বিজ্ঞাপন

দেশি পোশাকে বিটলস, ফ্রিদা, পিংক ফ্লয়েড, রবীন্দ্রনাথ

August 8, 2018 | 2:13 pm

তিথি চক্রবর্তী।।

বিজ্ঞাপন

১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে ইংল্যান্ডে বিটেলস ব্যান্ড দল বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।  এই ব্যান্ড দলটি ছিল জর্জ হ্যারিসন, পল ম্যাককার্টনি, জন লেনন ও ড্রাম বাদক পিট বেস্ট এর মত নামকরা শিল্পীদের নিয়ে। তখনকার সঙ্গীত সমালোচক, বোদ্ধা ও ভক্তদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পায় বিটলস। ১৯৬২ সালে সঙ্গীত প্রযোজক জর্জ মার্টিনের উদ্যোগে বিটলসের শিল্পীদের নিয়ে ‘লাভ মি টু’ অ্যালবাম বের হয়। সেই বছর থেকেই বিটেলসের খ্যাতি শুধু ইংল্যান্ডে নয়, ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপ জুড়ে। ১৯৬৪ সালে আমেরিকা সফরের পর সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বিটলসম্যানিয়া। ১৯৬৭ সালে ভারত সফরের পর জন লেনন ও জর্জ হ্যারিসন পন্ডিত রবি শঙ্করের কাছে সেতারে তালিম নেন। শিল্পী লেনন এবং ম্যাককার্টনি অসংখ্য গানের সুর করেন।

 

বিজ্ঞাপন

তাদের জনপ্রিয়তা এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে, বিটলস ব্যান্ডের জনপ্রিয় তারকা গায়কদের মুখায়বটি উঠে আসে পোশাকে। তাদের ভক্তরা টি-শার্টের বুকে প্রিয় লেলন কিংবা জর্জ হ্যারিসনকে ধারণ করতেন ভালবেসে। কখনও বিটলসের কোন গানের লিরিক লেখা থাকতো কাপড়ে। বিটেলস ব্যান্ডের লোগো ‘কালো’ বলে কাপড়ে কালো রঙের লোগো ব্যবহার করা হত।

মেক্সিকান চিত্রশিল্পী ফ্রিডা কাহলো। মেক্সিকোতে জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোটবেলা থেকে ফ্রিদা সমাজের ছোট ছোট ব্যাপারগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতেন। তাঁর আঁকা ছবি শুধু মেক্সিকো শহরে নয়, লাতিন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়। ২০০৬ সালের মে মাসে তাঁর স্ব-প্রতিকৃতি `Roots’ ৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়, যা লাতিন আমেরিকার শিল্পের নিলামে রেকর্ড স্থাপন করেছিল। আজ পর্যন্ত তার ৪৪ টি শিল্পকর্ম নিলামে উঠেছে। এই শিল্পকর্মগুলো মনে করিয়ে দেয়, ফ্রিদা কাহলো ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান একজন শিল্পী।

 

বিজ্ঞাপন

যদিও ফ্রিদা কাহলো জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছিলেন, তবুও তিনি বেশ বর্ণিল জীবনযাপন করেছিলেন শিল্পের প্রতি আবেগের জন্য। নিজের ভেতরের শিল্পসত্তাকে কেন্দ্র করে জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন। ফ্রিডার অবয়বটিই ছিল অত্যন্ত শৈল্পিক। তাঁর ছবি আঁকা, সৃষ্টিকর্ম এবং জীবনাচরণের জন্য তিনি জনপ্রিয় হন শিল্পবোদ্ধাদের কাছে। ফ্রিডাও উঠে আসেন পোশাকে। তার সেলফ পোট্রেটগুলো ছাপা হয় পোশাকের বুকে।

বিটলস কিংবা ফ্রিডাকে স্ক্রিণপ্রিন্টের মাধ্যমে পোশাক কিংবা ব্যাগে, এমনকি জুতোতেও আনার রেওয়াজটি জনপ্রিয়তা পায় এবং ধারাটি বজায় থাকে। ভক্তরা তাদের প্রিয় শিল্পীদের প্রতি ভালবাসা এভাবেই পোশাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

ভিনসেন্ট উইলিয়াম ভ্যানগঘ একজন ওলন্দাজ চিত্রকর ছিলেন। তার আঁকা বেশ কিছু ছবি পৃথিবীর সবচেয়ে দামি শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে গণ্য করা হয়। শিল্পী ভ্যানগঘের অসংখ্য চিত্রকর্ম তার জীবনের শেষ দুই বছরে আঁকা। প্রাকৃতিক দৃশ্য, সূর্যমুখী ফুল, গমের ক্ষেত ইত্যাদি তার আঁকার বিষয় ছিল। ভ্যানগঘ তার শিল্পের মাধ্যমে গোটা পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ফলে এই শিল্পীর প্রতি দরদ ও শ্রদ্ধা থেকে তার অবয়বটি পোশাকে তুলে ধরেছেন ভক্তরা।

বিজ্ঞাপন

পোশাক ডিজাইনে এতদিন এ ধারাটি পাশ্চাত্যেই বেশি দেখা গেলেও আজকাল এদেশেও তা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ডিজাইনের ক্ষেত্রে এই ধারা এখন আর শুধু টি-শার্টেও সীমাবদ্ধ নেই। ফ্যাশন ডিজাইনাররা শুধু মাত্র পাশ্চাত্য ঢংয়ের পোশাক- টি-শার্ট বা প্যান্টে নয়, এদেশের চিরায়ত শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবী, ফতুয়া, শাল, ওড়নায় ফুটিয়ে তুলেছেন এই ডিজাইন। শার্লক হোমস, পিংক ফ্রয়েড, বিটেলস, ফেলুদা, ফ্রিদা, রবীন্দ্রনাথের চিঠি বা গান, জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও প্রতিকৃতি সম্বলিত ডিজাইন করা কাপড় স্থান করে নিয়েছে তরুণ তরুণীদের মনে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে নিত্য উপহার টিশার্টে বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকের প্রতিকৃতি, কবিতা, চিঠি ছাপিয়ে তরুণদের মন কেড়ে নেয়। নিত্য উপহার এখনও জনপ্রিয়। মূলত টি-শার্ট ও শাড়িতেই বিখ্যাত নিত্য উপহার- জানালেন নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান।

 

 

তিনি আরও বলেন, দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বজায় রাখাই আমাদের ‍উদ্দেশ্য। বিদেশি সংস্কৃতি অনুসরণ করে আমরা খুব কম পোশাক বানাই। আমাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সব পোশাকের সাথে ডিজাইনারের নাম লেখা থাকে। এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার ডিজাইনের পোশাক তৈরি করেছে নিত্য উপহার। এর মধ্যে ১২শ ৫০টি ডিজাইনের টি-শার্ট আছে। এগুলোর দাম ৩১০ থেকে ৪৯৯ টাকা। শাড়ীর দাম ১৬০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। জাতীয় দিবসকে কেন্দ্র করে পোশাক তৈরি করা হয়। এছাড়া গণিত অলিম্পিয়াড নিয়েও টি-শার্ট তৈরি করা হয়েছে। প্রধানত ছাত্র, শিল্পী, নাট্যকর্মী, সাহিত্যিক, যারা পাহাড়-পর্বতে ঘুরতে ও এভারেষ্ট জয় করার স্বপ্ন দেখেন তারাই আমাদের গ্রাহক।

ব্যতিক্রম পোশাক সবার নজর কাড়তে বাধ্য। এই ডিজাইনের টি-শার্টের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন অনেক তরুণ। বুকে চে গুয়েভারের প্রতিকৃতি সম্বলিত টি-শার্ট গায়ে রাহাত আহমেদকে প্রশ্ন করা হল- কেন এই ডিজাইনের টি-শার্ট পড়েন? উত্তরে জানালেন, চে এর প্রতি ভালবাসা থেকে পরি। এক ধরনের বিদ্রোহ প্রকাশ পায়। ফ্যাশনেও প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাই। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখনও রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দের কবিতা লেখা টি-শার্ট পরতাম। কারণ কবিতা আমার খুব ভাল লাগে। কবিতার ভাব ও অর্থ বুঝতে ইচ্ছা করে সবসময়। তাছাড়া কবিতা যখন কবির হাতের লেখায় পাই এবং তা টি-শার্টেও আসে, তা দেখতে খুব ভাল লাগে। আবার ফ্যাশনেও নতুন মাত্রা যোগ করে।

 

 

আমাদের ঐতিহ্যবাহী দেশীয় পোশাকে ফ্রিডা কি পিংক ফ্লয়েড, কিংবা ফেলুদা অথবা রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরার চিন্তাটি সবার আগে এসেছিল ফ্যাশন ডিজাইনার ফাইজা আহমেদের মাথায়। তার ফ্যাশন হাউস মানাসের মূল চিন্তাটি হল সৃজনশীল ও শিল্পভিত্তিক কাজ।

 

ফাইজা আহমেদ জানান, দেশের ক্ল্যাসিকাল ঘরানার সংকটময় পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য ফ্যাশনে এই ধারাটি চালু করার কথা ভাবা হয়। এখনকার অনেক তরুণ কবি, সাহিত্যিকদের কথা জানে না, কবিতা পড়ে না। কবিতা তাদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য এই ধারাটি মন্দ না। ফাইজা আরো বলেন, অন্য দেশের সাথে একটা সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করাও ছিল আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। দেশি কাপড় যেমন সুতি, খাদি ও অ্যান্ডির ওপর এই ডিজাইন করা হয়। শাড়ী, ফতুয়া, থি-পিস, ব্যাগে এই ধরনের ডিজাইন ভিন্নতা এনে দিতে বাধ্য।  শুধু তাই নয়,  বিছানার চাদর ও কুশন কাভারেও এ ডিজাইন ভিন্নতা আনে।

ফ্রিদা, ফেলুদা কিংবা শার্লক হোমসকে নিয়ে তৈরি করা শাড়ি পরতে ভালবাসেন নাদিয়া করিম।

তিনি বললেন, ফ্রিদাকে ভালবাসি। বিটলস, রবীন্দ্রনাথের গান ও জীবনানন্দের কবিতা পছন্দ করি। তাছাড়া ফেলুদা আমার পছন্দের চরিত্র। পছন্দের গান, কবিতাগুলো যখন নান্দনিকভাবে পোশাকে ফুটে ওঠে, তখন সেগুলো হয়ে ওঠে ভালবাসার মাধ্যম। হঠাৎ ব্যতিক্রম কিছু পরতেও ভাল লাগে, যা নতুনত্ব আনে।

শুরু থেকে এই ডিজাইনে শাড়ি, ফতুয়া, ওড়না, ব্যাগ, ব্লাউজ তৈরি করা হচ্ছে। শৈল্পিক ছোঁয়ায় রাঙানো এই পোশাকের জনপ্রিয়তা কম না। যারা সৃজনশীল মানুষই এই ডিজাইনের কাপড় পরতে বেশি পছন্দ করেন, জানালেন ফাইজা আহমেদও। মানাসে এই ডিজাইনের শাড়ির দাম সুতি ও সিল্ক ভেদে ৪,০০০ থেকে শুরু করে ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সিঙ্গেল কামিজ ও ফতুয়া ধরণভেদে ২০০০ থেকে ৬০০০ টাকা পর্যন্ত আছে। আর ব্লাউজের দাম ১৬০০ থেকে ২৮০০ টাকা। এখানে শিক্ষার্থীদের উপযোগী বিশেষ ধরনের ব্যাগ তৈরি করা হয়।

 

সব যুগেই ‍শিল্প- সাহিত্যচর্চাকে ঘিরে সংঘ, আড্ডা গড়ে উঠলেও পোশাকে তা ফুটিয়ে তোলা নিতান্তই শিল্পীর সচেতন প্রচেষ্টা। নান্দনিক ও স্বকীয় ডিজাইনের কারণে এই পোশাকগুলো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সত্যিকার কবি মন যাদের আছে তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের পোশাক উপযোগী।  শীতকালের পিঠা, সমুদ্র ও পাহাড়ের দৃশ্য, বৈশাখ কিংবা বর্ষার প্রকৃতি, পুরনো দিনের বাংলা ছায়াছবিসহ অনেক ধরনের শৈল্পিক বিষয় তুলে ধরার মাধ্যম হিসেবে পোশাককে বেছে নিয়েছেন ফ্যাশন ডিজাইনাররা। দেশি ফ্রেবিকস ব্যবহার করে কারুকাজ করা এসব পোশাকে নান্দনিকতার কোন কমতি নেই।

 

ছবি- মানাস ও নিত্য উপহার

সারাবাংলা/টিসি/ এসএস

 

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন