বিজ্ঞাপন

ইডেন গার্ডেনসে জিরো, লর্ডসে হিরো

July 15, 2019 | 5:57 am

বিশ্বকাপ ডেস্ক

৩ এপ্রিল, ২০১৬। আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল। স্থান ভারতের কলকাতার ইডেন গার্ডেনস স্টেডিয়াম। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইয়ে মুখোমুখি দুই দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ড। টস জিতে ইংল্যান্ডকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলপতি ড্যারেন স্যামি। ইংল্যান্ড নির্ধারিত ২০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে তুলে ১৫৫ রান। ইংল্যান্ডের পক্ষে দলীয় সর্বোচ্চ ৩৬ বলে ৫৪ রান করেন জো রুট।

বিজ্ঞাপন

১৫৬ রানের জয়ের লক্ষ নিয়ে খেলতে নেমে দলীয় ১১ রানেই প্রথম সারির ৩ ব্যাটসম্যানকে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। একপ্রান্ত আগলে রেখে খেলে যান মারলন স্যামুয়েলস। ড্যারেন ব্রাভো ২৫ রান করে স্যামুয়েলসকে কিছুটা সঙ্গ দিলেও অন্য ব্যাটসম্যানরা তেমন সুবিধা করতে পারেননি। জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ ওভারে দরকার ছিল ১৯ রান। উইকেট ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ব্যাটসম্যান স্যামুয়েলস ও ব্রাথওয়েট। শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করার মিশনে বোলিংয়ে এলেন অলরাউন্ডার বেন স্টোকস। ব্যাটিংয়ে স্ট্রাইকিং এন্ডে ছিলেন ব্রাথওয়েট।

স্টোকস প্রথম বল করলেন। লেগ স্ট্যাম্পের উপরে থাকা হাফ ভলি বল ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ অঞ্চল দিয়ে সীমানা ছাড়া করেন ব্রাথওয়েট। জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন তখন ৫ বলে ১৩ রান। স্টোকস দ্বিতীয় বল করলেন। ব্রাথওয়েট আবারও লংঅন অঞ্চল দিয়ে বল সীমানা ছাড়া করলেন। জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ৪ বলে ৭ রান। ওভারের তৃতীয় বল করেন স্টোকস। ব্রাথওয়েট আবারও ছক্কা হাঁকালেন। এবার লংঅফ অঞ্চল দিয়ে বল সীমানার বাইরে। ম্যাচ টাই। শিরোপা জয়ের জন্য ক্যারিবিয়ানদের প্রয়োজন ৩ বলে ১ রান।

ওভারের চতুর্থ বল করলেন স্টোকস। এবার ডিপ মিডউইকেট অঞ্চল দিয়ে ছক্কা হাঁকালেন ব্র্যাথওয়েট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে জয়ী হয়ে শিরোপা জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা। ব্র্যাথওয়েট ও স্যামুয়েলসকে ঘিরে মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের উল্লাস।

বিজ্ঞাপন

আর অন্যদিকে? শিরোপার খুব কাছাকাছি থাকা ইংল্যান্ড দলের খেলোয়াড়েরা বিমর্ষ অবস্থায় মাঠে। একজনের হতাশা সবাইকে ছাড়িয়ে গেলো। পরপর চার বলে চারটির ছক্কার মার স্টোকস যেন কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। জয়ের নাগালে থাকা ম্যাচ রূপ নিল হতাশায়।

ইডেন গার্ডেনসের সেই ফাইনালে পরাজিত ইংল্যান্ড দলের শেষ ওভারের বোলার হিসেবে বেন স্টোকসকে সেই ম্যাচের জিরো হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। এরপরে কেটে গেলো সময়। ২০১৬ পার হয়ে ২০১৭ ও ২০১৮। নিজেদের দেশের আয়োজিত বিশ্বকাপ উপলক্ষে প্রস্তুতি নিতে থাকলো ইংল্যান্ড। এই সময়ে বহু হোম আর অ্যাওয়ে ম্যাচে জিতেছে ইংল্যান্ড।

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ড-ওয়েলসে। দ্বিতীয় সেমি ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে ইংল্যান্ড। ফাইনালে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। প্রথমে ব্যাটিং করে ইংল্যান্ডকে জয়ের জন্য ২৪২ রানের টার্গেট দেয় কিউইরা। কিউইদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ইংল্যান্ডের রানের চাকা সীমাবদ্ধ থাকে। ইনিংসের ২০তম ওভার ও  লুকি ফার্গুসনের করা তৃতীয় ওভারের তৃতীয় বলে বোল্ড আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে যান ইংলিশ ওপেনার বেয়ারেস্টো। মাঠে আসেন বেন স্টোকস। উইকেটের অপরপ্রান্তে ইংল্যান্ড অধিনায়ক ইয়ন মরগান। ইংল্যান্ডের দলীয় সংগ্রহ ৩ উইকেটের বিনিময়ে ৭১ রান। জয়ের জন্য প্রয়োজন আরও ১৭১ রান।

বিজ্ঞাপন

বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে পারেননি অধিনায়ক ইয়ন মরগান। স্টোকসের সঙ্গে ১৫ রানের জুটি গড়ে ইনিংসের ২৪তম ওভারের প্রথম বলে বিদায় নেন তিনি। ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ৪ উইকেটে ৮৬ রান। ক্রিজে আসেন বাটলার। স্টোকসের সঙ্গে মিলে বাটলার গড়ে তুলেন ১১০ রানের জুটি। বিদায় নেওয়ার আগে বাটলার সংগ্রহ করেন ৫৯ রান। জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের প্রয়োজন তখন ৩০ বলে ৪৬ রান। স্টোকসকে সঙ্গ দিতে আসেন ক্রিস ওকস। কিন্তু খুব বেশি দূর সঙ্গ দিতে পারেননি তিনিও। জয়ের জন্য তখনো ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ২৪ বলে ৩৯ রান। প্লাঙ্কেটকে সঙ্গে নিয়ে স্টোকস গড়ে তোলেন আরেকটি ১৫ রানের কার্যকরী জুটি। ইনিংসের ৪৯তম ওভারের তৃতীয় বলে যখন ব্যক্তিগত ১০ রানে আউট হয়ে যান প্লাঙ্কেট, তখনো ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য প্রয়োজন ৯ বলে ২২ রান।

ইনিংসের ৪৯তম ওভারের চতুর্থ বলেই কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা পান স্টোকস। মিডউইকেট বাউন্ডারি অঞ্চল দিয়ে ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টায় উড়িয়ে মারেন তিনি। সীমানায় ক্যাচ তালুবন্দি করেন বোল্ট কিন্তু নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি তিনি। ক্যাচ তালুবন্দি অবস্থাতেই তার পা ছুঁয়ে যায় সীমানারেখা। ফলাফলে ছয়টি মূল্যবান রান যোগ হয় স্টোকসের ব্যক্তিগত এবং ইংল্যান্ডের দলীয় ইনিংসে। কিউই বোলার নিশামের করা সেই ওভারের পঞ্চম বলে এক রান সংগ্রহ করেন স্টোকস এবং শেষ বলে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে যান জোফরা আর্চার।

শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য প্রয়োজন হয় ১৫ রান। পারবেন কি স্টোকস ইংল্যান্ডকে ম্যাচ জেতাতে নাকি আবারও তীরে এসে তরী ডোবাবেন ইডেন গার্ডেনসের মতো! এমন আশঙ্কায় তখন গ্যালারিতে বুঁদ ইংলিশ ক্রিকেট ভক্তরা। কিন্তু এদিন ভাগ্যবিধাতার মনে হয়তো অন্য কিছুই ছিল।

ক্রিজে নবম উইকেট জুটিতে বেন স্টোকস এবং আদিল রশিদ। বোল্টের করা সেই ওভারে প্রথম দুই বলে রান পাননি বেন স্টোকস। তৃতীয় বলে ছক্কা হাঁকান স্টোকস। খেলায় তখনো এগিয়ে নিউজিল্যান্ড। কারণ জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের চাই ৩ বলে ৯ রান। চতুর্থ বলে ডাবল রান নেওয়ার পথে গাপটিলের থ্রো স্টোকসের ব্যাটে লাগলে অতিরিক্ত আরও চার রান আসে। পঞ্চম বলে রানআউট হন আদিল রশিদ। শেষ বলে দরকার হয় ২ রানের। ডাবল রান নেওয়ার পথে রানআউট হন মার্ক উড। খেলা টাই হলেও ৯৮ বলে ৫টি বাউন্ডারি ও ২টি ওভার বাউন্ডারি হাঁকিয়ে স্টোকসের সংগ্রহ ছিল ৮৪ রান।

বিজ্ঞাপন

ম্যাচ টাই হলে গড়ায় সুপার ওভারে। নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সুপার ওভারে বোলিং করেন ট্রেন্ট বোল্ট। সেখানে ব্যাটিংয়ে নেমে স্টোকস এবং বাটলার তুলে নেন কোনো উইকেট না হারিয়ে ১৫ রান। এই ওভারের প্রথম বলেই ৩ রান নেন স্টোকস। দ্বিতীয় বলে বাটলার নেন ১ রান। তৃতীয় বলে স্টোকস বাউন্ডারি হাঁকিয়ে নেন ৪ রান। চতুর্থ বলে স্টোকস ১ রান করে স্ট্রাইক দেন বাটলারকে। শেষ দুই বলে একটি বাউন্ডারি সহ ৬ রান যোগ করেন বাটলার। জয়ের জন্য সুপার ওভারে নিউজিল্যান্ডের টার্গেট দাঁড়ায় ১ ওভারে ১৬ রান।

সুপার ওভারে ইংল্যান্ডের পক্ষে বোলিংয়ে আসেন জোফরা আর্চার। প্রথম বলেই ওয়াইড করে বসেন এই তরুণ পেসার। কিউই অলরাউন্ডার জিমি নিশাম প্রথম ৪ বলেই তুলে নেন ১২ রান। জয়ের জন্য কিউইদের প্রয়োজন ২ বলে ৩ রান। পঞ্চম বলে নিশাম সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক দেন গাপটিলকে। শেষ বলে মিড উইকেট অঞ্চলে খেলে দ্রুততার সঙ্গে প্রথম রান নিতে পারলেও দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময়ে রানআউট হয়ে যান গাপটিল। ফলাফল আবারও টাই ম্যাচে। কিন্তু ম্যাচে বেশি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে শিরোপা জিতে নেয় ইংল্যান্ড।

ফাইনালে সুপার ওভারসহ ইংলিশদের চার ও ছক্কা ছিল মোট ২৬টি, নিউজিল্যান্ডের ১৭টি। ইংল্যান্ডের এই ২৬টি বাউন্ডারির মারে ৭টি বাউন্ডারি আসে স্টোকসের ব্যাট থেকে। ফলাফল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন।

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ১৯৯১ সালে জন্মগ্রহণ করা বেন স্টোকসই হয়ে গেলেন ম্যাচের হিরো, হারিয়ে দিলেন নিজের জন্মভূমিকে। ২০১৬ সালে ইডেন গার্ডেনের ফাইনালে যাকে জিরো হিসেবে দেখা হচ্ছিল সেই বেন স্টোকসই লর্ডসের হিরো হয়ে ম্যাচ জেতালেন ইংল্যান্ডকে। আর এই হিরো হওয়ার উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিলেন নিজের মাতৃভূমির বিপক্ষেই হওয়া ফাইনাল নামক মহামূল্যবান ম্যাচটিকে।

আর তাই দ্বাদশ বিশ্বকাপ আসরের ফাইনালের ম্যাচ সেরার পুরস্কারটিও যায় বেন স্টোকসের হাতেই। আর উঠবেই বা না কেনো? এক প্রান্ত আগলে রেখে যেভাবে দলকে নিয়ে গেছে জয়ের বন্দরে সেখানে অন্য সব কিছুই তাই ভুলে যাওয়া যায়। ভক্তরাও তাই ভুলে যাচ্ছেন ইডেন গার্ডেনস ম্যাচের সেই তিক্ত স্মৃতি। আজ যে স্টোকস আর তাদের জন্য ফাইনাল হারানো জিরো নন বরং বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল জেতানো হিরো।

সারাবাংলা/এসবি

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন