বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, দায় কার?

July 19, 2018 | 11:11 pm

এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো আজ। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি। এই ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ হতাশা, গ্লানি, ক্ষোভে আত্মহত্যা করছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। কৈশোরে-তারুণ্যে আত্মহত্যার একটি অন্যতম কারণ পরীক্ষায় ফেল করা।

বিজ্ঞাপন

আমরা যারা নিউজরুমে বসে কাজ করি তাদের কাছে এটি প্রায় প্রত্যাশিত খবরই। প্রতিবারই বিভিন্ন সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বিকেল থেকে গভীর রাত অব্দি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফললাভ করতে না পারা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা খবর আসে। এর রেশ থাকে পরের ক’দিন পর্যন্ত।

কেন এই আত্মহত্যা? চাইলে হয়তো অনেক মনিষীর বক্তব্য উদ্ধৃত করা যাবে, যারা আত্মহত্যার বিপক্ষে নানা কথা বলেছেন। কিন্তু এসবের বাইরেও একটি কথা থেকে যায়। কেন একটি কিশোর বা কিশোরী মৃত্যুর পথ বেছে নেবে? যখন কেউ উপলব্ধি করে যে, তার জীবনের কোনো মূল্য নেই, তখন সে আত্মহত্যা করে- এটি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী কেন উপলব্ধি করবে যে এই পরিবার তথা সমাজের কাছে তার কোনো মূল্য নেই। এই উপলদ্ধিটির জন্য কিন্তু দৃশ্যত এই সমাজব্যবস্থা তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থাই দায়ী।

রাষ্ট্র সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠা করেছে, ‘এ প্লাস’ পাওয়া শিক্ষার্থীরাই মেধাবী। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) থেকেই এই বৈষম্যের সূত্রপাত। পিইসিতে ভালো ফলাফল না করলে ক্লাস ফাইভের পর ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে না। এরপর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) আর এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল না করলে ভালো কলেজে অ্যাডমিশন মিলবে না। আর এইচএসসিতে ভালো ফল না করলে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পিছিয়ে থাকতে হবে। এটি এখন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত সত্য। আর এ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রভাব পড়েছে সমাজের শিক্ষানীতিতে। আর শিক্ষানীতির প্রভাব ও চাপ গিয়ে পড়েছে অভিভাবকদের ওপর। আর অভিভাবকরা এই চাপ উগড়ে দিচ্ছেন কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের ওপর।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এটি বোঝার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি যে, এ প্লাস না পেলে মেধাবী নয়- এমন চিন্তাটিই সঠিক নয়। সমাজের এমন একচোখা দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই গোগ্রাসে গিলে উগড়ে দিচ্ছে পরীক্ষার খাতায়। যার ফলাফলে ‘এ প্লাস’ অনেকেই পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত অর্থে পরিপূর্ণ মেধাবিকাশ হচ্ছে না কোথাও।

জীবনের পথে কাগুজে সার্টিফিকেটে ভালো নম্বর পাওয়ার ইঁদুরদৌড়ে ছুটতে গিয়ে এই কোমলপ্রাণরাই ছিটকে পড়ছে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে। ছাপানো কাগজ যে শিক্ষার্থীদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারে না এ কথাটি উপলব্ধি করতেই পারছেন না শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর অভিভাবকরা। আমাদের অভিভাবকদের বোঝা উচিত যে সন্তানের মেধা যে পথে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় বা পূর্ণতা লাভ করে সে পথেই তার প্রকৃত মঙ্গল রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের কাগুজে এই পড়াশোনার পাশাপাশি কেউই শেখাতে পারছেন না গূঢ় সত্যটি। বুঝিয়ে বলতে পারছেন না, মানবজীবন হচ্ছে সফলতা-ব্যর্থতার পালাবদলের এক অবিরত ধারা। কোনো একটি কাজে বা পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয়। এ জন্য আত্মহত্যা করাটা তো নেহায়েতই বোকামি।

বিজ্ঞাপন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের রমরমা এই সময়ে আমাদের দেশের এইচএসসি পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থীই এই মাধ্যমটির সঙ্গে যুক্ত। এই ফেসবুকের বদৌলতেই তাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই অজানা নেই, পৃথিবীর অনেক সফল, বিখ্যাত ব্যক্তি পড়াশোনায় তেমন ভালো করতে পারেননি। এদের মধ্যে এমনকি ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মার্ক জাকারবার্গ, প্রযুক্তি দুনিয়ার নমস্য স্টিভ জবস, বিল গেটস থেকে শুরু করে ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন, আইনস্টাইন এমনকি আমাদের রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুলরা রয়েছেন। পাস ফেল এবং মেধা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও সম্পূর্ণ নির্ভর নয়।

সঙ্গে এটিও ঠিক, পরিবর্তিত এই সময়ে জীবনের পথ চলায় সার্টিফিকেটেরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু এটি জীবনের চেয়ে দামি কখনোই নয়। বুঝতে হবে এটিই জীবনের শেষ নয় আর কেউই একা ব্যর্থ হয় না। আরো অনেক পথ খোলা রয়েছে। নিজেকে কিছুটা সময় দিয়ে গুছিয়ে নিলেই এই প্রাথমিক বিপর্যয় সামাল দেওয়া যায় অনায়াসেই। আর কোনো মানুষ কখনোই ব্যর্থ হয় না, তার কিছু চেষ্টা, কাজ ব্যর্থ হতে পারে বরং।

এসব ক্ষেত্রে সাময়িক ব্যর্থতাগুলোকে ভয়াবহ রূপ দেওয়া কখনোই কাম্য নয়। নিজেকে অতিরিক্ত দোষারোপ না করে নিজের প্রতি আরো যত্ন নিয়ে—ভালো লাগার কাজটি করে গেলে সাফল্য নিশ্চিত।

আর ব্যর্থতা, বিপর্যয়ে যাতে সন্তান সহজে মুষড়ে না পড়ে, ভেঙে না পড়ে, সে জন্য তাদের মানসিককাঠামো সবল, দৃঢ় করে গড়ে তুলতে হবে প্রত্যেক বাবা-মাকে। আঘাত পাওয়ার বা বিপর্যয়ের পর দ্রুত উঠে দাঁড়ানোর, ঘুরে দাঁড়ানোর মতো সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে সন্তানকে। সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করলেই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব সহজেই।

বিজ্ঞাপন

লেখক: সন্দীপন বসু, সাংবাদিক

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন