বিজ্ঞাপন

আমার চিকিৎসার দরকার নেই ঢাকা মেডিকেলে যাও, বলেছিলেন শেখ হাসিনা

August 21, 2018 | 10:13 am

।। নৃপেন্দ্রনাথ রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ওনার একটি ছবি আছে, যেটাতে ঠোঁটের ওটার হাত চেপে ধরে রাখা। একদম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে-মা-বাবা মারা গেলে যেমন একটা চেহারা হয়,  সেরকম একটা চেহারা। দৃষ্টিশূন্য মেলে ওপরের দিকে তাকিয়ে। আমি যখন সুধাসদনে ঢুকলাম, ঠিক ওই দৃশ্যটাই দেখতে পেলাম। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আমার চিকিৎসার দরকার নেই। আমার কিছু হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাও। তোমরা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাও।’

কথাগুলো সারাবাংলাকে বলছিলেন চিকিৎসক অধ্যাপক প্রাণগোপাল দত্ত। তিনি বলছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী) কথা। দিনটি ছিল ২১ আগস্ট ২০০৪ সাল। দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম জঙ্গিপনার ঘটনাটি ততক্ষণে ঘটে গেছে।

অধ্যাপক প্রাণগোপাল বলেন, আমাকে ডাকা হয়েছিল সুধাসদন থেকেই। আমি তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যলয় হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম। তখনও আমি জানি না যে গ্রেনেড হামলাটা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বর্বর জঘন্য রাজনৈতিক সহিংসতার নিষ্ঠুর এক খেলা ছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। যে হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার ডান কানের শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।

কিন্তু নিজের কানের নয়, চিকিৎসার জন্য নাক-কান-গলার এই দেশ সেরা চিকিৎসককেও তিনি সেদিন ঠেলে পাঠিয়ে দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে শতাধিক মানুষ তখন ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। কেউ চিৎকার করছে। কারও বা নিথর দেহ পড়ে আছে।

প্রাণগোপাল বলেন, নেত্রীর নির্দেশে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানলাম, একটি ওটিতে আইভি রহমানকে রাখা হয়েছে। তার প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছে। রিপেয়ার করার মতো কেউ নাই। আমি দ্রুত ঢুকলাম। ডা. রোকেয়া ও অ্যানেসথেশিয়ার একজন চিকিৎসক রয়েছেন। ততক্ষণে ওনার চোখ ফিক্সড হয়ে গেছে। অর্থাৎ বলা যায়, উনি ক্লিনিক্যালি ডেড হয়ে গেছেন। সে অবস্থাতেই তার চিকিৎসার সব ধরনের চেষ্টা চালালাম। এরপর একের পর এক অন্য যে আহতদের আনা হলো, তাদেরও দেখলাম।

বিজ্ঞাপন

ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। গুরুতর আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। রক্তে রঞ্জিত আর হতাহতদের অসহায় আর্তনাদে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল সেই বিকেলে।

দিনটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য এক গভীর বেদনার দিন। গোটা দেশের জন্য এক ভয়াবহ আতঙ্কের দিন।

সেদিন মানববর্ম রচনা করে শেখ হাসিনাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট শব্দে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার দু’টি কানের শ্রবণযন্ত্র।

‘একটি কানের শ্রবণ শক্তি আমাদের পক্ষে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অন্য কানে তিনি শুনতে পান,’ বলছিলেন প্রাণগোপাল দত্ত।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘ওনার ডান কানের সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস্ট অর্থ্যাৎ স্নায়ু নষ্টজনিত বা স্নায়বিক আঘাতের জন্য কানের শ্রবণশক্তি অনেকটা কমে যায়। এটা অতি মাত্রায় শব্দ দূষণের ফলেই হয়, যেটা হয়েছে গ্রেনেডের বিকট আওয়াজ থেকে।’

প্রাণ গোপাল বলেন, ‘যেহেতু উনি (শেখ হাসিনা) যথাসময়ে চিকিৎসা নিতে বাইরে যাননি, তাই আমরাও যখন চিকিৎসা দিলাম, উনি সেটা ঠিকমতো নিতে পারেননি। কারণ ওই হামলায় এত হতাহতের ঘটনা ঘটে যে তাদের সেবা শুশ্রুষা করার জন্যই উনি পাগল হয়ে গেলেন। এতে ক্ষতিটা বেড়েই গেল।’

সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার পরে উনি নিজের জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি। ঘটনার দুই দিন পর আমাকে বললেন, কানের ভিতরে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে, কানে শুনছেন না। মাথা ঝিমঝিম করছে। অথচ প্রথম দিন উনি আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নিজে এরকম আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাকে কোনো গুরুত্বই দিলেন না।’

‘তারপরও আমরা যতই বলেছি যে আপনাকে হাইপারবারিক অক্সিজেন ট্রিটমেন্ট আছে বিদেশে, সেটা করলে হয়তো একটু ভালো হবে; কিন্তু উনি চিকিৎসা নিতে যেতে চাইলেন না। বললেন, আমি এদের ফেলে কোনোদিনও চিকিৎসা নিতে যাব না।’— বলছিলেন প্রাণ গোপাল।

তিনি আরও বলেন, ‘তারপরে উনি যখন সিঙ্গাপুরে গেলেন, সেখানে পরীক্ষা করা হলো। আমি বাংলাদেশে যে পরীক্ষা করে যে ডায়াগনসিস লিখেছিলাম, যে পরিমাণ শ্রবণশক্তি লস্ট ছিল সিঙ্গাপুরেও সেইটাই কনফার্মড করা হলো। তখন সিঙ্গাপুর থেকেই ওনাকে ফাইনালি বলে দেওয়া হলো— ডান কানে শুনতে কানের যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে।’

এভাবেই সেই বর্বর ঘৃণ্যতার আঘাত আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন শেখ হাসিনাসহ দলের নেতাকর্মীরা।

তবে নিজের চেয়ে আজও অন্যদের কষ্ট ও আত্মত্যাগকেই বড় করে দেখেন শেখ হাসিনা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার নেতাকর্মীরা সবাই আমাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল যে অনেকেই ইনজিউরড (আহত) হয়েছে। তাদের রক্ত এখনও আমার কাপড়ে লেগে আছে। আমার নেতাকর্মীরা তাদের জীবন দিয়েই আমাকে বাঁচিয়েছে।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করা হয়। কেবল বিদেশে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে দলের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। এরপর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করেন। কিন্তু ২০০১ সালের দুরভিসন্ধিমূলক নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিরোধী দলের আসনে বসেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। সে সময়েই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে, যার প্রাইম টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘমেয়াদি নীলনকশা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সেদিন এই হামলা হয়। যা এখন দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

শুধু একবার নয়, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কখনও নিজ বাসভবনে, কখনো জনসভায়, আবার কখনও তার গাড়ির বহরে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময়ে কাওরানবাজারে তার গাড়িবহরে বোমা হামলা চালানোর চেষ্টা চালায় জেএমবি।

তবে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। আজ গ্রেনেড এই হামলার ১৪ বছর পূর্তি হচ্ছে। এই মামলায় ৪১ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে এ মামলার রায় হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

আরও পড়ুন-

২১ আগস্ট গ্রেনেড সন্ত্রাসের ১৪ বছর

‘গ্রেনেড হামলায় জিয়া পরিবার জড়িত, সন্দেহ নেই’

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা: বিচারিক আদালতের রায় আগামী মাসেই

সারাবাংলা/এনআর/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন