বিজ্ঞাপন

ভারত-মিয়ানমার থেকে গরু আসায় বাজার নিম্নমুখী, হতাশ খামারিরা

July 1, 2023 | 10:59 pm

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: এবার কোরবানিতে লক্ষ্য অনুযায়ী গরু বিক্রি করতে পারেননি খামারি ও প্রান্তিক কৃষকরা। প্রকৃত বাজার মূল্যের চেয়ে প্রায় প্রতিটি গরুই হাঁটে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা কম বলা হয়েছে। বড় গরুর ক্ষেত্রে এই পার্থক্য ছিল কয়েক লাখ টাকাও। ফলে এবার অবিক্রিত রয়েছে বেশিরভাগ বড় গরু। প্রত্যাশা অনুযায়ী বিক্রি হয়নি ছোট গরুও।

বিজ্ঞাপন

খামারি ও উদ্যোক্তারা বলছেন, ঈদের দুদিন আগে থেকেই বাজার নেমে যায় পানির দরে। প্রস্তুতকৃত অন্তত ২০ শতাংশ গরু এবার অবিক্রিত রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কোরবানি এবার কম হয়েছে। আবার ভারত ও মিয়ানমার থেকে অবৈধ পথে গরু আসার কারণেও বাজার নিচে নেমে যায় বলে ধারণা উদ্যোক্তাদের।

যশোরের বাঘারপাড়া ভাঙ্গুড়াগ্রামে অবস্থিত আরজেড অ্যাগ্রো পার্কের মালিক শামীম রেজা। তিনি ৩ বছর ধরে খামার করছেন। এবার কোরবানির জন্য ৫৩ টি গরু প্রস্তুত করেছিলেন। বিক্রি করতে পেরেছেন মাত্র ১৫টি। খামারের সবচেয়ে বড় গরুটি এখনও অবিক্রিত রয়েছে। শামীম ১৫ মণের বেশি ওজনের ওই গরুটির দাম হেঁকেছিলেন ৮ লাখ টাকা। বিক্রেতারা সর্বোচ্চ দাম বলেছে ৪ লাখ ৬০ হাজার।

জানতে চাইলে শামীম রেজা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার খামারের গরু গুলোর মূল্য ১ থেকে ৮ লাখ টাকা। সবচেয়ে বড় গরুটি দাম কম বলায় বিক্রি করিনি। ওই গরুটি সাড়ে ৩ বছর পালন করেছি, ওজন প্রায় ১৫ মণ। আমরা ৮ লাখ টাকা দাম বলেছি, ক্রেতারা সর্বোচ্চ ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত বলেছে। অথচ এই গরুটিতে এখন পর্যন্ত আমরা খরচ হয়েছে সাড়ে ৫ লাখ টাকা।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘সাধারণত গরুর মাংসের মণ ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। অথচ কোরবানির হাটে ক্রেতারা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা মণে দিতে চায়। কোরবানির ক্ষেত্রে মাংসের কেজি ফেলতে চায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এ কারণে বড় গরু বিক্রি হয়নি। যে গরুর প্রকৃত বাজার মূল্য ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা, হাটে সেই গরুও এবার ৭০ থেকেত ৮০ হাজার টাকা বলা হয়েছে। এ কারণেই গরু বিক্রি করিনি। ভাবছি কয়েক দিন পরে এসব গরু কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেব। খামারের গরুর টেস্টও বেশি, তাই সাধারণ ক্রেতারা এসব গরুর মাংসের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাবেন।’

ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার বাঘবাড়ি গ্রামের জাহাঙ্গীর। দুই বছর ধরে ছোট্ট পরিসরে খামার গড়ে তুলেছেন। এবার কোরবানিতে ১০ থেকে ১২ টি গরু বিক্রির লক্ষ্য ছিল তার। তবে ঈদের আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এলাকায় রটে যায় গরু বিক্রি করতে না পেরে তিনি স্ট্রোক করেছেন।

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরের ভাই হান্নান সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে ভাই ফার্ম করছেন। সবচেয়ে বড় গরুর দাম উঠেছিল ৫ লাখ টাকা। খামারের কোনো গরুই এক লাখ টাকার নিচে নেই। বিক্রি করতে না পারায় বড় গরুটি ৪ লাখ টাকায় আমাদের চেয়ারম্যান (লংগাইর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ্ আল-আমিন বিপ্লব) কেনার প্রতিশ্রতি দিয়েছেন। সব মিলিয়ে খামারের দুটি গরু বিক্রি হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তিনি চাঁদ রাতে অসুস্থ হয়েছেন। এখন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। কোরবানিতে এবার খামারের গরু বিক্রি করতে পারিনি। দুটি গরু বিক্রি হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে অন্য গরু গুলোও বিক্রি করে দেব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ্ আল-আমিন বিপ্লব সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি প্রথমে শুনেছিলাম গরু বিক্রি করতে না পেরে জাহাঙ্গীর স্ট্রোক করেছে। পরে জেনেছি তার ব্রেইনে টিউমার হয়েছে। গরুর চিন্তায় সে চিকিৎসা করতে পারছিলেন না। পরে তার ভাইকে বলেছি, গরু বিক্রি নিয়ে টেনশন করার দরকার নেই। কয়েক মাস পর এই গরুটি জবাই করে বাজারে মাংস হিসেবে বিক্রি করব। মূলত জাহাঙ্গীরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্যই মাংস হিসাবে বিক্রির জন্য গরুটি কেনার উদ্যোগ নিয়েছি।’

গরগাঁওয়ের কুকশাইর গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম। তিনি অন্যের গরু লালন পালন করেন। এবার কোরবানির জন্য তিনি দুটি গরু প্রস্তুত করেছিলেন। রফিকুল বলেন, ‘আমরা গরু দুটির বাজার মূল্যই লাখ টাকার উপরে ছিল। অথচ একটি গরু বিক্রি করতে পেরেছি নব্বই হাজার টাকায়। দাম কম থাকায় অন্য গরুটি বিক্রি করিনি। যে গরুটি বিক্রি করেছি, কোরবানির প্রথম দিকে বাজারে উঠালে তা ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যেত।’

একই উপজেলার মাইজবাড়ি গ্রামের আলাল মিয়া বলেন, ‘আমার একটি ষাড় বাড়িতে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা দাম বলেছিল। অথচ কোরবানির বাাজরে বিক্রি করেছি মাত্র ১ লাখ ২৩ হাজার টাকা।’

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মো. ইমরান হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এবার গরুর দাম ৫ থেকে ৬ শতাংশ বেশি ছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও গোখাদ্যের ঊচ্চমূল্যের কারণে এটি স্বাভাবিকই ছিল। গত বছর লাইভ ওয়েটে ৪০০ কেজির নিচের গরু ৪৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছি, কিন্তু এ বছর একই ওজনের গরু ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছি। তার মানে গতবছরের চেয়ে এ বছর গরুর দাম ৫ থেকে ৬ শতাংশ বেশি ছিল। এবার কোরবানি কম হয়েছে। দেশে সবচেয়ে বেশি কোরবানি হয় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে। চট্টগ্রামে এবার মিয়ানমারের গরু ডুকেছে। বিভাগটিতে চাহিদার ৫০ শতাংশ মিয়ানমারের গরু দিয়ে কাভার হয়ে গেছে। এ কারণে প্রান্তিক কৃষকরা ছোট গরু বিক্রি করতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে অবৈধভাবে গরু ডুকেছে। আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও চেষ্টা করেছে। কিন্তু অবৈধপথে গরু আসা বন্ধ করতে পারেনি। ভারত থেকে এ বছর প্রচুর গরু এসেছে। এবার হাটে এতো বেশি গরু অবিক্রিত থাকতে দেখিনি। আমি ১৫ বছর যাবৎ ব্যবসা করছি- কিন্তু কখনও এত বেশি গরু অবিক্রিত থাকতে দেখিনি। আমরা ধারণা এবার দেড় থেকে দুই লাখ গরু অবৈধপথে দেশে ঢুকেছে। এ কারণেই গরু অবিক্রিত থেকেছে। এ কারণেই কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার বড় গরু অবিক্রিত রয়েছে। তবে ছোট গরু সব বিক্রি হয়ে গেছে। এবার কোরবানির জন্য প্রস্তুতকৃত গরুর মধ্যে ২০ থেকে ২২ শতাংশ গরু অবিক্রিত রয়েছে বলে আমার ধারণা।’

তিনি বলেন, ‘এবার কোরবানিও কম হয়েছে। আমার ধারণা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কোরবানি কম হয়েছে। আবার দাম বেশি হওয়ায় অনেকেই শেয়ারে কোরবানি দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা শহরের আশেপাশে অনেক ফার্ম হয়েছে। অনেকে আগে থেকেই ফার্ম থেকে গরু কিনে থাকেন। এ কারণেও হাটে গরুর দাম কম হয়ে থাকতে পারে।’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মন্ত্রণালয়য়ের তথ্যমতে, এ বছর ঈদুল আজহায় ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২ টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। গত বছর সারাদেশে কোরবানিকৃত গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩ টি। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২ টি। গত বছরের তুলনায় এবার ৯১ হাজার ৪৯ টি গবাদিপশু বেশি কোরবানি হয়েছে। এ বছর সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম পশু কোরবানি হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে। এ বছর সারাদেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩ টি। এবার কোরবানির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৯১ হাজার টি বেড়েছে বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দাবি করলেও উদ্যোক্তা ও খামারিরা এ তথ্যর সঙ্গে একমত নন। বরং তারা বলছেন, এবার অন্যবারের চেয়ে কোরবানি কম হয়েছে। প্রস্তুতকৃত কোরবানির সব পশু বিক্রিও হয়নি।

সারাবাংলা/ইএইচটি/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন