বিজ্ঞাপন

সেলফি সুখে হারায় শোকের স্মরণ

December 15, 2017 | 6:58 pm

জাকিয়া আহমেদ

বিজ্ঞাপন

১৪ ডিসেম্বর, সকাল সাড়ে দশটা। সকাল থেকেই নানা বয়সী মানুষের ভিড় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় বধ্যভূমি প্রাঙ্গণ। এমন দিনে, এমন পরিবেশে কেমন যেন লাগে। কষ্ট আর গর্ব দুই মিলে এক ধরনের আবেগ আর বেদনা কাজ করে।

নিজেকে সামলে নিয়ে নেমে গেলাম সংবাদ সংগ্রহে। শহীদ সন্তানদের বক্তব্য, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলা এবং আরও নানান কাজ। অবশ্য সারাবাংলার অনলাইন পোর্টালের জন্য ভিডিও ফুটেজ নিতে ফটোগ্রাফারকে নিয়ে  প্রচণ্ড ভিড়ে বক্তব্য  নেওয়ার অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর ছিল না। রাগ আর বিরক্ত নিয়ে ভিড় থেকে যখন বের হচ্ছিলাম তখনই চোখ পড়ল ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ের দিকে। নিমিষেই মন ভাল হয়ে গেল। চোখে চশমা আর সাদা পোশাক পরা আট-ন’ বছরের মেয়েটি তখন মায়ের হাত ধরে বায়েরবাজার বধ্যভূমির মূল বেদিতে, কপালে তার ব্যঞ্জনা। সেখানে লেখা ‘৭১-এর বীর সেনানীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি’। মূল বেদিতে উঠে মেয়েটি চলে যায় পাশে থাকা একজন পতাকা বিক্রেতার সামনে। সেখান থেকে একটি পতাকা কিনে পুরো বেদি ঘুরে বেড়ায় সে। অনেকেই মুগ্ধ চোখে দেখছিল এই দৃশ্য। ক্লিক ক্লিক ছবি তুললেন কয়েকজন ফটোগ্রাফার।

কথা বলতে চাইলে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশুটি জানায়, তার নাম সুকৃতি ইসলাম জয়িতা। ৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের এখানেই ধরে এনে মেরে ফেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেইসব বুদ্ধিজীবীর প্রতি  শ্রদ্ধা জানাতেই সে তার মা জয়া সরকারের সাথে এখানে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

 

বধ্যভূমির মূল বেদির সামনে দাঁড়িয়ে মাত্র কেনা লাল-সবুজ পতাকা নাড়াতে নাড়াতে জয়িতা বলে, তাদের বিনিময়ে আমরা এই দেশ পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি-মায়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি— তাই তাদেরকে আজ আমি স্মরণ করছি।

বিজ্ঞাপন

একটু থেমে শিশুটি ফের বলে— যাদের প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীন দেশে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি তাদেরকে আমার সালাম আর শ্রদ্ধা।

কষ্টের স্মৃতি খুঁড়তে নুজহাত চৌধুরী ও শমী কায়সারসহ  অনেক শহীদ সন্তানের দেখা মিলল বধ্যভূমিতে। বুকের ভেতরে লালন করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে  অসুস্থ শরীরেই চলে এসেছেন  ৮৮ বছরের মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন। তিনি জানান, এই বধ্যভূমিতেই জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, তাদেরকে পুঁতে রাখা হয় এখানে এই মাটির নিচে। তাদেরকে ফিরিয়ে আনা যাবে না, কেবল যদি যথার্থ সম্মান তাদেরকে দেওয়া যায় তাহলে কিছুটা স্বস্তি আর শান্তি পাওয়া যাবে।

মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদ স্বজন ছাড়াও সকাল থেকেই রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে জড়ো হতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। নতুন করে আবারও জানতে চাওয়া, একাত্তরে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে, জাতিকে মেধাহীন করতে ধরে নিয়ে যায় শিক্ষক, গবেষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ মেধাবী সব মানুষকে। সেদিন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কারও বাসা থেকে কারও বা কর্মস্থল থেকে চোখ বেঁধে সেদিন ধরে নিয়ে যায় । এরপর তাঁদেরকে হত্যা করে মিরপুর ও রায়েরবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশ ফেলে রেখে যায় পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের দোসররা। যাঁদের অনেকেরই মরদেহ খুঁজে পাননি স্বজনরা।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই কিছুটা ফাঁকা হয় রায়েরবাজার বধ্যভূমি। ঘুরে ঘুরে কথা বলছিলাম এখানে আসা কজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তারা অভিযোগ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা কত তা আজও জানা সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় শহীদের তালিকায় আছেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক-প্রকৌশলী ও ১৩ জন সাংবাদিক ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

স্বজনরা জানান,১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত বর্বর হত্যাকাণ্ড হিসেবে তখন বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাঁদের স্বজনরা এই বধ্যভূমিতে তাঁদের লাশ খুঁজে পান, যেখানে তারা দেখতে পান কারও হা-পা বাঁধা, কারও শরীরে একাধিক গুলির চিহ্ন, আঘাতের চিহ্ন। আবার অনেককে ধারাল অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। লাশগুলো এতটাই ক্ষত-বিক্ষত ছিল, কারও লাশ ছিল মাটির নিচে চাপা দেওয়া, সেগুলো পঁচে গলে গিয়েছিল, কারও কারও মৃতদেহ থেকে কাক-শকুনেরা নাড়িভূড়ি বের করে ফেলেছিল। কোনো কোনো মৃতদেহ এতটাই ক্ষত-বিক্ষত ছিল যে স্বজনেরা তাঁদের প্রিয়জনের মৃতদেহটি শনাক্ত পর্যন্ত করতে পারেনি।

শনাক্ত যে করতে পারেননি সে কথা জানালেন শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার। তিনি বলেন, আমার বাবাকে ১৪ ডিসেম্বর বিকেলবেলায় বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হবার পরে অনেকে মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, আবার অনেকেরটা পাওয়া যায়নি। যেমন করে আমি আমার বাবার লাশ খুঁজে পাইনি। তবুও এখানে আসি, মনে হয় বাবা হয়তো এখানেই রয়েছেন।

কথা হয় শহীদ চিকিৎসক আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরীর সঙ্গে । তিনি বলেন, বধ্যভূমির যে কালো স্তম্ভটি রয়েছে সেখানেই খুঁজে পাওয়া যায় আমার বাবার মৃতদেহ, শাবল দিয়ে খুঁড়ে পাওয়া যায় তাঁর মৃতদেহ। তাই এখানে এলে বুকের ভেতর কাঁপে, কারণ এখানে আমার বাবার রক্ত মিশে আছে। শহীদ সন্তানরা বলেন, বুদ্ধিজীবী দিবস কেবল একটি দিন নয়, তাঁদের কাছে এ দিনের সঙ্গে মিশে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাবা হারানোর মধ্যে দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ আর লাল সবুজের পতাকা পাওয়া।

কথা হয়, ৮৮ বছরের নূর হোসেনের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে ফিরে যান ১৯৭১ সালে জামালপুরে। যেখানে তিনি যুদ্ধ করেছেন কর্নেল তাহেরের অধীনে। তিনি ছিলেন তখন গ্রুপ কমান্ডার। নূর হোসেন বলেন, যুদ্ধের সময়ে তার বয়স ছিল ৪২ বছর। নিজের দেশ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিমাতা সুলভ আচরণ, গ্রামে গ্রামে নারী নির্যাতন আর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া মানতে পারেননি। দেশ স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে সেদিন যুদ্ধে গিয়ে নিজের কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রাখতে পেরেছিলেন, ঘর পালিয়ে যুদ্ধে গিয়ে বীরের বেশে ফিরে আসেন যুদ্ধজয় করে।

নূর হোসেন বলেন, বুকের ভেতর এখনও বাজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আজকের দিনে আমি কেবলই শ্রদ্ধা জানাতে চাই যাদের প্রাণের বিনিময়ে এই মাটিতে আমরা এখন হাঁটতে পারছি, বাঁচতে পারছি। তাদের আত্মত্যাগ ছাড়া লাল-সবুজের পতাকা আমাদের হতো না।

জয়িতা, নুজহাত-শমী এবং নূর হোসের মতো শত শত মানুষ ১৪ ডিসেম্বর বদ্ধভূমিতে এসেছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে, তাঁদেরকে স্মরণ করতে।

তবে সবাই যে আজ বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন তাই নয়। এমন দিনেও বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে অনেকেই ব্যস্ত ছিলেন সেলফি তুলতে, কেউবা আবার এসেছিলেন বন্ধুদের নিয়ে কেবলই ঘুরে বেড়াতে। কেউ এসেছিলেন টিভি পর্দায় নিজের মুখ দেখাতে।

টিভি সাংবাদিকরা যখন সেখান থেকে নিজ নিজ অফিসে সংবাদ দিচ্ছিলেন লাইভে তখন কেউ কেউ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে টেলিভিশন স্টেশনের নাম ধরে বলছিলেন, টিভি অন করলেই তাকে দেখা যাবে। তাদেরকে অনেক বলেও থামানো যাচ্ছিল না।  বিরক্তি আর উপদ্রব হজম করেই নিউজ কাভার করছিলেন টেলিভিশন সংবাদকর্মীরা।

স্কুলের ছাত্রীদের বিরক্ত করার মতো ঘটনাও এমন দিনে ঘটে এখানে! ছাত্রীরা বিরক্ত হয়ে বলেছেন, মানুষ কতটা বিকৃত হলে এখানে এসে আমাদের বিরক্ত করার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।

বিভিন্ন স্কুল কলেজ থেকে যখন ছাত্র ছাত্রীরা বধ্যভূমির মূল বেদিতে ফুল দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে তখন কাউকে কাউকে দেখা যায়, বধ্যভূমিকে পেছনে রেখে সেলফি তুলতে । একজন মানুষ হিসেবে আমি যা দেখে ভীষণ কষ্ট পাই— এমনদিনেও শহীদদের অসম্মান করা! তাইতো শহীদ আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী বলেছেন, আজকের দিনটি স্মরণ করে হলেও আমরা যেন এই জায়গাটির, এই মাটির পবিত্রতা রক্ষা করি।

লেখক : সংবাদকর্মী, সারাবাংলা

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন