বিজ্ঞাপন

হ্যাটট্রিক জয়ে শুদ্ধির ধাক্কা, বছরজুড়ে ছিল অঙ্গীকার বাস্তবায়ন

January 1, 2020 | 6:00 am

নৃপেন রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় পেয়ে টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাও টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে তার নেতৃত্বে সরকার গঠনের একটি রেকর্ড করেছেন। টানা তিনবার বিজয়ী হয়ে মন্ত্রিসভা গঠনে চমকও রয়েছে তার। এমনকি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার অনুযায়ী মাদক-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে নব উদ্যোমে পথচলাও শুরু করেছেন তিনি। মাঝপথে শুদ্ধি অভিযানের ধাক্কা এসে লাগে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগসহ সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম ও অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে। এছাড়া দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলনেও নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দিকে খেয়াল রেখে ঘর ঘুছিয়ে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। দলটির গত এক বছরের পথচলা বিশ্লেষণে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্লেষণে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে চমক দেখায় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পায় ৩১টি নতুন মুখ। দলের অভিজ্ঞ নেতারা মন্ত্রিসভা থেকে ছিটকে পড়েন। বাদ পড়েন সরকারের বিগত দুই মেয়াদে মন্ত্রিসভায় থাকা মহাজোটের শরীক দলের প্রভাবশালী নেতারাও। এরপর নতুন সরকার গঠনের মাত্র ৫ মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলামকে শুধু স্থানীয় সরকারের মন্ত্রী করা হয়। স্বপন ভট্টাচার্য্য হন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বারকে শুধু ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর জুনাইদ আহমেদ পলককে রাখা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে। এছাড়া স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়।

বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, সরকার গঠনের পর ২০১৯ সালের প্রথম থেকেই সাংগঠনিক শক্তি আরও সুসংহত ও জোরালো করার কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ। শুরু হয় সমসাময়িক রাজনীতিতে আলোচিত শুদ্ধি অভিযান। নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির প্রশ্নে ‘জিরো টলারেন্সে’র অঙ্গীকার করা দলটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি নিজ দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়ে নজির স্থাপন করে। দলীয় ছত্রছায়ায় পরিচালিত ক্যাসিনোবিরোধী অভিয়ান শুরু করে সরকার। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। বাসাবাড়ি ও অফিসসহ মোট ১৯টি স্থানে অভিযান চালানো হয়। যার মধ্যে ১১টি ক্লাবে ক্যাসিনোর অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এর মধ্যে রাজধানীতে ৮টি এবং ৩টি চট্টগ্রামে। শুদ্ধি অভিযান দেশের সাধারণ মানুষ সমর্থন দেওয়া শুরু করে। শুদ্ধি অভিযানের ঝড়ের মধ্যেই দলের সহযোগী, অঙ্গ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সম্মেলনের ডামাঢোলের মধ্যেই ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে কয়েকজন দাপুটে নেতাকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর কাউন্সিলেও অপেক্ষাকৃত ক্লিন ইমেজের নেতাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আনা হয়।

বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ২১তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে দল এবং সরকারকে আলাদা করার পথে একধাপ এগিয়েছে আওয়ামী লীগ। বর্তমান মন্ত্রিসভার অনেক নেতাকেই এবার কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে স্থান পেয়েছেন মন্ত্রিত্বের বাইরে থাকা হাফ ডজন নেতা। কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী নেতৃত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের শর্ত পূরণের পথেও এগিয়েছে দলটি। এছাড়াও উপজেলা পরিষদ ও ইউপি নির্বাচনসহ বেশকয়েকটি পৌরসভা নির্বাচনেও দলীয় প্রার্থীদের জয়লাভ নিশ্চিত হয়েছে। ২০১৯ সালে দলটির জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল- সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্যের লাগাম টেনে ধরা। সেই চ্যালেঞ্জটিতেও সফল হয়েছে আওয়ামী লীগ।

বিজ্ঞাপন

বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের ৭ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার শপথের পর সারাদেশে পাঁচ ধাপে উপজেলা নির্বাচনের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১০ মার্চ। আর পঞ্চম ধাপের নির্বাচন ১৮ জুন অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ের মধ্যে পর্যাক্রমে আরও তিন ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা নির্বাচনের পর অনেক জায়গা পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ঝিমিয়ে পড়া মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কাউন্সিলর করার দিকে নজর দেয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। সে ধারাবাহিকতায় গত ৬ নভেম্বর কৃষক লীগ, ৯ নভেম্বর শ্রমিক লীগ, ১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ২৩ নভেম্বর আওয়ামী যুবলীগ এবং ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২১ ডিসেম্বর কাউন্সিল অধিবেশনে টানা নবমবারের মতো সভাপতির দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বহাল থাকেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

যুবলীগ-ছাত্রলীগের বিতর্কিত ধাক্কা

২০১৯ সালে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের প্রভাবশালী নেতাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বিব্রত করে দলের হাইকমান্ডকে। টানা মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে দলে অনুপ্রবেশকারীদের হটাতে শুদ্ধি অভিযানসহ তাদের তালিকাও প্রকাশ করতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর চাঁদা দাবিসহ বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড ছাত্রলীগকে রাজনীতির মাঠে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। বছরের শেষে এসে আবারও ছাত্রলীগ সমালোচনায় পড়ে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনায়। এছাড়া বছরের শেষ প্রান্তিকে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগের প্রভাবশালী কয়েক নেতার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টার অভিযোগ সারাদেশে মুখরোচক হয়ে ওঠে। এই সংগঠনগুলোর নেতাদের নানান কর্মকাণ্ড নিয়ে এক সভায় শেখ হাসিনার বিরক্তি প্রকাশের পর র‌্যাব ঢাকার ক্রীড়া ক্লাবগুলোতে অভিযান চালায়। অভিযানে ক্লাবগুলোতে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনায় যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতার নাম উঠে আসে। পরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়।

বিজ্ঞাপন

অনুভূতি হারানোর বেদনা

আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলতেন, ‘আওয়ামী লীগ এক অনুভূতির নাম।’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র চারদিন পর ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগে বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ৩ জানুয়ারি থাইল্যান্ডের ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। সৈয়দ আশরাফ ১৯৫০ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। আশরাফুল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ আশরাফের বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করার পর তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান। এরপর তিনি দীর্ঘদিন লন্ডনেই ছিলেন। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার অনুরোধে দেশে ফেরেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সৈয়দ আশরাফ কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে দলের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আরও কয়েকবার সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়ে সরকারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পান তিনি। এক সময় তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

এদিকে ১৮ জানুয়ারি মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য আশরাফুন্নেছা মোশারফ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২০০৯ সালে মহিলা সংরক্ষিত আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনীতিবিদ খন্দকার আবদুল বাতেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনও মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের মধ্যে গত বছর পর্যন্ত একমাত্র জীবিত নেতা ছিলেন শেখ আবদুল আজিজ। তাকেও হারায় দলটি। তিনি বাংলাদেশের যোগাযোগ, কৃষি, তথ্য এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ আজিজ রাজধানীতে ৮ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন