বিজ্ঞাপন

পুণ্যতিথি মহালয়া

October 14, 2023 | 12:30 pm

অভিরাজ নাথ

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গাপূজার পুণ্যলগ্ন, শুভ মহালয়া আজ শনিবার। শুরু হলো দেবীপক্ষ। শ্রীশ্রী চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহনই ‘মহালয়া’ হিসেবে পরিচিত। এ ‘চন্ডী’তেই রয়েছে, দেবী দুর্গার সৃষ্টির প্রশস্তি।

বিজ্ঞাপন

দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মহালয়া। পুরাণ মতে, এ দিন দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। তখন থেকেই দুর্গাপূজার দিন গণনা শুরু হয়। মহালয়া মানেই প্রতীক্ষা মায়ের পূজার। আর এ দিনেই দেবীর ‘চক্ষুদান’ করা হয়। পিতৃপক্ষের অবসান এবং দেবীপক্ষের শুরুর তিথি মহালয়া। অমাবস্যার পরবর্তী তিথি প্রতিপদ থেকে শুরু হয় দেবীপক্ষ, শুরু হয় দেবী দুর্গার আরাধনা। মহালয়া হচ্ছে, পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ। হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই শারদ আনন্দে মেতে উঠবে বাঙালি। তবে ইতিমধ্যেই সেজে উঠতে শুরু করেছে পূজামন্ডপগুলো। পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল বাঁধা চলছে জোর কদমে। বাংলা পঞ্জিকা মতে, আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে রীতি মেনে হয় মা দুর্গার বোধন।

এ বছর মহালয়া পড়েছে ১৪ অক্টোবর। এ বছরের মহালয়ার অমাবস্যাতেই রয়েছে গ্রহণ। সপ্তমী পড়েছে শনিবার। এবার মা দুর্গা আসছেন ঘোড়ায় চেপে। গমন ঘটবে একই বাহনে অর্থাৎ ঘোড়াতেই কৈলাসে ফিরবেন দেবী। আগামী ২০ অক্টোবর থেকে ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে দুর্গাপূজা শুরু হলেও মূলত আজ থেকেই দুর্গাপূজার আনন্দধ্বনি শুনতে পাওয়া যাবে। পূজার এই সূচনার দিনটি, সারা দেশে আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপিত হচ্ছে। ভোরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য মন্দিরে এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

পুরাণে আছে, মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। শিবের বর অনুযায়ী, কোনো মানুষ বা দেবতা কখনো মহিষাসুরকে হত্যা করতে পারবে না। ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে এবং বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর হতে চায়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব সম্মিলিতভাবে ‘মহামায়া’র রূপে অমোঘ নারীশক্তি সৃষ্টি করলেন এবং দেবতাদের ১০টি অস্ত্রে সুসজ্জিত সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা ৯ দিনব্যাপী যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করে। মহালয়ার আর একটি দিক হচ্ছে, এই তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে, এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকে ‘মহালয়া’ বলা হয়। পিতৃপক্ষের শেষক্ষণ ও দেবীপক্ষের সূচনাকালের সময়কেই মহালয়া বলা হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রলয়কালে পৃথিবী এক বিরাট কারণ সমুদ্রে পরিণত হলে শ্রীবিষ্ণু সেই সমুদ্রের ওপর অনন্তনাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন। এ সময় বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্য নির্গত হয়ে বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হলো। ভীত হয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করার জন্য তার নয়নাশ্রিতা যোগনিদ্রাকে স্তব করতে লাগলেন। সৃষ্টি হয়ে দেবী শ্রীবিষ্ণুকে জাগরিত করলে তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সঙ্গে মহাযুদ্ধে রত হলেন। পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ হচ্ছে মহালয়া। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ শুরু হয়ে পরবর্তী অমাবস্যা পর্যন্ত সময়কে পিতৃপক্ষ বলে। পুরাণ মতে, ব্রহ্মার নির্দেশে পিতৃপুরুষরা এই ১৫ দিন মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসেন। তাই এ সময় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু অর্পণ করা হলে তা সহজেই তাদের কাছে পৌঁছায়। তাই গোটা পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষদেব স্মরণ ও মননের মাধ্যমে তর্পণ করা হয়। যার চূড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হলো এই মহালয়া। অনেকেই এই দিনটিকে দেবীপক্ষের সূচনা বলে থাকেন। এটি একটি জনপ্রিয় কৃতকর্ম। মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষ দিন। পরের দিন শুক্লা প্রতিপদে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। সেই দিন থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫ দিনই হলো দেবীপক্ষ। যা চন্ডী মধু- কৈটভারী, দৈত্য দলনী, যা মহিষমর্দিনী, যা দুর্গে চন্ড মুন্ডোমালিনী, যা রক্ত বিজশ্বরী, শক্তি সুন্দরী সুন্দর দৈত দলনী। আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জিল, ধরণীর বহির্আকাশে-অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তর আকাশে জাগরিত জোতির্ময়ী জগৎমাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রশলোকে আনে নবভাব মাধুরীর সঞ্জীবন, ত্রাহী আনান নন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে-মৃন্ময়ীকে আবাহন। আজ শক্তিরূপিণী বিশ্বজননীর শারদও শ্রীমন্ডিত প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানগ্রহীতা। মহামায়া-সনাতনী শক্তিরূপা গুণাময়ী-হে ভগবতী মহামায়া তুমিই ত্রিগুণাতিকা, তুমিই রজগুণে ব্রহ্মার গৃহিণী বাগদেবী, শপ্তগুণে বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী, তমগুণে শিবের বনিতা পার্বতী, আবার ত্রিগুণাতীত তুমিই অর্নিবচ্চনিয়া, আবার দেব ঋষি কন্যা কাত্যায়নের কন্যা কাত্যায়নী, তিনিই কন্যাকুমারী আখ্যাতা দুর্গে, তিনিই দাক্ষ্যয়নী সতী, তিনিই আদিশক্তি, দেবী দুর্গা নিজদেহ সম্ভুত তেজপ্রবাহে শত্রুদহনকালে অগ্নিবর্ণা, অগ্নি লোচনা, এই ঊষালগ্নে হে মহাদেবী তোমার উদ্বোধনে প্রাণের ভক্তিরশে আলোকিত হোক দিকে দিকে, হে অমিতজ্যোতি, হে মা দুর্গা, তোমার আবির্ভাবে ধরণী হোক প্রাণময়ী, জাগো জাগো মা। জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণ ধারিণী, অভয়াশক্তি বল প্রদায়নী তুমি জাগো দেবী প্রসীদ পরিপালয়ে নো হরি ভীতে: নিত্যং যথাসুরবধদিধনৈব সদ্য: পাপানি সর্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশু উত্পাতপাকজনিতাংশ্চ মহোপসর্গানা।

শাস্ত্রমতে, মহালয়া হচ্ছে একটি অমাবস্যা তিথি, এ তিথিতে সাধারণত পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ তর্পণ করা হয়। এ দিন তর্পণ করলে পিতৃপুরুষরা নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে আমাদের আশীর্বাদ প্রদান করেন। এ ছাড়া মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গার বোধন করা হয়, বোধন অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার পর দেবীপক্ষের/শুক্লপক্ষের প্রতিপদে ‘ঘট’ বসিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজার সূচনা করা হয়। শ্রাবণ থেকে পৌষ ছয় মাস দক্ষিণায়ণ, দক্ষিণায়ণ দেবতাদের ঘুমের কাল। তাই বোধন করে দেবতাদের জাগ্রত করা হয়। মহালয়ার পর প্রতিপদে যে বোধন হয় সে সময় সংকল্প করে দুর্গাপূজার আয়োজন চলে। একে বলে কল্পরম্ভা। যদিও ষষ্ঠী থেকে পূজার প্রধান কার্যক্রম শুরু হয় তাই বলা হয় ষষ্ঠাদিকল্পরম্ভা। এবং সপ্তমী থেকে বিগ্রহতে। প্রতিপদ থেকে শুধু ঘটে পূজা ও চ-ী পাঠ চলে। দশমীর দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এবারের শারদীয় উৎসব সম্পূর্ণ হবে।

লেখক: কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন