বিজ্ঞাপন

ইমানুয়েল কান্ট পাঠ না করলে দর্শনচর্চা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ

April 22, 2024 | 5:23 pm

সৈয়দ আমিরুজ্জামান

“প্রতিটি জিনিসের হয় মূল্য রয়েছে, নয় মর্যাদা। যে বস্তুর মূল্য রয়েছে, তা এর সমমূল্যের অন্য কোনো বস্তু দ্বারা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু, যে বস্তুর মূল্য সবকিছুর উর্ধ্বে, তার কোনো প্রতিস্থাপন নেই, রয়েছে মর্যাদা এবং গৌরব।”
– ইমানুয়েল কান্ট

বিজ্ঞাপন

জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট আধুনিক দর্শনের কেন্দ্রীয় অবস্থানটি ধারণ করে আছেন।

আঠার শতকের শেষের দিকে উত্তর-পূর্ব জার্মানির কোয়েনিগ্‌সবার্গ ছিলো ছোট্ট একটা শহর। সেই শহরের একটা বিশেষ রাস্তা ধরে প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বেরুতেন দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। বেঁটে-খাটো, হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ। খুব ভোরে বিছানা ছাড়ার পর থেকে রাতে ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্ত এক আশ্চর্য কঠিন নিয়মে তিনি কাটাতেন তার প্রত্যেকটি দিন। কান্টের কঠোর এই নিয়মানুবর্তিতা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়।

‘ক্রিটিক অব পিউর রিজন’ ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দর্শন বিষয়ক বই, নাম তো শুনেছেন নিশ্চয়ই। এই বইয়ে, প্রথাগত দর্শন এবং অধিবিদ্যার বাইরে গিয়ে অভিজ্ঞতার সাথে যুক্তির সমন্বয় করা হয়েছে। এই বইয়ে একইসাথে ভাববাদ এবং সংশয়বাদের বিপরীতে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। এই বইয়ের লেখককে গণ্য করা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন দার্শনিক। তার দর্শনে প্রভাবিত হয়ে দর্শনশাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন হেগেল, ফিশটে, সুপেনহার এবং শেলিং এর মতো দার্শনিকগণ। পিউর রিজন ছাড়াও ‘ক্রিটিক অব প্র্যাকটিক্যাল রিজন’, ‘ক্রিটিক অব জাজমেন্ট’ এর মতো অনেক বিশ্বমানের দর্শনগ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তিনি ইমানুয়েল কান্ট, যার দর্শন পাঠ না করলে দর্শনচর্চা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

ক্রিটিক অব পিউর রিজন

১৭৮১ সালে প্রকাশিত হয় ইমানুয়েল কান্টের বই ‘ক্রিটিক অব পিউর রিজন’। এই বইয়ের মাধ্যমে তিনি দর্শন জগতে পরিচয় করিয়ে দেন ‘থিওরি অব পারসেপশন’ নামক এক অভিনব তত্ত্ব। এই তত্ত্বের বিশদ আলোচনায় যাবার পূর্বে দুটি শব্দের সাথে পরিচিত হওয়া জরুরি। একটি হচ্ছে প্রায়োরি এবং অন্যটি পোস্টেরিওরি।

কোনো বিষয় সম্পর্কে কোনো বিবৃতিকে তখনই প্রায়োরি বলা হয়, যখন সে বিবৃতিটির অর্থ বুঝতে কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। কেবল সে ভাষাটি জানলেই তা বোঝা যায়। কিন্তু যখন কোনো বিবৃতির অর্থ বোঝার জন্য, বা সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অভিজ্ঞতা কিংবা পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন হয়, তখন সেটি হয় পোস্টেরিওরি। উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পানির মতো স্বচ্ছ হয়ে যাবে। “অবিবাহিত পুরুষের স্ত্রী নেই” কথাটা শোনা মাত্র এর অর্থ আপনি বুঝতে পারবেন, যদি আপনার বাংলা ভাষা জানা থাকে। কারণ অবিবাহিত শব্দের অর্থ আপনার লব্ধ জ্ঞান, তাই এটি যাচাই করবার প্রয়োজন হয় না। এই বিবৃতিটি একটি প্রায়োরি জ্ঞান। কিন্তু যদি বলা হয় “এখন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে”, এই বিবৃতিটি যাচাই করতে আপনাকে অবশ্যই বাইরে গিয়ে বৃষ্টি দেখতে হবে এবং সে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। এটি হচ্ছে পোস্টেরিওরি জ্ঞান।

বিজ্ঞাপন

“আধেয় ব্যতীত কল্পনা শূন্য, ধারণা ব্যাতীত উপলব্ধি অন্ধ।”- ইমানুয়েল কান্ট

থিওরি অব পারসেপশন

কান্টের ‘থিওরি অব পারসেপশন’ বা উপলব্ধিতত্ত্ব, বস্তুজগতটাকে আমরা কীভাবে দেখি তাই ব্যাখ্যা করেছে মৌলিক উপায়ে। যেকোনো বিবৃতিকে তিনি দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হচ্ছে অ্যানালিটিক্যাল এবং অন্যটি সিনথেটিক। এ দুটি বিষয় প্রায়োরি আর পোস্টেরিওরি জ্ঞানের মতোই। কোনো অ্যানালিটিক্যাল বিবৃতি বুঝতে প্রায়োরি জ্ঞান থাকলেই চলে, বাড়তি অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু, সিনথেটিক বিবৃতি বুঝতে ভাষাজ্ঞানের অধিক কিছু প্রয়োজন। তা অভিজ্ঞতা, পরিমাপ কিংবা পর্যবেক্ষণও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, “যে কোনো বস্তু স্থান দখল করে”। রাস্তায় একটি বড় পাথর পড়ে থাকলে, সেটি দেখে আমরা তৎক্ষণাতই অনুভব করতে পারি যে, সেটি কিছুটা স্থান দখল করে রেখেছে। এই জ্ঞানটি আমাদের প্রায়োরি জ্ঞান, তাই উক্তিটি অ্যানালিটিক। কিন্তু যদি বলা হয়, “পাথরটির ওজন ২০ কেজি”, তখন সেটি হবে একটি সিনথেটিক বিবৃতি। কেননা, পাথরটির ওজন দেখেই বোঝা যায় না, পরিমাপ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়।

উপরের আলোচনার পর যদি বলা হয় যে, কোনো প্রায়োরি জ্ঞানও সিনথেটিক হতে পারে, তাহলে কী বলবেন? এ প্রশ্নের সমাধান দিয়েছে গণিত। কান্ট, সাধারণ গণিত যেমন পাটিগণিতকে সিনথেটিক প্রায়োরি বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এটি নতুন জ্ঞান প্রদান করে যা অর্জন করতে অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন হয় না। ব্যাপারটা খুবই সহজ। গণিতের সাধারণ দিকগুলো বুঝতে শিখে গেলে “২+৩=৫”, আমাদের গণনা করে বের করতে হয় না, শোনামাত্রই আমরা উপলব্ধি করে ফেলি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি অ্যানালিটিক বিবৃতি। কিন্তু, ২ বা ৩ সংখ্যাগুলো যা বোঝায়, ৫ তা বোঝায় না। ২ আর ৩ এর যোগফল সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা দেয় আমাদের। সে অর্থে, নতুন জ্ঞান তৈরির জন্য এই বিবৃতিটি একটি সিনথেটিক বিবৃতিও বটে! এ থেকে আরো প্রমাণিত হয় যে, কোনো বৈষয়িক জ্ঞান তৈরিতে মন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এখানেই আবার নতুন সম্পূরক প্রশ্নের জন্ম হয়।

বিজ্ঞাপন

ক্যাটাগরিক্যাল ইমপারেটিভ

মানুষের অনুমান এবং ভৌত জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাহলে এরা বৈষয়িক জ্ঞান সৃষ্টির জন্য পরস্পর ক্রিয়া করে কীরূপে? এই প্রশ্নের উত্তরে কান্ট দাঁড় করিয়েছেন ‘ট্রান্সসেন্ডেন্টাল স্কিমা ডক্ট্রিন’ বা অতীন্দ্রিয় পরিকল্পনা মতবাদ। এই মতবাদের আওতায় তিনি নৈতিক দর্শন আলোচনা করেছেন। ‘গ্রাউন্ডওয়ার্ক অব দ্য মেটাফিজিক্স অব মোরাল’, ‘ক্রিটিক অব প্র্যাক্টিক্যাল রিজনস’ এবং ‘মেটাফিজিক্স অব মোরালস’, এই তিনটি বইয়ে তিনি তার এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

কান্টের মতে, নৈতিকতা গণিতের মতোই ধ্রুব। ২+২=৪ সর্বাবস্থায় সকল ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি নৈতিক ব্যাপারগুলো এমন যে সেগুলো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ ধ্রুব। “অন্যের ক্ষতি করা যাবে না”, সকল ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রেই এটি সমান সত্য। নিজেদের বুদ্ধি-বিবেক দিয়েই আমরা এগুলো অনুধাবন করতে পারি। আমরা নৈতিক হতে চাই বা না চাই, কান্টের মতে নৈতিক এই দায়িত্বগুলো আমাদের সকলের জন্য অবশ্য পালনীয়। এগুলোকে তিনি ‘ক্যাটাগরিক্যাল ইমপারেটিভ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কান্টের ক্যাটাগরিক্যাল ইমপারেটিভ হচ্ছে ৩টি।

“প্রতিটি জিনিসের হয় মূল্য রয়েছে, নয় মর্যাদা। যে বস্তুর মূল্য রয়েছে, তা এর সমমূল্যের অন্য কোনো বস্তু দ্বারা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু, যে বস্তুর মূল্য সবকিছুর উর্ধ্বে, তার কোনো প্রতিস্থাপন নেই, রয়েছে মর্যাদা এবং গৌরব।”- ইমানুয়েল কান্ট

ফরমুলা অব ইউনিভার্সাল ল:

কান্টের মতে, আমাদের প্রতিটি কাজ হতে হবে কিছু নির্দিষ্ট নৈতিক নিয়ম বা নীতির আওতায়, যে নীতিগুলো সার্বজনীন হবার যোগ্যতা রাখে। অর্থাৎ, আমি কোনো কাজ তখনই করবো, যখন সে কাজটি পৃথিবীর যে কেউ করতে পারবে, কিন্তু কোনো বিতর্ক বা অসঙ্গতির সৃষ্টি হবে না। মনে করুন, আপনি খুব ক্ষুধার্ত এবং আপনার নিকট এখন টাকা নেই। আপনি একটি দোকান থেকে এক প্যাকেট রুটি চুরি করে খেয়ে নিলেন। এখন কান্টের তত্ত্ব অনুযায়ী, যেহেতু আপনি চুরি করেছেন, সেহেতু আপনি চুরির সমর্থক এবং চুরি সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকে চুরি করলে সমাজে স্থিতিশীলতা কতটুকু থাকবে? তাই চুরি আপনি করতে পারবেন না, কারণ এই কাজটি সমাজের সবাই করলে সমাজ অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। অর্থাৎ, যে কাজটি সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত হবে, আপনি শুধু তা-ই করতে পারবেন। এ বিষয়ে কান্ট অত্যন্ত কঠোর। তার মতে, যেহেতু মিথ্যা বলা কখনো সার্বজনীন হতে পারে না, তাই চূড়ান্ত পরিস্থিতিতেও মিথ্যা বলা যাবে না। একটি উদাহরণ কল্পনা করা যাক। মনে করুন, কলিং বেলের শব্দ শুনে আপনি দরজা খুলে দেখলেন একজন সন্ত্রাসী অস্ত্র হাতে আপনার বন্ধু ‘ম’ এর কথা জিজ্ঞেস করছে, যিনি কিনা তখন আপনার ঘরেই আছে। আপনি এমন সংকটময় পরিস্থিতিতেও মিথ্যা বলতে পারবেন না। ঘটনাটি এমনও হতে পারে যে, আপনি বললেন ম ঘরে নেই, অথচ দরজায় আপনাদের কথা শুনে ম পেছন দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে। তখন আপনার কথা বিশ্বাস করে অস্ত্র হাতে লোকটি চলে যেতে যেতে দেখলো ম দৌড়াচ্ছে এবং তৎক্ষণাৎ ম কে গুলি করে দিল! এক্ষেত্রে একবার ভাবুন, যদি সত্যি বলতেন, তাহলে অস্ত্রধারী লোকটি ঘরে প্রবেশ করে ম কে খুঁজে দেখতো এবং তাতে কিছু সময় ব্যয় হতো। সে সময়ে ম নির্বিঘ্নে পালাতে পারতো! অথচ মিথ্যা বলার কারণে, ম এর মৃত্যুতে আপনিও দায়ী হয়েছেন!

ফরমুলা অব হিউম্যানিটি:

একটি চিরুনি আপনি ততদিন ব্যবহার করবেন, যতদিন সেটি আপনার চুলকে সুন্দর রাখতে সহায়তা করবে। চিরুনিটি ভেঙে গেলে আপনি সেটি ফেলে দেবেন। কিন্তু, আপনার ব্যবসায়ের কর্মচারী, যিনি কিনা কোনো দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছেন এবং আপনার ব্যবসায় আর কোনো সহায়তা করতে পারছেন না, তাকে কী ঐ চিরুনির মতো সহজেই ছুঁড়ে ফেলবেন? কান্টের উত্তর না। সব কিছুকেই উপেক্ষা করা গেলেও, মানবজাতিকে উপেক্ষা করা যাবে না। কারণ, মানুষ নিজেই নিজের পরিণতি এবং মানুষ যৌক্তিক। সকল উপকরণ নিছক স্বার্থের জন্য ব্যবহার করা গেলেও মানুষকে ব্যবহার করা যাবে না।

ফরমুলা অব অটোনমি:

তৃতীয় বিধিতে কান্ট প্রথম বিধির উক্তিরই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ভিন্ন রূপে। প্রথম ফরমুলা অনুযায়ী, মানুষকে এমনভাবে নীতি নির্ধারণ করতে হবে যেন সেগুলো সার্বজীন হবার যোগ্যতা রাখে। সেক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঁধা সৃষ্টি হতে পারতো। তৃতীয় ফরমুলাটি সে বাঁধাই দূর করে। এই ফরমুলা অনুসারে, কোনো মানুষ এমন সব নীতি নির্ধারণ করবে, যে তার নীতিই সার্বজনীন হয়ে উঠবে! উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা সহজ হবে। কোনো সমাজে বাল্যবিবাহের প্রচলন থাকলেও, যদি আপনি বিষয়টির ভয়াবহতা বুঝতে পারেন, তাহলে অবশ্যই সার্বজনীন নিয়ম না মেনে আপনাকে নিজের নিয়ম ঠিক করতে হবে। অর্থাৎ, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আপনি এমনভাবে অবস্থান গ্রহণ করবেন যেন সেটিই সার্বজনীন নিয়মে পরিণত হয়।

নান্দনিক দর্শন

নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কিত দর্শনের ক্ষেত্রে ইমানুয়েল কান্টের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি তার ‘ক্রিটিক অব জাজমেন্ট’ বইতে নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। কোনো চিত্র সুন্দর করে আঁকা হয় বলে, কিংবা কোনো গান সুন্দর করে গাওয়া হয় বলে সুন্দর হয় না, মূলত স্বাধীনভাবে কল্পনা করতে পারার আনন্দই শিল্পকে সুন্দর করে তোলে, নান্দনিকতা প্রদান করে। সৌন্দর্য আর সৌন্দর্যচেতনাকে কখনোই কোনো মানুষের বিচারের আওতাধীন করা উচিৎ নয়। কেননা, শিল্পের সৌন্দর্য বিচার করতে গেলে তার নান্দনিকতা অনুভব করা যায় না, যা ঐ শিল্পকর্মের অবাধ কল্পনার মাঝে লুকায়িত থাকে।

ব্যক্তিজীবন

ইমানুয়েল কান্ট ১৭২৪ সালের ২২ এপ্রিল প্রুশিয়ার কোনিগসবার্গ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা আনা রেজিনা প্রুশিয়ার নাগরিক হলেও, তার বাবা গ্রেগর কান্ট ছিলেন জার্মান অধিবাসী। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের ৯ সন্তানের ৪র্থ জন। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার পর তার নামের পাশে ইমানুয়েল শব্দটি যোগ হয়। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাইবেল এবং ল্যাটিন দিয়ে। পারিবারিক কঠোর বিধিনিষেধ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের মাঝে বড় হতে থাকা কান্ট খ্রিস্টধর্মের একজন কঠোর বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তবে বয়স এবং জ্ঞানের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে তিনি সংশয়বাদী হতে থাকেন এবং এক সময় ধর্মকর্মের প্রতি সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন।

গৃহী মানুষ হিসেবে ইমানুয়েল কান্টের নাম আছে। প্রচলিত আছে যে, তিনি তার বাড়ি থেকে কখনো ১৬ কিলোমিটারের অধিক দূরে গমন করেননি! যদিও তথ্যটি ভুল, তথাপি তার জীবন কেটে গিয়েছিল কোনিগসবার্গ শহরেই! কদাচিৎ শহরের বাইরে গেছেন জরুরি প্রয়োজনে। ফ্রিডেসিয়ানাম কলেজে পড়ালেখা শেষ করে ১৭৪০ সালে ভর্তি হন কোনিগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি দর্শনের ছাত্র হন, পড়তে শুরু করেন লেবিনিজ এবং ক্রিশ্চিয়ান উলফের দর্শন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে প্রাথমিকভাবে গৃহশিক্ষক হয়ে জীবিকার্জন করতেন কান্ট। পরবর্তীতে কোনিগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক পদে যোগ দেন তিনি। প্রাথমিকভাবে তিনি বিজ্ঞান নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। ‘জেনারেল হিস্ট্রি অব নেচার’, ‘আপন নিউটনিয়ান প্রিন্সিপালস’ এবং ‘জেনারাল নেচারাল হিস্ট্রি অ্যান্ড সেলেশ্চিয়াল বডিজ’- এই তিনটি বই তিনি ১৭৫০-৫৫ সালের মধ্যে প্রকাশ করেন।
দর্শনে তার প্রথম পদক্ষেপ ‘ফলস সাটলটি অব দ্য ফোর সিলোজিস্টিক ফিগারস’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৭৬০ সালে। এরপর আর কখনোই দর্শনের বাইরে পা রাখেননি কান্ট। ২ বছর পর প্রকাশিত হয়, সম্ভবত তার জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত গ্রন্থ ‘দ্য অনলি পসিবল আর্গুম্যান্ট ইন সাপোর্ট অব আ ডেমনস্ট্রেশন অব একজিস্ট্যান্স অব দ্য গড’। এই বইয়ে তিনি ধর্মের উপর যুক্তির প্রাধান্য স্থাপন করে সমালোচনার শিকার হন। আবার দর্শনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব খুঁজে প্রশংসিতও হন। এরই মাধ্যমে তিনি দার্শনিক হিসেবে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং নিজের স্থান অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে ১৭৬০ সালেই হঠাৎ তার কলম নীরব হয়ে যায়। এই নীরবতা ভাঙতে সময় নেয় ২১ বছর!

কলম নীরব হলেও, তার ভাবনার চাকা ঠিকই সচল ছিল। দীর্ঘ ২১ বছরের চিন্তার প্রতিফলন তিনি ঘটিয়েছিলেন ১৭৮১ সালে প্রকাশিত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’-এ। এটি প্রকাশের সাথে সাথেই তার নাম উঠে যায় সর্বকালের সেরাদের তালিকায়। এরপর একে একে প্রকাশ করেন ‘গ্রাউন্ডওয়ার্ক অব মেটাফিজিক্স’, ‘ক্রিটিক অব প্র্যাক্টিক্যাল রিজন’, ‘মেটাফিজিক্যাল ফাউন্ডেশন অব ন্যাচারাল সায়েন্স’, ‘ক্রিটিক অব জাজমেন্ট’, ‘রিলিজিয়ন উইদিন দ্য বাউন্ডস অব বেয়ার রিজন’ সহ অমর সব দর্শনের বই। ১৮০২ সালে লিখতে শুরু করেন ‘ওপাস পোস্টুমাম’ নামক একটি গ্রন্থ যা আর শেষ করে যেতে পারেননি। ১৮০৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, ৮০ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কোনোদিন বিয়ে করেননি। সমগ্র জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানচর্চায় আর ভাবনায়। তার সে সব ভাবনা আজ দর্শনের অমূল্য সম্পদ, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের পাথেয়।

দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের দর্শন, তার উপস্থাপনা ও বিশ্লেষণ, খুবই জটিল হলেও তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তার মূল প্রস্তাবনাগুলো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষেরা সঠিক বলেই জানেন। এর ভিত্তিতেই তিনি তার দার্শনিক মতে উত্তরণকে সাধারণ বিচারবুদ্ধির নৈতিক জ্ঞান থেকে দার্শনিকতায় উত্তরণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

কান্ট সব ধরনের অন্ধতা ও অযৌক্তিক ভাবাবেগের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে অভিনন্দিত করেছেন। এ পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রচিত হয়েছে তার রচনাবলির। বিজ্ঞানমনস্ক, কর্তব্যপরায়ণ ও সৌন্দর্যপিপাসু মানুষকে কান্টের দর্শন চিরকাল অনুপ্রাণিত করবে।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন