বিজ্ঞাপন

সাব-স্টেশন থেকে আগুন, গ্লাস ডেকোরেশন দেখে হতবাক ফায়ার সার্ভিস

April 2, 2019 | 8:11 am

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বিদ্যুতের সাব-স্টেশন যেকোনো ভবনের নিচতলায় বসানোর নিয়ম থাকলেও বনানীর কামাল আতাতুর্ক সড়কের ফারুক-রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারে সেই সাব-স্টেশন ছিল অষ্টম তলায়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, সেই সাব-স্টেশন থেকেই এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ সেই আগুনের সূত্রপাত। আর নিচ তলা থেকে ২২ তলা পর্যন্ত গোটা ভবনটি গ্লাস দিয়ে ডেকোরেশন করা, যেখানে কোথাও কোনো ফাঁক নেই। এমন একটি বহুতল ভবনের এমন ডেকোরেশনকে মৃত্যুকূপের সঙ্গে তুলনা করছেন ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত দলের সদস্যরা।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, এফআর টাওয়ার সমবায় সমিতির সহসভাপতি ও অষ্টম তলার মালিক সেলিম উল্লাহ প্রভাব খাটিয়ে সাব-স্টেশনটি নিজের মালিকানাধীন ফ্লোরে বসিয়েছিলেন বলে জানতে পেরেছেন ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির সদস্যরা। শুধু তাই নয়, রান্নার জন্য একটি গ্যাসের লাইনও নিয়েছেন তিনি।

সোমবার (১ এপ্রিল) এফআর টাওয়ার পরিদর্শনের সময় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির একজন সদস্য সারাবাংলাকে এসব কথা বলেন। গত ২৮ মার্চ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের এই বহুতল ভবনটিতে আগুন লাগে। তাতে ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই আগুনের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস। সেই কমিটিই তদন্তের অংশ হিসেবে এফআর টাওয়ার পরিদর্শন করছে।

তদন্ত

ভবনের বিভিন্ন তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে

তদন্ত কমিটির ওই সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে আমরা ভবনটির নানা দিক পরিদর্শন করছি এবং নোট করছি। প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য মিলছে। এসব তথ্য রীতিমতো ভীতিকর। বিদ্যুতের সাব-স্টেশন কিভাবে ভবনের ভেতরে রাখা হয়? ভবনের চার তলা ও ৯ তলায় সিঁড়ি কেটে বানানো হয়েছে ঘর। লাগানো হয়েছে দরজা। কেউ ওপরে উঠতে বা নিচে নামতে গিয়ে ভাববে, সিঁড়ি মনে হবে এখানেই শেষ। অথচ ঘরের ভেতর দিয়েই ওপরে ওঠা যায়। নিয়ম লঙ্ঘন করে এসব করেছেন আট তলার মালিক সেলিম উল্লাহ।

বিজ্ঞাপন

ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত দলের পরিদর্শনে জানা গেছে, সেলিম উল্লাহর অফিস ভবনের আট তলায়। স্পেকট্রা অ্যাসেনশিয়াল নামে তার একটি বায়িং হাউজের অফিস সেখানে। কিন্তু ভেতরে গিয়ে খাতা, কালি ও দাহ্য পদার্থ পাওয়া গেছে। রান্না ঘরে গ্যাসের লাইনের সংযোগ পাওয়া গেছে। চমকে ওঠার মতো তথ্য হচ্ছে, একটি লাইনের ভেতরেই সব লাইন বসানো হয়েছে। বৈদ্যুতিক লাইন, গ্যাস লাইন, ইন্টারনেট, টেলিফোন, সুয়ারেজ— সব একসঙ্গে প্লাস্টিকের পাইপের ভেতর দিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভবনের নিচ তলা থেকে শুরু করে ২২ তলা পর্যন্ত একই ডেকোরেশন— পুরোটা গ্লাসের। কোথাও ফাঁক রাখা হয়নি। নিচে সিগারেটের ধোঁয়াও যদি উড়ত, তবে সেই ধোঁয়া ২২ তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার মতো পরিবেশ সেখানে করা হয়েছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির এই সদস্য।

আগুন লাগলে জরুরি নির্গমণের কোনো ব্যবস্থা সম্পর্কে এফআর টাওয়ার ব্যবহাকারী কারও কিছু জানা ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর সাইফুল ইসলাম বলেন, ভবনটিতে লিফট ছাড়া সিঁড়ি কোনো দিন ব্যবহার হতো বলে মনে হয়নি। ফায়ার এক্সিট কোন দিকে, সেটিও চোখে পড়েনি। এমনকি ভবনের কেউই জানত না যে জরুরি নির্গমণ পথটি কোন দিকে। হোস পাইপ একটি পাওয়া গেলেও সেটি ব্যবহার করার মতো ছিল না। আবার হোস পাইপ কিভাবে ব্যবহার হয় বা কোথায় রাখা আছে, সেটিও কেউ জানত না।

বিজ্ঞাপন

এফআর টাওয়ারের ম্যানেজার বেলায়েত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ভবন পরিচালনার জন্য একটি সমিতি আছে। ওই সমিতির সভাপতি কাশেম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসভিরুল ইসলাম চৌধুরী, আর সহসভাপতি সেলিম উল্লাহ। ভবনের জমির মালিক ফারুক হোসেন বিদ্যুতের সাব-স্টেশন বসানো এবং ওপরে বাড়তি ফ্লোর নির্মাণ নিয়ে রাজউকের কাছে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছিল। কিন্তু রাজউক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১৭ সালে হাইকোর্টে একটি রিটও করেছিলেন। সেই রিটেরও কোনো সুরাহা হয়নি।

সোমবার ভবনের ১৬ তলা থেকে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছিলেন ডার্ট গ্রুপের সহকারী ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভবনে যার জন্য আগুন লেগেছে, তাকেই তো পুলিশ ধরছে না। যারা কোনো দোষ করল না, তাদেরই ধরে রিমান্ডে নেওয়া হলো। সেলিম উল্লাহ কি ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থাকবে, নাকি তাকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে— প্রশ্ন তার।

এফআর টাওয়ারে কর্মরত কয়েকজন গার্ডসহ অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সেলিম উল্লাহ ভবনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার কথাতেই সবকিছু হয় এই ভবনে। এসব কথা বললেও নাম-পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি কোনো কর্মচারীই।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, অনেক আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিয়েছি। তবে বনানীর এফআর টাওয়ারের মতো কোথাও এত বেগ পেতে হয়নি। এমনিতেই আগুনের ঘটনা আমাদের দেরিতে জানানো হয়। ফায়ারের গাড়ি যখন রাস্তায় নামে, তখন প্রচণ্ড যানজট ছিল সড়কে। যানজট অতিক্রম করে পৌঁছাতে আরও ১৫ মিনিটের মতো দেরি হয়। যখন পৌঁছালাম তখন পুরো ভবন জ্বলছে। ভবনে প্রবেশের মতো কোনো পথ নেই। পুরো ভবন গ্লাস দিয়ে ডেকোরেশন করা। যেন একটি মৃত্যুকুপ তৈরি করে রাখা হয়েছে।

মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, ওই সময় ধোঁয়া বের না হতে পেরে ওপরের ফ্লোরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। ৮, ৯ ও ১০ তলায় আগুন নেভানোর জন্য আমি নিজে ফাইট করেছি। গ্লাসের কারণে তাপমাত্রা ছিল দুই হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। একটানা কয়েক মিনিটের বেশি কাজ করা যাচ্ছিল না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে গেলেও দেখা যায় দরজা লাগানো। কিছুক্ষণ পরপর ফাইটার ও পোশাক পরিবর্তন করতে হচ্ছিল। জীবন বাজি রেখে ফায়ারের কর্মীরা সেদিন কাজ করেছে। ডেকোরেশন দেখে আমরা হতবাক হয়েছি। ওপরের ডেকোরেশন ফিনাইল বোর্ড দিয়ে করা, আবার নিচে আগুন নেভানোর মতো কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। একই পাইপে সবকিছু ঢুকানো। যা পৃথিবীর কোথাও চোখে পড়েনি।

শাকিল নেওয়াজ আরও বলেন, বিগত কয়েক বছরে ফায়ারের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে উন্নয়ন হয়নি। এরপরেও আমাদের নিয়ে কথা হয়। আমরা কাজ বেশি করি, তাই আমাদের নিয়ে এত সমালোচনা। পাখি উদ্ধার, বিড়াল উদ্ধার, গরু উদ্ধার, এমনকি স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া-মারামারি করলে তাদেরও উদ্ধার করতে হয় আমাদের। আমরা আগুন নেভাই, ফায়ার ফাইটিং করি, কেমিক্যাল ফায়ারিংয়ে যেতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনাতেও যেতে হয়। আমরা কোন কাজটা করি না! এমনই একটি বিভাগ ফায়ার সার্ভিস, যাদের কল করলেই পাওয়া যায়!

এদিকে, সোমবার দিনভর এফআর টাওয়ার থেকে বিভিন্ন অফিসের মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। ভবনটি কবে নাগাদ সচল হবে না কি আদৌ সচল হবে না— এমন আশঙ্কা থেকেই অফিস স্থানান্তার করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ভবনের যারা চাকরি করতেন তাদের চাকরিতে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য মালামাল সরিয়ে নিতে পুলিশও সহায়তা করছে বলে জানালেন বনানী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিল্টন আহমেদ।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন