলে তা হয় ওভারলোড। আজকের দুনিয়ার মানুষের মগজের বড় সমস্যা এই ওভারলোডিং। অনাবশ্যক এবং প্রয়োজনের বাইরে অনেককিছু তাকে গলধকরণ করতে হচ্ছে। আজে বাজে ইনফরমেশান সত্য মিথ্যা মিলে তার মগজের অবস্থা ঠাঁই নাই ওরে ঠাঁই নাই জাতীয়। এই গিজগিজ করা তথ্যের কারণে না সে হতে পারে আনন্দমুখর না আনন্দবিমুখ। কী এক মুশকিল! হাতের কাছে বিনোদন খোলা জগত নারীর হৃদয় জাগতিক সুখ পান পানীয় আবার সেই চোখের সামনেই বিধিনিষেধের পাহাড়। যে চোখে মানুষ আনন্দের ফোয়ারা দেখছে সে চোখই তাকে দেখায় পরকালের বিভীষিকা। এক চোখে যদি স্টিফেন হকিং থাকে তো আরেক চোখে কোনও আল্লামা। কোথায় যাবে মানুষ?

বিজ্ঞাপন

আমার বিশ্বাস মানুষ আনন্দের সন্তান। আনন্দই তার জীবন। তাকে ভয় ভীতি বা প্রলোভনে আটকে রাখা যায় না। যায় না বলেই তার ভেতর আনন্দ আর দ্রোহ একসাথে কাজ করে। আপাতত আমাদের তারুণ্যকে বিদ্রোহ বিমুখ মনে হলেও তারা আনন্দমুখি। সে কারণেই বদলে যাওয়া সময়েও আমাদের কোক স্টুডিও গান বাংলা কিংবা সিলোন চায়ের আড্ডায় আছেন রবীন্দ্রনাথ থাকেন নজরুল বা অতুল প্রসাদ। ঈদ আনন্দের অনিবার্য অনুষঙ্গ এখনও গান কবিতা নাটক বা নাচের মতো ধ্রুপদী শিল্পকলা।

বাংলাদেশের ইতিহাস অতীত আর বর্তমানের বড় শক্তি তার মাটি ও মানুষ। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি এই মাটি এমন সব মানুষের জন্ম দেয় যা ভাবা যায় না। সূর্য সেন থেকে ফকির লালন, হাছন রাজা হয়ে শহিদ রুমি বা জাহানারা ইমাম অসাধারণ এক তালিকা। আমাদের মাটিতেই জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের আনন্দের আরেক নাম বাংলাদেশ। যে দেশ না হলে বাঙালি তার আনন্দ উদযাপন করত অন্য কারও দেশে অন্য কারও অধীনে। আজ যারা নবজাতক, আজ যারা শিশু যাদের বয়স বায়ান্ন পার হয়নি তারা সবাই স্বাধীন। আমরা স্বাধীনতার পর স্বাধীন হয়েছিলাম নতুন দেশে। সে ও ছিল এক অপার্থিব অপার আনন্দ।

বয়স যত বাড়ছে ততো মনে হচ্ছে গতি কি প্রগতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে চাইছে? প্রার্থনা করি তা যেন না হয়। বাংলাদেশের ঈদ আনন্দ সর্বজনীন থাকুক। উৎসব হোক সবার।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন