বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে কোয়ারেন্টাইন: সমালোচনার ব্যাখ্যা দিলেন চিকিৎসকরা

February 15, 2020 | 1:05 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: সম্প্রতি চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া নতুন ভাইরাস ‘করোনা’ আতঙ্ক ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ভাইরাসটির প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে, দেশে ঢোকার সবগুলো গেটওয়ে। এছাড়া, চীন থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ৩১২ জন বাংলাদেশিকে। কোয়ারেন্টাইনের জন্য তারা এখন আছেন আশকোনা হাজী ক্যাম্পে। তবে বাংলাদেশে সঠিকভাবে কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি মানা হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে নানা প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছেন দেশের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞাপন

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, জীবাণুর সংস্পর্শে আসা কাউকে যে পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় তাকে বলে কোয়ারেন্টাইন। অনেকেই বলেন, একসঙ্গে রাখলে তাকে কোয়ারেন্টাইন বলা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে চীন থেকে যে ৩১২ জন এসেছেন তাদের কী আমরা আলাদা আলাদা বিমানে নিয়ে আসতে পারতাম? তারা যেহেতু উহানে একসঙ্গেই ছিলেন। তাই তারা সেখানেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। বরং তারা সবাই সুস্থ। তবুও তাদের পর্যবেক্ষণের জন্য এই ব্যবস্থা। আর এই নিয়ম সারা পৃথিবীর জন্যেই এক।

তিনি বলেন, কোয়ারেন্টাইনের জন্য যে আন্তর্জাতিক নিয়ম তা সবই আছে আশকোনা হজ ক্যাম্পে। অন্যান্য দেশে যারা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে সেখানে থাকার জায়গা হয়তো কিছুটা ভালো কিন্তু সেখানেও সবাই একসঙ্গেই আছে। কারণ তারা কেউই রোগী নন। কাউকে বন্দী করে এক ঘরে রাখাও কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম না। আমাদের এখানেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনেই কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, হজ্ব ক্যাম্পে রাখার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব ছবি এসেছে সেগুলো খুবই নেতিবাচক। কারণ কোয়ারেন্টাইনের জন্য সবাইকে রাখা হয়েছে হজক্যাম্পের নতুন বিল্ডিংয়ে। সেখানে বিছানা, ফোম সেট, বালিশ, কম্বল সবকিছুই একবারে নতুন। হাসপাতালে বা হোটেলে গেলেও কিন্তু পুরনো জিনিসই দেওয়া হতো।

বিজ্ঞাপন

ড. মুশতাক হোসেন আরও বলেন, কোয়ারেন্টাইনে বিছানা কেনো দেওয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্ন যারা করছেন তাদের মাথায় রাখা উচিত যে হাসপাতালের বিছানা ডিসইনফেক্ট করে এনে দিলেও যে লাগবে তা পাওয়া যায় নি। বিকল্প হিসেবে ছিল ক্যাম্পের বিছানা যেখানে অনেকেরই সমস্যা হতো। আর তাই ফ্লোরে নতুন ফোমে রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে কেউ যদি বলে তাপমাত্রার কারণে কারও শরীর খারাপ হতে পারে তবে সেটিরও কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

ভবিষ্যতে কোয়ারেন্টাইনের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের এখনো আলাদা কোনো কোয়ারেন্টাইন সেন্টার ডেভেলপ করা হয় নি। বিমানবন্দরে একটি জায়গা ছিল। কিন্তু সেখানে অনেক ফ্লাইট ওঠা নামা করে তাই সেখানে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার না করাই ভালো। কাজেই বিমানবন্দর ও লোকালয় থেকে দূরে থাকতে হবে এমন স্থানেই একটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করা ভালো হবে। বর্তমান পরিস্থিতি হজ ক্যাম্প লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে দেখে এটিকে আমরা বলতে পারি নিরাপদ। সেখান থেকে রোগ ছড়ানোর আশংকা কম।

এ দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এক সেমিনারে জাপানে কর্মরত বাঙালি চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর বলেছিলেন, চীন থেকে আসা ৩১২ জন বাংলাদেশিকে যেভাবে হজক্যাম্পে রাখা হয়েছে সেটা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা নয়। কারণ এই ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেককে আলাদাভাবে রাখতে হয়। একজন আরেকজনের সংস্পর্শে না এসে যেন প্রত্যেকেই নিরাপদে থাকতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হয়। তাছাড়া তারা একই টয়লেট ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে খাবার খাচ্ছে। যা কোয়ারেন্টাইনের স্বাভাবিক পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে। ঢাকার মতো শহরে এ ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী সারাবাংলাকে বলেন, কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থায় আইইডিসিআর কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা তারা জানিয়েছেন। সেগুলোর বাইরে আমরা আরও কী কী পদক্ষেপ নিতে পারতাম তা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এক্ষেত্রে যদি ইউরোপ, আমেরিকার কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা করা হয় তবে তা ভুল হবে। তবে কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও আসলে আমাদের এর বেশি কিছু করার ছিল কি না সেটাও ভাবনার বিষয়।

কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতির কারণে ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনাভাইরাস, স্বজনদের এমন উৎকণ্ঠার বিষয়ে এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, এ নিয়ে উৎকণ্ঠার তেমন কিছু নেই। আক্রান্তদের বাসায় রেখে পর্যবেক্ষণে রাখতে বলা হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে। তবে এখন যারা কোয়ারেন্টাইনে আছেন তারা কিন্তু দেশের বাইরে থেকে এসেছেন। অন্য দেশে থেকে আসার পর তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখাই হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ। এক্ষেত্রে তাদের নিয়ম মেনেই কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।

সীমিত সামর্থ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চভাবে কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি মেনে চলা হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, চীন থেকে আসা বাংলাদেশিদের যথেষ্ট যত্ন নেওয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। অনেকেই বলেন, হোটেলে নিয়ে প্রতিটি রুমে একজন করে রাখা যেত। কিন্তু সেটা কি আসলে বাস্তবসম্মত? অস্ট্রেলিয়া বলেছিল, তারা একটি দ্বীপে রাখবে তাদের চীনফেরত নাগরিকদের। সেটা নিয়েও কিন্তু সমালোচনা হয়েছিল যে কেনো এমন করবে? আমি বলছি না যে আমাদের দেশের সরকার সর্বোচ্চটুকু করেছে। কিন্তু কিছু জরুরি পরিস্থিতিতে আসলে আস্থা রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

কোয়ারেন্টাইনে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাতে কারও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যারা এখন কোয়ারেন্টাইনে আছেন তাদের সচেতনতাও জরুরি। কোয়ারেন্টাইনে বিশ্বের অন্যান্য দেশে হয়তো আরও সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু জরুরি অবস্থায় আমাদের দেশে যা করা হয়েছে তাকে আমি বলবো স্বল্প সময়ের জন্য যথেষ্ট।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে জরুরিভাবে আনা বাংলাদেশিদের যেভাবে রাখা হয়েছে তাতে অসন্তোষের কিছু নেই। কারণ, দেশের জরুরি অবস্থায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। আমাদের দেশে এই করোনাভাইরাস সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয়। আর তাই কিছুটা উদ্বেগ থাকবেই। তবে কোয়ারেন্টাইনে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিশেষ কিছু নেই। মূল কথা হলো সবাইকে বুঝতে হবে যে একটা জরুরি পরিস্থিতিতে এই পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতে রাখা হয়েছে সবাইকে।

তিনি বলেন, কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানে কিন্তু তারা কেউই অসুস্থ নন। আক্রান্ত দেশ থেকে আসার কারণে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে তাদের। একটু সন্দেহজনক মনে হলেই তাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে ও হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন।

কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী হয়েছে। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করেই এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অর্থাৎ আমেরিকা বা ইউরোপের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা আর আমাদের ব্যবস্থা এক হবে না। আমাদের উচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রচারিত গুজবকে যথাযথভাবে সঠিক তথ্য দিয়ে জবাব দেওয়া।

আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরা সারাবাংলাকে বলেন, অতি অল্প সময়ে আসলে সর্বোচ্চ কতটুকু করা যায় সেটিকে আমরা প্রাধান্য দিয়েছি। যদি সেখানে থাকা অভিভাবকদের কারও কোনো অভিযোগ থাকে তবে সেটিকেও আমরা আমলে নেব অবশ্যই। তবে এতটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, কোয়ারেন্টাইনে এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনে আশকোনা হজ ক্যাম্পে সেসব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে যা কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া জরুরি। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে কারো তাপমাত্রা প্রমাণ তাপমাত্রার চাইতে একটু বেশি পেলেই তাকে আলাদা করে নেওয়া হচ্ছে। সুতরাং কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি নিয়ে আসলে খুব বেশি সমালোচনার কিছু আছে বলে মনে করি না।

সারাবাংলা/এসবি/জেএএম

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন