বিজ্ঞাপন

ইনুর আশ্বাসে সম্পাদক পরিষদের মানববন্ধন স্থগিত

September 28, 2018 | 2:29 am

।। সারাবাংলা ডেস্ক ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের প্রতিবাদে ২৯ সেপ্টেম্বরের ডাকা মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত করেছে সম্পাদক পরিষদ। বৃহস্পতিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এক বিবৃতিতে বলেন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে পূর্বনির্ধারিত এই মানববন্ধন কর্মসূচী স্থগিত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধকারী ধারাগুলো অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

বিবৃতিতে মাহফুজ আনাম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। আইনটি পাশের আগে সরকার ও সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও উদ্বেগ প্রকাশ করে আইনের কয়েকটি ধারা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট আপত্তি ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। আইনটি এভাবে পাস না করার জন্য জাতীয় সংসদের আপত্তি তুলেছিল বিরোধী দলের সাংসদেরাও। কিন্তু সব পক্ষের আহ্বানই উপেক্ষা করে সরকার কণ্ঠভোটে যেভাবে আইনটি পাস করে তা সংবাদমাধ্যমের জন্য দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ অবস্থায় রাজপথে প্রতিবাদ জানানো ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই সম্পাদক পরিষদ ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করে। কেবল সম্পাদক পরিষদই নয়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনও অনুরূপ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিবৃতিতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে সংবাদমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে তথ্যমন্ত্রী ৩০ সেপ্টেম্বর আলোচনার প্রস্তাব দেওয়ায়, ২৯ সেপ্টেম্বরের মানববন্ধন কর্মসূচী স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সম্পাদক পরিষদ।

মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমরা বরাবরই আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। এর আগেও মন্ত্রী যখন কোনো বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন, তাতে আমরা অংশ নিয়েছি, যদিও সেসব আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলা যাবে না।’

সম্পাদক পরিষদের অপর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মুক্ত সংবাদমাধ্যমের পরিপন্থী, বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধাত্মক। আইনটিতে মৌলিক যে ত্রুটিগুলো রয়েছে:

বিজ্ঞাপন

১. ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে এমন একটি আইন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি, বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

২. এই আইন পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

৩. এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।

বিজ্ঞাপন

৫. এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইত্যাদি ব্যবহারকারী সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করবে।

২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণীত হওয়ার সময় সরকার বলেছিল, সাংবাদিকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই; কারণ, আইনটি করা হয়েছে সাইবার অপরাধ ঠেকানো ও সাইবার অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে। বাস্তবতা হলো, সাংবাদিকসহ অন্য যারা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করতে গেছেন, তারা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কারাভোগ করেছেন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এখনো একইভাবে বলা হচ্ছে যে সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ঘটেনি, কিন্তু আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যে এই আইনেও সাংবাদিকেরা আবার একই ধরনের হয়রানির মুখোমুখি হবেন।

আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এ আইনের উদ্দেশ্য ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার করা। তাই এ আইন নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তার সংজ্ঞায়িত পরিধি অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার পরিধির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এই আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রকৃতির পরিপন্থী এবং তা অনুশীলনের প্রতিকূল, যে সাংবাদিকতা জনগণের জানার অধিকার সুরক্ষা করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি জনসমক্ষে উন্মোচন করে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কাজ ডিজিটাল প্রযুক্তির জগৎ নিয়ে, যে জগৎ অবিরাম বিকশিত হয়ে চলেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি জীবনের সর্বস্তরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা থেকে খাদ্য উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক লেনদেন পর্যন্ত সর্বত্রই ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমও এর বাইরে নেই।

অন্য ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজন ‘নিয়ন্ত্রণ’, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজন ‘স্বাধীনতা’। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কেন্দ্রীয় বিষয় কেবলই ‘নিয়ন্ত্রণ’, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা এতে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্যতম মৌলিক ত্রুটি, এর ফলে এ আইন সংবাদমাধ্যমের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটা ভীতিকর দিক হলো, এতে পুলিশকে এমন অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার বলে একজন সাংবাদিক ভবিষ্যতে তথাকথিত কোনো অপরাধ করতে পারেন কেবল এই সন্দেহে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারবে। পুলিশকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো জামিন–অযোগ্য। এর ফলে সাংবাদিকতা বাস্তবত পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়বে।

উদ্বেগের আরও একটি বিষয় হলো, এ আইনের অপরাধ ও শাস্তিসংক্রান্ত প্রায় ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন–অযোগ্য, ৫টি জামিনযোগ্য এবং একটি সমঝোতা সাপেক্ষ। ন্যূনতম শাস্তির মেয়াদ করা হয়েছে ১ বছর কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ ৪ বছর থেকে ৭ বছর কারাদণ্ড। এর ফলে অনিবার্যভাবে একটা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যেখানে সাংবাদিকতার স্বাভাবিক অনুশীলন অসম্ভব না হলেও হয়ে উঠবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

আইনটি শুধু তার উদ্দেশ্যের সীমানা অনেক দূর পর্যন্ত কেবল লঙ্ঘনই করেনি, এটি অস্পষ্টতায়ও পরিপূর্ণ। অস্পষ্টতার কারণে এ আইন অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। দেশ–বিদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যেসব আইনের শব্দচয়ন সুস্পষ্ট, যেখানে অপরাধগুলো সুনির্দিষ্ট এবং অপরাধের সঙ্গে শাস্তির মাত্রা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেসবের মাধ্যমে ‘আইনের শাসন’ ভালোভাবে অর্জিত হয়। আইনের ভাষাগত অস্পষ্টতা থেকে অপরাধ সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা এবং আইনের অপব্যবহারের সুযোগ ঘটে থাকে। যখন আইনের অপব্যবহার ঘটে, তখন স্বাধীনতা খর্বিত হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেক ত্রুটি হলো ‘অপরাধীদের’ শাস্তির মাত্রা নির্ধারণের বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে একই সময়ে পাস করা সড়ক নিরাপত্তা আইনের কথা বলা যায়। এ আইনে দুর্ঘটনায় মানুষ মেরে ফেলার সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ বছরের কারাদণ্ড। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিধান করা হয়েছে, ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট (১৯২৩) লঙ্ঘনের জন্য সাংবাদিকদের যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। কোনো সাংবাদিক তার মোবাইল ফোনে অপ্রকাশিত কোনো সরকারি নথির ছবি তুললে অপরাধী বলে গণ্য হবেন, অথচ এটি আজকাল খুবই সাধারণ একটি চর্চা।

সারাবাংলা/এএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন