বিজ্ঞাপন

ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, মৃত্যুর কারণ ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা

May 14, 2018 | 9:43 pm

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রায় ২০ হাজার মানুষের জন্য ইফতার সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করলেও এতবড়ো আয়োজনের খবর প্রশাসনকে আগে থেকে জানায়নি কবির স্টিল রিরোলিং মিলস লিমিটেড (কেএসআরএম) কর্তৃপক্ষ। অথচ দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং আশপাশের জেলায়ও এই ইফতার সামগ্রী বিতরণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিল বলে তথ্য আছে প্রশাসনের কাছে। এর ফলে লোক সমাগম হয়েছিল বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের ধারণার চেয়েও প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি ।

কেএসআরএম কর্তৃপক্ষের গাফিলতির জন্যই ইফতার সামগ্রী নিতে এসে অসহায় মানুষগুলোকে প্রাণ দিতে হয়েছে, বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এমনকি প্রাণহানির ঘটনার পরও তারা ইফতার সামগ্রী বিতরণ বন্ধ করেনি। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গিয়ে এই কার্যক্রম বন্ধ করার আদেশ দেন।

এ ঘটনার পর সোমবার সন্ধ্যায় কেএনআরএম কতৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে নিতহ প্রত্যেক পরিবারকে ৩ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ঘটনার পর পুলিশ এবং কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ ‘হিটস্ট্রোক এবং তীব্র গরমে শ্বাসকষ্টে’ মৃত্যু হয়েছে দাবি করা হয়েছিল। তবে তাদের এই দাবির সঙ্গে একমত নয় স্থানীয় প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন বলছে, ভিড়ের চাপে শ্বাসবন্ধ হয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ভিড়ের মধ্যে পড়ে অনেকে আঘাতও পেয়েছেন।

এই অবস্থায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কেএসআরএম-এর বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের জন্য সদর দফতর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে।

বিজ্ঞাপন

কেএসআরএম-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের পশ্চিম গাতিয়াডাঙ্গা গ্রামের হাঙ্গরমুখ এলাকায়। বাড়ির পাশে কাদেরীয়া মুঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার মাঠে সোমবার (১৪ মে) সকালে ইফতার সামগ্রী বিতরণের আয়োজন করে কেএসআরএম গ্রুপ, যাতে উপস্থিত ছিলেন শাহজাহান নিজেও। সেখান থেকে করুণ মৃত্যুর শিকার ৯ নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ঘটনাস্থলে যাওয়া চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার (এসপি) নূরে আলম মিনা সারাবাংলাকে জানান, মাদ্রাসার মাঠে ১০ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতা আছে। কিন্তু মানুষের সমাগম ছিল কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ হাজার, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নারী। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাইরে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা থেকে দুঃস্থ, বিধবা, ভিক্ষুক ভাসমান নারীরা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। ভিড়ের মধ্যে প্রচণ্ড গরমে হিটস্ট্রোক ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে ১০ নারীর মৃত্যু হয়।

তবে সন্ধ্যার দিকে সাতকানিয়া থানা পুলিশ জানিয়েছে, তারা ৯ নারীর মরদেহ পেয়েছে। বাকি একজন মোস্তফা খাতুন মারা যাবার খবর প্রথমে পাওয়া গেলেও পরে জানা যায়, তিনি জীবিত আছেন।

বিজ্ঞাপন

ঘটনার বিষয়ে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন সারাবাংলাকে জানান, সকাল ১০টার দিকে ইফতার সামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এসময় ৭ জনের মৃত্যুর খবর তিনি শুনতে পান। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তিনি ঘটনাস্থলে যান। সেখানে তিনি এসপি নূরে আলম মিনাসহ উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের দেখতে পান। কয়েকজনের মরদেহও তিনি দেখেন।

ইউএনও আরও দেখতে পান, হুড়োহুড়ি-বিশৃঙ্খলার মধ্যেও অনুষ্ঠান চলছে। তিনি এসপিকে গিয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এরপর এসপি এবং উপজেলা প্রশাসন মিলে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেন। এর মধ্যে ঘটনাস্থলে হাজির হন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেনও।

ইউএনও মোহাম্মদ মোবারক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, আয়োজক প্রতিষ্ঠান এতবড় একটি আয়োজনের খবর আমাদের অবহিত করেননি। আমাদের কাছ থেকে কোন অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। এমনকি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে পর্যন্ত জানাননি। তারা নিজেরা নিজেদের মতো করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আমরা আরও জেনেছি, তারা প্রতিবছরের মতো ইফতার সামগ্রী বিতরণের বিষয়ে প্রচার চালিয়েছিল। এতে ধারণার চেয়েও বেশি লোকসমাগম হয়।

ইউএনও বলেন, লাশ দেখে আমি সেখানে সমবেত লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেও কারণ জানার চেষ্টা করেছি। তারা আমাকে জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই প্রচণ্ড ভিড়, ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ি এবং বিশৃঙ্খলা ছিল। হুড়োহুড়িতে বেশ কয়েকজন পড়ে গিয়ে আঘাত পান। ভিড়ের মধ্যে শ্বাসবন্ধ হয়ে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটে।

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয় তদন্ত কমিটি করেছেন। নিশ্চয় কমিটি মৃত্যুর সঠিক কারণ খুঁজে বের করবে।

তবে কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেরুল করীম সারাবাংলাকে বলেছেন, তারা মৌখিকভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে ইফতার সামগ্রী বিতরণের বিষয়টি অবহিত করেছিল। এ ছাড়া তাদের নিজেদেরও ২০০ নিরাপত্তা কর্মী ছিল।

তিনি বলেন, প্রতিবছর শুধুমাত্র নিজ গ্রামের লোকজনকে কেএসআরএম-এর মালিকের পক্ষ থেকে ইফতার সামগ্রী দেওয়া হয়। এ বছর আশপাশের এলাকা থেকেও লোকজন জড়ো হলে ভিড় বেড়ে যায়। বাড়তি মানুষের কথা চিন্তা করে ২০ হাজার প্যাকেট তৈরি করা হয়েছিল। এতে ছোলা, সেমাই, চিনি, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন সামগ্রী ছিল।

ঘটনাস্থল থেকে সাতজনের মরদেহ পরিবারের সম্মতি নিয়ে বিনা ময়নাতদন্তে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুটি মরদেহের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন ইউএনও।

এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মোস্তফা খাতুনের শরীরে আঘাত পাওয়া চিহ্ন আছে বলে চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন সেখানকার পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার। ঘটনাস্থলে থাকা কয়েকটি মরদেহের শরীরেও আঘাত পাওয়ার চিহ্ন দেখা গেছে।

সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. ফাতেমা তুজ জান্নাত পুষ্পা সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে ১০ জনকে এনেছিল। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে আমরা ভর্তি করেছি। এদের মধ্যে কেউ হিটস্ট্রোক কিংবা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হননি। সবাই এসেছিলেন আহত হয়ে। তারা হয়ত ভিড়ের মধ্যে পড়ে পদদলিত হয়েছেন অথবা ধাক্কাধাক্কিতে আহত হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের শরীরে জখম ছিল। কাটা-ছেঁড়ার জন্য সেলাইও দিতে হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘হিটস্ট্রোক এবং শ্বাসকষ্টে’ মৃত্যু হলে শরীরে আঘাত পাওয়ার চিহ্ন থাকত না।

পুলিশ সূত্রমতে, পুলিশ সদর দফতর থেকে ইফতার সামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রাণহানির ঘটনায় আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ এনে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় এই মামলা দায়েরের নির্দেশনা এসেছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ সারাবাংলাকে বলেন, আয়োজক প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট ধারায় মামলাও হবে।

ইফতার সামগ্রী নিতে গিয়ে নিহতরা হলেন- সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া গ্রামের ইসমাইলের স্ত্রী হাসিনা আক্তার (৩৫), দক্ষিণ ঢেমশা রাস্তার মাথা এলাকার হাসান ড্রাইভারের স্ত্রী রিনা বেগম (৩২), উত্তর ঢেমশা মোবারক হোসেনের মেয়ে সাকি (২২) এবং খাগড়িয়া রসুলপুর মহাজন পাড়ার নূর হোসেনের স্ত্রী রশিদা আক্তার (৫৪), লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজান গ্রামের আবদুস সালামের মেয়ে টুনটুনি বেগম (১৫), উত্তর কলাউজানের আলাউদ্দিনের মেয়ে নূরজাহান (১৮) এবং কলাউজানের রসুলবাদ গ্রামের আব্দুল হাফেজের স্ত্রী জোস্না আকতার (৫০), চন্দনাইশ উপজেলার পূর্ব দোহাজারীর নূর ইসলামের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৬০) এবং বান্দরবান জেলার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইব্রাহিমের স্ত্রী নূর আয়শা (৬০)।

এদিকে সাতকানিয়ায় ভিড়ের চাপে মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাশহুদুল কবীরকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এর আগে ২০০৫ সালেও একই স্থানে কেএসআরএম-এর ইফতার বিতরণ অনুষ্ঠানে পদদলনের শিকার হয়ে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছিল।

সারাবাংলা/আরডি/এমআই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন