বিজ্ঞাপন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ২ বছর, কেউ জানে না শেষ কোথায়

February 24, 2024 | 10:29 am

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

একবিংশ শতাব্দীতে এসে সভ্যতার অগ্রগতির নিদর্শন রেখে মানুষ যুদ্ধ-বিগ্রহ ভুলে যাবে— নতুন শতাব্দীর শুরু থেকেই এমন প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছিল বিশ্ববাসী। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা অলীক প্রমাণ করে এই শতকে এসেও একের পর এক প্রত্যক্ষ সব যুদ্ধে জড়িয়েছে দেশের পর দেশ। গত দুই বছর ধরে কেবল বিবদমান দুই দেশ নয়, সারাবিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতি নানাভাবে প্রভাবিত হলেও রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ ঠিকই চলমান রয়েছে। বিজয়ের আশায় রাশিয়া আর প্রতিরোধে সাফল্যের আশায় ইউক্রেন ঠিকই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, যে যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে।

বিজ্ঞাপন

দিনটি ছিল ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ইউক্রেনে সরাসরি হামলা চালায় রাশিয়া। এরপর দুই বছরের যুদ্ধে কেউই উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি। হাজার হাজার প্রাণ ঝরেছে, হাজার মা-বাবা সন্তানহারা হয়েছেন। শহরের পর শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। লাখো মানুষ হয়েছে বাস্তুহারা। যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মেরুকরণ আরও প্রশস্ত হয়েছে। দেশে দেশে অবিশ্বাস বেড়েছে। এত সব কিছুর বিনিময়ে ইউক্রেন বা রাশিয়ার অর্জন সামান্যই।

শান্তির সম্ভাবনাও এই মুহূর্তে ম্লান। উভয় পক্ষই চায় অন্যপক্ষের চূড়ান্ত পরাজয়। যুদ্ধ পূর্ববর্তী মতবিরোধ একটুও কমেনি। কিয়েভ চায় মস্কো তার সমস্ত আঞ্চলিক দাবি পরিত্যাগ করুক, ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে তার বাহিনী প্রত্যাহার করুক এবং ক্ষতির জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিক। অন্যদিকে মস্কো জোর দিয়ে বলছে, ইউক্রেন নিরপেক্ষ, জোটহীন ও পারমাণবিক অস্ত্রের মতো বিধ্বংসী অস্ত্র সংগ্রহের অবস্থান থেকে ফিরে আসুক। পাশাপাশি ইউক্রেনে রুশভাষী নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করুক।

রুশ হামলায় চ্যাপলাইন শহরের আবাসিক এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ছবি: বিবিসি

রুশ হামলায় চ্যাপলাইন শহরের আবাসিক এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ছবি: বিবিসি

যুদ্ধের দুই বছরের মাথায় এসে ইউক্রেন এখন বিধ্বস্ত-বিষণ্ণ। বেশ কয়েকটি প্রধান শহর ও ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে রুশদের হাতে। যুদ্ধের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির আগের সপ্তাহে খারাপ খবর পেয়েছে ইউক্রেনীয়রা। গত সপ্তাহে পূর্বাঞ্চলীয় শহর আভদিভকা দখল করেছে রুশরা। গত ৯ মাসে ইউক্রেনে রুশদের এটাই বড় কোনো শহর দখলের ঘটনা। কয়েক মাস ধরে অনবরত বোমাবর্ষণ ও কয়েক শ প্রাণ ঝরার পর শহরের দখল নিয়েছে রুশ সেনারা।

বিজ্ঞাপন

প্রায় ৩০ হাজার বেসামরিক নাগরিকের আবাস এই শহরটি ছেড়ে চলে গেছে প্রায় সবাই। শহরটি যুদ্ধ কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও যুদ্ধরাজনীতিতে এর দখল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগামী মার্চে রাশিয়ায় নির্বাচনের আগে এই সাফল্য স্বস্তি দেবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে।

রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের শিকড় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পরবর্তীকালে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে ইউক্রেনের উত্থানের মধ্যে নিহিত। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণের কারণে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বছরের পর বছর ধরে চলছিল। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে দখল করে নেয় রাশিয়া। এর পর থেকে ইউক্রেন-রাশিয়ার দ্বন্দ্ব ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। রাশিয়ার এই পদক্ষেপ অঞ্চলটিকে অশান্তিতে নিমজ্জিত করে এবং পূর্ব ইউক্রেনে চলমান সংঘাতের মঞ্চ তৈরি করে।

যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ঘটনা

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার সেনাদের ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন। এর তিন দিন আগে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মস্কো। এর আগে অবশ্য কয়েক মাস ধরে ইউক্রেন সীমান্তে ভারী অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত রুশ সৈন্য সমাবেশ ঘটায় মস্কো। ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট পুতিনের আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সীমান্ত ভেদ করে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। তবে সীমান্তে রুশ সেনাদের উল্লেখযোগ্য কোনো বাঁধা দেয়নি ইউক্রেনীয় সেনারা। রুশ সেনারা সীমান্ত অঞ্চলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ সেনাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। পরে তারা প্রধান প্রধান শহরগুলোর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

বিজ্ঞাপন

প্রাথমিক পর্যায়ে রুশ বাহিনী কিয়েভের দিকে উল্লেখযোগ্য গতিতে অগ্রসর হতে থাকে। তবে শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রতিরোধের মুখে কিয়েভ দখল সম্ভব হয়নি রুশদের।

ইরপিন ও বুচায় ভয়ংকর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই দুই শহরে রুশ সেনারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় বলে দাবি করে ইউক্রেন। কিয়েভ অভিযানে উল্লেখযোগ্য সাফল্য না পাওয়ায় মার্চের শেষের দিকে কিয়েভ ও চেরনিহিভ অঞ্চলে সামরিক কার্যকলাপ কমিয়ে দেয় রাশিয়া। সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ২ এপ্রিল ইউক্রেন ঘোষণা করে, সমগ্র কিয়েভ অঞ্চল রুশ সেনাদের কবল থেকে পুনরুদ্ধার হয়েছে।

যুদ্ধে লিসিচানস্ক শহরে ধ্বংস হওয়া ভবন, ছবি: আলজাজিরা

যুদ্ধে লিসিচানস্ক শহরে ধ্বংস হওয়া ভবন, ছবি: আলজাজিরা

২০২২ সালের ৪ মার্চ রুশ বাহিনী জাপোরিঝিয়ায় ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দখল করে। এতে পরমাণু বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়। মস্কো ও কিয়েভ নিয়মিতভাবে একে অন্যের বিরুদ্ধে পারমাণবিক কেন্দ্রের আশপাশে অপরিণামদর্শী গোলাগুলির অভিযোগ তুলে।

ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম প্রধান শস্য রফতানিকারক দেশ। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর কৃষ্ণ সাগরে শস্যবাহী জাহাজ চলাচল অনিরাপদ হয়ে পড়ে। এতে ইউক্রেনের শস্য রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গোটা বিশ্ব খাদ্য সংকটে পড়ে। মূল্যস্ফীতি লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে কৃষ্ণসাগরের বন্দর ব্যবহার করে শস্য রফতানির জন্য একটি শস্যচুক্তি হয়। এতে শস্যবাহী জাহাজে কোনো বাধা না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় কিয়েভ ও মস্কো।

বিজ্ঞাপন

তুরস্ক ও জাতিসংঘ এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে। চুক্তির অধীনে কৃষ্ণসাগরের প্রবেশদ্বার ও প্রস্থানে যৌথ পরিদর্শন পরিচালনা এবং রুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। চুক্তিটি প্রাথমিকভাবে ১২০ দিন মেয়াদের হয়েছিল। পরে আবারও নবায়ন হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের জুলাইয়ে রাশিয়া এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়।

২১ সেপ্টেম্বর পুতিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো তার দেশে অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশের ঘোষণা দেন। এর অধীনে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী তিন লাখ রুশ নাগরিককে সামরিক বাহিনী ডাকা হয়।

২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চল দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসনকে একতরফাভাবে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার ঘোষণা দেন পুতিন। এসব অঞ্চলে নিযুক্ত রুশ কর্তৃপক্ষ ২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর গণভোট আয়োজন করে। রুশ সেনা নিয়ন্ত্রিত গণভোটে রাশিয়ার পক্ষেই প্রায় সব ভোট পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গণভোটের নিন্দা করে এবং এর বৈধতা দিতে অস্বীকার করে।

৮ অক্টোবর একটি বিশাল বিস্ফোরণে ক্রিমিয়ার কের্চ ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ব্রিজটি রাশিয়া ও ক্রিমিয়ার সংযোগকারী একটি প্রধান পথ। বিস্ফোরণে কমপক্ষে তিনজন নিহত হন। এ হামলাকে পুতিন ইউক্রেনীয় গোয়েন্দাদের পরিচালিত একটি সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। এরও ১০ মাস পরে কিয়েভ এই হামলার দায় স্বীকার করে।

৯ নভেম্বর অব্যাহত ইউক্রেনীয় আর্টিলারি হামলার মুখে দক্ষিণ ইউক্রেনের বন্দর শহর খেরসন থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় রাশিয়া। শহর ছেড়ে ডিনিপার নদীর বাম তীরে চলে যায় রুশ সেনারা। এটি ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণের একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। এ বিষয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোয়েগু বলেন, রুশ সেনাদের জীবন বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দুই দিন পর রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে সেনাদের নদী পেরিয়ে প্রত্যাহার সম্পন্ন হয়েছে।

২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। যুদ্ধ শুরুর পর এটিই তার প্রথম আনুষ্ঠানিক বিদেশ সফর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও দেশটির সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় জেলেনস্কির। সফরের সময় বাইডেন প্রশাসন নতুন আরও ১৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা প্যাকেজের অংশ হিসেবে ইউক্রেনে প্রথম প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হস্তান্তরের ঘোষণা করে।

২০২৩ সালে ৩ মে প্রথমবারের মতো ইউক্রেনীয় ড্রোন মস্কোতে রুশ ক্রেমলিনের ওপর শনাক্ত হয়। এ বিষয়ে মস্কোর তরফ থেকে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ক্রেমলিনের বাসভবনের ওপর দুটি ইউক্রেনীয় ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। এ ঘটনাকে রুশ প্রেসিডেন্টকে হত্যার একটি সন্ত্রাসী চক্রান্ত বলে অভিহিত করে ক্রেমলিন। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এ ঘটনায় তার দেশের সম্পৃক্ততা স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিদেশি ভূখণ্ডে আক্রমণ করার পরিবর্তে ইউক্রেন নিজস্ব অঞ্চল পুনরুদ্ধার করার দিকে মনযোগী।

২০২৪ সালের ২১ মে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ও সরবরাহ কেন্দ্র বাখমুত শহরের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করে রাশিয়া। অঞ্চলটি প্রধানত রুশ ভাষাভাষী শিল্পায়িত ডনবাস অঞ্চলে অবস্থিত। জেলেনস্কি ও অন্যান্য ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার দাবি অস্বীকার করেন। কিন্তু ৩০ মে ইউক্রেনের সামরিক মুখপাত্র সের্হি চেরেভাতি স্বীকার করেন, শহরটি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।

২০২৩ সালের ২৫ মে রাশিয়া ও বেলারুশ একটি পারমাণবিক চুক্তি সই করে। ফলে রুশ পারমাণবিক অস্ত্র বেলারুশে মোতায়েন করা হয়। এ বিষয়ে মস্কোর তরফ থেকে বলা হয়, ন্যাটোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হিসেবে যৌথ পারমাণবিক মিশনের শুরু করা হয়েছে।

রাশিয়া ও ইউক্রেন ৬ জুন কাখোভকা বাঁধ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করে। এই বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়ে যায় এবং হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হন। মস্কো ইউক্রেনকে ক্রিমিয়ার মিঠা পানির সরবরাহ বন্ধের চেষ্টার জন্য অভিযুক্ত করে। অন্যদিকে কিয়েভ দাবি করে, ইউক্রেনের পালটা আক্রমণকে ধীর করার জন্য বাঁধটি উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া।

২০২৩ সালের ১০ জুন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রুশ সেনাদের দখল করা অঞ্চল পুনরুদ্ধারে পালটা আক্রমণের ঘোষণা দেন। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এসে ইউক্রেনের এই পালটা আক্রমণ ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০২৩ সালের ২৪ জুন রুশ ভাড়াটে আধাসামরিক গোষ্ঠী ওয়াগনার রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ওয়াগনার দাবি করে, রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তবে রুশ সামরিক বাহিনী ওয়াগনারের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।

ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন তার সেনাদের ওপর হামলা এবং রুশ সমরনায়কদের ব্যর্থ ও অথর্ব আখ্যায়িত করে মস্কোর সামরিক নেতৃত্ব উৎখাতের ঘোষণা দেন। তিনি সেনাদের নিয়ে ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে ছেড়ে মস্কোর দিকে রওয়ানা দেন। রাশিয়ার সীমান্ত শহর রোস্তভ-অন-ডনে তিনি তার সেনাদের নিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি একের পর এক এলাকা পেরিয়ে মস্কোর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।

রুশ কর্তৃপক্ষ একে সশস্ত্র বিদ্রোহ আখ্যায়িত করে প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ওয়াগনার বিদ্রোহকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসাবে নিন্দা করেন। পরদিন ২৫ জুন ওয়াগনার নেতা প্রিগোজিন ও তার যোদ্ধারা মস্কো থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নেন। পরে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট অ্যালেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় ওয়াগনার বাহিনী পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেয়।

২৩ আগস্ট বিদ্রোহের ঠিক দুই মাস পর, প্রিগোজিন রাশিয়ায় একটি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। ওয়াগনার প্রধান ও গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি উটকিনসহ আরও ৯ ব্যক্তি মস্কোর উত্তরে টাভার অঞ্চলে বিধ্বস্ত হওয়া ওই প্রাইভেট বিমানে ছিলেন।

এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের কমান্ডার-ইন-চিফ ভ্যালেরি জালুঝনিকে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এই পদক্ষেপটি ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত ছিল। কারণ ইউক্রেনের পালটা আক্রমণের ব্যর্থতার জন্য জালুঝনিকে দায়ী করা হয়। এ ছাড়া তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখেন বলেও সন্দেহ রয়েছে। তার জায়গায় কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন অলেক্সান্ডার সিরস্কি। তিনি পূর্বে ইউক্রেনীয় স্থল বাহিনীর কামান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ক্ষয়ক্ষতি

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দুই বছরে ঠিক কত মানুষ প্রাণ হারালেন, তা এখনো নিশ্চিত নয়। সংখ্যাটি হয় অজানা, অথবা গোপন। একেক পক্ষ একেক সংখ্যা দাবি করছে। যুদ্ধরত পক্ষগুলোর সরবরাহ এসব সংখ্যাকে ‘প্রোপাগান্ডা’ মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে জাতিসংঘসহ বেশির ভাগ স্বাধীন কর্তৃপক্ষ বিশদভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। তাই প্রকৃত সংখ্যা অজানাই রয়ে গেছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দুই বছর পরও ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রকৃত মানবিক মূল্য অজানা রয়ে গেছে। উভয় পক্ষই তাদের ক্ষতি গোপন করছে। রাশিয়া অধিকৃত অঞ্চলে বেসামরিক মৃত্যু ব্যাপকভাবে গোপন রাখার অভিযোগ রয়েছে।

২০২৩ সালের জুনে ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ বলেছিল, তারা শুধুমাত্র ১০ হাজার ৩৬৮ বেসামরিক ব্যক্তির নিহতের তথ্য রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ এদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির চিফ অব স্টাফের শীর্ষ সহযোগী ওলেগ গ্যাভরিচ বলেন, আমরা সবচেয়ে সম্ভাব্য যা মনে করি তা হলো সংখ্যাটি পাঁচগুণ বেশি। প্রায় ৫০ হাজার হতে পারে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ও স্বীকার করেছে, সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি।

ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মারিউপোলের দক্ষিণ বন্দর অবরোধের ফলে কমপক্ষে ২৫ হাজার জন মারা গেছেন। অনেককে গণকবরে সমাহিত করা হয়েছে। বন্দরটি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই তাদের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি গোপন রাখছে। অন্যদিকে তারা কোনো প্রমাণ না দিয়ে নিয়মিতই দাবি করে, একে অন্যের ভারী ক্ষয়ক্ষতি করেছে। ২০ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী অনুমান করেছে, তারা আক্রমণের পর থেকে চার লাখ পাঁচ হাজারের বেশি রুশ সৈন্যকে হত্যা বা আহত করেছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ান প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু দাবি করেছিলেন, তার সেনারা তিন লাখ ৮৩ হাজার ইউক্রেনীয় সৈন্যকে হত্যা বা আহত করেছে।

২০২৩ সালের আগস্টে নিউইয়র্ক টাইমস ইউক্রেনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি ৭০ হাজার নিহত এবং এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার আহত হিসেবে জানায়। তারা প্রতিবেদনে মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে।

মার্কিন কর্মকর্তারা অনুমান করেছেন, যুদ্ধে রাশিয়ার এক লাখ ২০ হাজার নিহত এবং এক লাখ ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ৮০ হাজার সেনা আহত হয়েছেন।

গত ২৯ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে এক প্রশ্নের লিখিত জবাবে যুক্তরাজ্যের সশস্ত্র বাহিনীবিষয়ক মন্ত্রী জেমস হেপ্পি রুশ ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে তিন লাখ ৫০ হাজারের বেশি নিহত ও আহতের তথ্য জানান।

চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০ হাজার ৫৮২ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ১৭ জন পুরুষ, তিন হাজার ৯৩ জন নারী, ৬৮৭টি শিশু। আহতদের সংখ্যা কমপক্ষে ১৯ হাজার ৮৭৫ জন। যদিও জাতিসংঘের মানবাধিকারের হাইকমিশনার অফিস দাবি করছে, প্রকৃত পরিসংখ্যান সম্ভবত উল্লেখযোগ্যভাবে আরও অনেক বেশি। জাতিসংঘের তথ্যে দেখা যায়, প্রায় ৬৫ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, প্রায় ৩৭ লাখ দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

আজ তৃতীয় বছরে পা রাখল এই যুদ্ধ। ইউক্রেন এখন অনেকটাই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত। এর মধ্যে গত ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা বিশ্বের মনোযোগ অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্যের দিকে চলে গেছে। পাল্টা আক্রমণে ব্যর্থ হওয়ায় ইউক্রেনের বেশিরভাগ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ শেষ। এখন দেশটি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আরও বেশি অস্ত্র চায়। চায় অত্যাধুনিক সামরিক বিমান, আর্টিলারি, ট্যাংক ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য বরাবরই ইউক্রেনে যত প্রয়োজন তত সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, যদিও বেশির ভাগ দেশেরই সামর্থ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

তবে ইউক্রেনের জন্য এখন বড় সমস্যা হলো যুদ্ধের জন্য জনবল সংকট। দুই বছর আগে যারা মাতৃভূমি রক্ষায় রণক্ষেত্রে গিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই রণক্লান্ত। অনেকেই আহত। মারা গেছেন বহু যোদ্ধা। যারা জীবিত আছেন তারা চান বিশ্রাম। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের জায়গা নেওয়া জন্য নতুন সেনাদের আগমনের অপেক্ষায় তারা। কিন্তু ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জনবল নিয়োগ বিভাগ শত চেষ্টা করেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা নিয়োগ দিতে পারছে না।

এ পরিস্থিতিতেও রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষই এখনো অনড় অবস্থানে রয়েছে। ফলে এই যুদ্ধ আরও কতদিন প্রলম্বিত হবে, তা নিয়ে কোনো ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছেন না বিশ্লেষকরাও।

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন