বিজ্ঞাপন

‘যশোরে রোডের গাছ কাটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে সারাদেশ’

January 16, 2018 | 12:16 pm

তৌহিদ মনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

যশোর: ব্যর্থ হতে চলেছে ‘যশোর রোডে’র যশোর-বেনাপোল অংশের দু’পাশের শতবর্ষী গাছগুলো বাঁচানোর সবপ্রচেষ্টা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, পৌনে দুই শ’ বছরের পুরনো তিন শতাধিক রেইনট্রিসহ এ মহাসড়কের দু’পাশের ২ হাজার ৩১২টি গাছ কেটে ফেলার।

তবে পুরনো এই গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন পরিবেশবিদ, নিসর্গবিদ, সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা।

১৮৪২ সালে এই সড়কে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন যশোরের তৎকালীন জমিদার কালী পোদ্দার। যা এ মহাসড়কে ছায়া বিতরণের পাশাপাশি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

নিসর্গপ্রেমী ও লেখক বিপ্রদাস বড়ুয়া এ বিষয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্র কোনো কর্তৃত্ব বলেই এই গাছগুলো কাটতে পারে না। গাছকাটার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় না। একজন মানুষের সারাজীবনের আয়ের চেয়েও একটা গাছের আর্থিকমূল্য অনেক বেশি। যশোর রোডের এ সব গাছ কাটা হলে সারাদেশের মানুষ রুখে দাঁড়াবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষ গাছ না কেটে যদি রাস্তা করতে পারে তবে আমরা কেন পারব না? আমি বিভিন্ন জায়গায় গেছি, কোথাও শতবর্ষী গাছ তো দূরের কথা, আমার বয়সী গাছও পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। যশোর রোডের প্রাচীন এই গাছগুলো আমাদের রক্ষাকবচ, কোনোভাবেই এগুলো কাটা যাবে না।’

যশোর-বেনাপোল মহাসড়কটি পুনঃনির্মাণসহ চার লেনে উন্নীত করতে প্রাচীন এই গাছগুলো কাটার তোড়জোর শুরু হয় গত বছরের মার্চে। কিন্তু গাছগুলো রাখার জোর দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।

বিজ্ঞাপন

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের জুলাই মাসে গাছগুলো বাঁচিয়ে রেখে মহাসড়কটি পুনঃনির্মাণের ঘোষণা দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কিন্তু সড়ক বিভাগের বিশেষজ্ঞরা গাছ রেখে রাস্তা প্রশস্তকরণ সম্ভব নয় বলে জানালে আগের ঘোষণা থেকে সরে আসে কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি যশোরে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উচ্চপর্যায়ের একসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গাছগুলো কেটে ফেলার। সভায় উপস্থিত স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও মত দেন গাছ কাটার পক্ষে।

যশোর জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন বলেন, বেনাপোল দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর। দিনদিন বন্দরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। কিন্তু পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত যানবাহনগুলো এই সড়ক দিয়ে ঠিকমতো যেতে পারে না। তাই রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য রাস্তার দুইপাশে মরে যাওয়া ও বেশকিছু পড়ে থাকা গাছ কেটের ফেলার সুপারিশ হয়েছে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, যশোরে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। একটি হবে যশোর সদরে অপরটি কেশবপুরে। অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে এ সড়কে যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে। তাই দেশের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে গাছ কাটতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল বলেন, দেশের স্বার্থে, উন্নয়সের স্বার্থে সড়কের গাছগুলো কাটার কোনো বিকল্প নেই। রাস্তা হওয়ার পর ওই স্থানেই সবুজায়নের পক্ষেও আমাদের অবস্থান রয়েছে।

তবে সরকারি সিদ্ধান্ত যাই হোক- মহাসড়কটির দু’পাশে বসবাসকারীদের দাবি, পুরাতন গাছগুলো টিকিয়ে রেখে রাস্তা প্রশস্ত করা হোক। আর এটা করা হলে একদিকে যেমন ঐতিহ্যবাহী গাছগুলো টিকিয়ে রাখা যাবে, তেমনি মহাসড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। রক্ষা করা যাবে পরিবেশের ভারসাম্যও।

পরিবেশ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, উন্নয়নের স্বার্থে গাছ কাটতেই যদি হয়, তাহলে নতুন সড়কের পাশেও যেন নতুন করে গড়ে তোলা হয় সবুজ বেস্টনি।

গ্রীনওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক শেখ আশিক মাহমুদ সবুজ বলেন, এই গাছগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী। সড়ক সম্প্রসারণ হোক কিন্তু গাছের বিকল্প ভাবতে হবে। সামাজিক সবুজায়ন যেন অক্ষুণ্ন থাকে এই বিষয়টিও ভাবতে হবে।

যশোরের লেখক ও সাংবাদিক ফখরে আলম বলেন, ‘এ্ গাছগুলো আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী। যশোর-বেনাপোল সড়কে যে উন্নয়ন হচ্ছে তা থেকে আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি না। তবে সড়কের দুইধারে শীতল ছায়া-সবুজ ছায়া যেন থাকে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।’

যে কারণে বিখ্যাত যশোর রোডের গাছ : এ মহাসড়কটি ঐতিহাসিকভাবে যশোর থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটিশ শাসনামলে যশোর শহরে একটি বিমানঘাঁটি ছিল। ফলে সেই সময় এই বিমানঘাঁটির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি করার জন্য যশোর রোডের আধুনিকভাবে নির্মাণ করা হয়। সে সময় অনেক গাছ লাগানো হয় রাস্তার দুপাশে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই যশোর রোড দিয়েই লাখ-লাখ শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। শরণার্থীদের সেই ঢল নিয়ে বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে একটি কবিতা লেখেন। পরবর্তীতে গায়ক বব ডিলান এবং অন্যদের সহায়তায় সেই কবিতাকে তিনি গানেও রূপ দিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক সেই যশোর রোডের ১৭৪ বছরের প্রবীণ রেইনট্রি গাছগুলো বাঁচানোর জন্য কলকাতার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কবীর সুমন গান গেয়েছেন, ‘আমি চাই গাছ কাটা হলে শোকসভা হবে বিধানসভায়।’ এই গান এখন বৃক্ষপ্রেমীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে।

গাছ কাটার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে : উন্নয়নের নামে গাছ কাটার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।

তেল-গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, আশার কথা, যশোর রোডের শতবর্ষী হাজার গাছ কাটার বিরুদ্ধে যশোরের বিভিন্ন ব্যক্তি সংগঠনসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিবাদ ক্রমে সংগঠিত হচ্ছে। আহ্বান জানাই যার যার অবস্থান থেকে এই দুর্বৃত্ত তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন।

যশোরে রোডের গাছ বাঁচাও শিরোনামে ফেসবুক পেজ খুলে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে, গাছ গুলোর সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা এবং স্থানীয় মানুষের আবেগ বিজড়িত স্মৃতি। তাই শতবর্ষী যশোর রোডের গাছ বাঁচাও আন্দোলন, গাছ কাটা চলবে না। আসুন সবাই একসাথে প্রতিবাদ করি।

সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আইনি নোটিশ : ঐতিহ্যবাহী ‘যশোর রোডে’র যশোর-বেনাপোল অংশের উভয়পাশের শতবর্ষী ২ হাজার ৩১২টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চেয়ে আইনি নোটিশও পাঠানো হয়েছে সোমবার।

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ আইন অনুষদের প্রভাষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র শেখ মো. মহিবুল্লাহর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান  রেজিস্ট্রি ডাকযোগে এ নোটিশ পাঠান।

নোটিশে সড়ক ও জনপথের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, যশোরের পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের আগামী ৭ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আইনজীবী ইশরাত হাসান  বলেন, ‘সংবিধানের ১৮(ক) তে বলা আছে সরকার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবেন। গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। এ ছাড়া শতবর্ষী গাছগুলো দেশের ঐতিহ্য। তাই গাছ কাটার সিদ্ধান্ত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

সারাবাংলা/একে/আইজেকে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন