বিজ্ঞাপন

মামলার জালে দিশেহারা ভূমিহীনরা  

February 17, 2019 | 9:13 pm

।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ভাঙা-গড়ার মধ্যেই চলছে উপকূলীয় অঞ্চল। দিন দিন বাড়ছে বাস্তুহারার সংখ্যা। আশ্রয়ের খোঁজে দ্বারে-দ্বারে ঘুরছে ভিটিমাটি হারা হাজারো মানুষ। অথচ নতুন জেগে ওঠা চরাঞ্চলে তাদের আশ্রয় দেওয়ার কথা থাকলেও পুনর্বাসনের নামে ভূমি চলে যাচ্ছে বিত্তবানদের দখলে। এমন চিত্র নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে। সম্প্রতি এলাকাটি ঘুরে এসেছেন সারাবাংলার স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন। এ নিয়ে আজ থাকছে পাঁচ পর্বে তৈরি ধারাবাহিক প্রতিবেদনটির চতুর্থ পর্ব।

নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপের এমন কোনো ভূমিহীন নেই, যার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।  ভুক্তভোগীদের অভিযোগ—কোনো অপরাধ না করেও মামলার আসামি হতে হচ্ছে তাদের।  তারা বলছেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ও ভূমিদস্যুরা ভূমিগ্রাসের হীনউদ্দেশ্যেই তাদের বিরুদ্ধে একের পর মামলা দিয়ে যাচ্ছে। শুধু মামলাই নয়, ভূমিহীনদের স্ত্রী বা কন্যাসন্তানদেরও ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে প্রভাবশালীদের বাহিনীর সদস্যদের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে ভূমিহীনরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ও গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।  কেউ কেউ মামলা চালাতে গিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করতেও বাধ্য হচ্ছেন।  সেই সুযোগে ভূমিহীনদের বাড়ি-জমি নিজেদের দখলে নিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালী ও ভূমিদস্যুরা।

একখণ্ড জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে ১২ বছর ধরে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন নিঝুমদ্বীপের বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেন মো. গনি (২৮)।  নিজের ওপর নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আঙ্গো (আমাদের) ঘর আগুন দিয়া পোড়াইছে, মালামাল লুট করছে, আঙ্গো জায়গাও দখল করছে, আবার আঙ্গো বিরুদ্ধেই মামলা দিছে। গত মাসেও ইউএনও অফিসের একটা মামলায় একমাস জেল খাইটা জামিন পাইছি।  একদিকে ইউএনও অফিসের মামলা, অন্যদিকে ফরেস্টের (বনবিভাগ) মামলা।  আছে বড় লোকদের অত্যাচারও। ’

বিজ্ঞাপন

নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমি বন্দোবস্তের অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধানে গেলে সন্ধান মেলে মো. গনির মতো এমন আরও অনেকের।  ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, কাগজে-কলমে এই এলাকায় চরবাহাউদ্দিনে (দমারচর) ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ২০০ জনকে। কিন্তু চরবাহাউদ্দিনে গিয়ে দেখা মেলেনি কোনো ভূমিহীন পরিবারের।

ভূমিহীনদের মারধর করা প্রসঙ্গে গরু-মহিষের রক্ষণাবেক্ষণকারী সুমন বলেন, ‘ওরা এ চরে আই বাড়িঘর করছে (ওরা এই চরে এসে ঘরবাড়ি করেছে)।  এ চর নাকি ওঁছখালী ও জাহাজমারার বড় বড় লোকদের।   তাগোরে নাকি বন্দোবস্ত দিছে।  অন হেতাগো (তাদের) জমিতে ওরা বাড়িঘর করছে কিল্লায়? এটা ছাড়ি দিতে কয়।  কিন্তু ওরা (ভূমিহীনরা) তো ছাড়তেছে না।  তাই মারধর করে, ঘরে আগুন লাগায়।  বউ-বেটিগোরে ধর্ষণ করে।  ভয়-ভীতি দেখায় তাগোরে দুয়াই (তাড়িয়ে) দিছে।’

জমি বুঝে পেতে বন্দোবস্ত পাওয়া স্থানীয়দের বিক্ষোভ

সুমনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দমারচর থেকে ফিরে আসি নিঝুমদ্বীপে।  বেড়িবাঁধের পাশে একটি বাড়িতে দেখা মিললো মো. গনি ও তার চাচা জামালের। সেখানে আরেক ভূমিহীন নিজামের ঘরের সামনে একটা ছোট্ট ঘর তুলে থাকছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

এই প্রতিবেদকের উপস্থিতির খবর পেয়ে ভূমিহীনরা জড়ো হতে থাকেন ওই বাড়িতে।  এরপর একে একে বলতে থাকেন তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা।

উপজেলা ভূমিহীন পুনর্বাসন সমবায় সংস্থায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্দোবস্ত পাওয়া বাসিন্দারা ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বনবিভাগ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দায়ের করা শতাধিক মামলায় আসামি হয়েছে।  এসব মামলার আসামির সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ভূমিহীন ব্যক্তি।

কথা হয় নিঝুমদ্বীপের বেড়িবাঁধের পাশে আশ্রয় নেওয়া ভূমিহীন রোকেয়ার (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, ২০০৭ সালের দিকে তারা জাহাজমারার বেড়িবাঁধের পাশে থাকতেন। একদিন প্রতিবেশীদের মাধ্যমে তার স্বামী জানতে পারেন, নিঝুমদ্বীপের পাশে জেগে ওঠা নতুন দমারচরে ভূমিহীনদের জন্য ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে।  ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে ভূমি বন্দোবস্তের টোকেন সংগ্রহ করেন তার স্বামী।  সেই টোকেন নিয়ে ওই চরে ১ হাজার ২০০ পরিবারের সঙ্গে তার স্বামীও ঘর তোলেন। ১২ বছরের এক মেয়ে ও ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতে শুরু করেন তার। কিন্তু বছর দুয়েকের বেশি সেখানে থিতু হতে পারেননি তারা। ২০০৯ সালের দিকে প্রভাবশালীদের দায়ের করা এক মামলায় ৩৫ জন ভূমিহীন বাসিন্দাকে আটক করে পুলিশ, নেওয়া হয় কারাগারে।  এরমধ্যে ছিলেন রোকেয়ার স্বামীও। ১৮ দিন পর তার স্বামী জামিনে ছাড়া পেলেও এর মধ্যেই রোকেয়াদের শিকার হতে হয়েছে ‘পাশবিকতার’।

রোকেয়া বলেন, ‘আমার বেডারে (স্বামী) বাহিনীরা ধরে নিয়ে পুলিশে দিলো। ওই রাইত (রাত) ১১টা-১২টার দিকে ১৫-২০ জনের মতো বাহিনী আঙ্গো (আমাদের) ঘরে ঢুকি আমার ছেলে দুইটারে ছুরি দিয়ে ভয় দেখায় চুপ করাই রাইখছিল। বইলছিল (বলেছিল), কান্নাকাটি করলে মারি হালাইবো (মেরে ফেলবে)।  এ ভয় দেখায় হেগুনে (তারা) ঘরের বাইরে নিয়ে গেছে দুজনরে। আর ৫/৬ জনে আমার বড় মাইয়্যারে মারধর করি কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধি বাগানে লই গেছে (বাগানে নিয়ে গেছে)।  আর বাকিরা আমারে মারধর করে ঘরের ভেতরে আটকায় যা করছে, বলার মতো না ভাই।  তাদের অত্যাচারে একসময় দিস হারালাই (জ্ঞান হারালাম)। সকালে দিস আইবার হরে মাইয়্যারে খুঁজতে বাহির হই।  তখন দেখি মাইয়্যা বাগানের দিকেরতুন কান্দি কান্দি আইতেছে।’ (জ্ঞান ফিরলে মেয়েকে খুঁজতে বের হয়ে দেখি, মেয়ে বাগানের দিক থেকে কাঁদতে কাঁদতে আসছে)।

বিজ্ঞাপন

নির্যাতি এই নারী আরও জানান, দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তারা ওই চর থেকে পালিয়ে আসেন।  তার স্বামীকে এখনও  মামলায় হাজিরা দিতে যান। যখনই মামলার হাজিরার তারিখ পড়ে, তখনই অত্যাচারের কথা আবারও মনে পড়ে বলেও তিনি জানান।

দমার চরের একজন ভূমিহনি

কেবল রোকেয়া বা তার পরিবারই নয়, একখণ্ড জমির আশায় এমন নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছে নিঝুমদ্বীপের বেড়িবাঁধের পাশে প্রায় সব পরিবারকেই। এসব পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তাদের মধ্যে অর্ধশত নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু থানায় অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি তারা। তাদের অভিযোগ, থানায় মামলা দিতে গেলে অভিযোগ আমলে নিতো না পুলিশ।  প্রভাবশালীদের বাহিনীদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই প্রশ্রয়ে দিনদিন অত্যাচার বেড়েই চলেছে ভূমিহীনদের ওপর।  এছাড়া আছে উল্টো মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হুমকিও।

একই অভিযোগ ভূমিহীন নেতা আবুল কাশেমে। তিনি বলেন, ‘এমন নির্যাতনের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম। কমিশনের পক্ষ থেকে সরেজমিনে এসে তদন্তও করেছিল। কিন্তু ওই তদন্তই শেষ, কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। কিন্তু আমরা ভূমিহীনরা নির্যাতিত হয়েও আজও মামলার আসামি। আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে আবার আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা দিয়েছে।  আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’

ভূমিহীনদের এসব অভিযোগ নিয়ে কথা হয় হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান শিকদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভূমিহীনদের অভিযোগ পুলিশ আমলে নেয়নি, সেসব ঘটনা আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগের।  তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে।  কিন্তু আমি যতটুকু শুনেছি, এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল থানা পুলিশ।  তবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সব অভিযোগই আমলে নেওয়া হচ্ছে, কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।’

নিঝুমদ্বীপের বাসিন্দা। 

মামলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন নোয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম।  তিনি বলেন, ‘হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে বনের গাছ কাটা ও অবৈধভাবে বনে ঢোকার অভিযোগে শতাধিক মামলা করা হয়েছে।  কিন্তু এসব মামলায় কে ভূমিহীন, কে প্রভাবশালী, তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। ’

তৌহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘কেউ বন ধ্বংসের চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করতে আইনের সহায়তা নেই। ’

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় নোয়াখালী জেলা প্রশাসক তন্ময় দাসের সঙ্গে।  তিনি বলেন, ‘যেসব ভূমিহীন বিনা অপরাধে মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তাদের বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’  প্রয়োজনে মামলা বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।

আরও পড়ুন: 

তৃতীয় পর্ব: খাস জমি বন্দোবস্তে নিয়মের তোয়াক্কা করছে না হাতিয়া ভূমি অফিস!

দ্বিতীয় পর্ব: জমি বনের, বন্দোবস্ত দেয় ভূমি অফিস!

প্রথম পর্ব: দুর্গম চরেও ঠাঁই মিলছে না ভূমিহীনদের

 

আগামী কাল পড়ুন:  এমপি-চেয়ারম্যানের দখলে উপকূলের খাসজমি

সারাবাংলা/এসএইচ/এমএনএইচ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন