বিজ্ঞাপন

গ্রেনেড হাতে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যে কমান্ডার

December 15, 2020 | 4:09 pm

রা’আদ রহমান

যুদ্ধক্ষেত্রের সবচেয়ে অবধারিত সত্যের নাম মৃত্যু। মরে যাওয়া আর বেঁচে থাকার মাঝে ব্যবধানটা সেখানে ঝুলে থাকে এক সূক্ষ্ম সুতোর উপর। এপাশ থেকে ওপাশ হলেই নেমে আসে যবনিকা। একাত্তরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখসমরে নিহত প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুই চিরস্মরণীয়, তার মাঝেই কিছু মৃত্যু হয়ে উঠেছিল দুর্ধর্ষ আত্মত্যাগ, প্রচণ্ড দামী গৌরবগাঁথা। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের পূর্বক্ষণে মুক্তির স্বাদ ত্বরান্বিত করতে ৭ নম্বর সেক্টরের মেহেদিপুর সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের অকুতোভয় সাহসে আত্মত্যাগ তেমনই এক ঘটনা। যেখানে কমান্ডার শত্রুকে পরাভূত করতে তার সৈন্যদের পাঠাননি, নিজেই এগিয়ে গিয়েছিলেন অমিত সাহসে, প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন অবলীলায়!

বিজ্ঞাপন

১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম, বরিশালের বাবুগঞ্জের রহিমগঞ্জে। কৃষক পরিবারের সন্তান মহিউদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শর্ট সার্ভিস কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে কমিশন লাভ করা মহিউদ্দিন কর্মদক্ষতা আর প্রতিভায় দিনে দিনে হয়ে উঠেছিলেন একজন দক্ষ মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার। একাত্তরে তার পোস্টিং ছিল পাকিস্তানের কারাকোরামের পার্বত্য এলাকায়, পাকিস্তান-চীন সংযোগ সড়ক তৈরির কাজে। অত্যাচার, শোষণ আর নিপীড়নে দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া বাঙালিদের উপর মার্চের ২৫ তারিখ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চলাইটের সংবাদ পেয়েছিলেন, কিন্তু বিস্তারিত জানতে পারেননি। কারাকোরাম থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে করাচি বোনের বাসায় ফেরার পর তার কাছেই বাঙালিদের উপর চলমান নৃশংসতম জেনোসাইডের বিস্তারিত জানলেন। একইসাথে জানতে পারলেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ক্রোধ আর বেদনা বুকে চেপে কিভাবে দ্রুত চাকরি ছেড়ে দেওয়া যায় সেই উপায় খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু তিনি জানতেন তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম।

ফলে জুলাইয়ের ৩ তারিখে প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্রই ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন আরও তিনজন বাঙালি ক্যাপ্টেনকে নিয়ে পাঠানের ছদ্মবেশে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন। শিয়ালকোট দিয়ে ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে বিএসএফের সহায়তায় জাহাঙ্গীর বাকি ক্যাপ্টেনদের নিয়ে কলকাতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জাহাঙ্গীরকে ৭ নম্বর সেক্টরের মেহেদিপুর সাব-সেক্টরে কমান্ডার হিসেবে পদায়ন করা হয়। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পেয়েছিলেন এক পদাতিক প্লাটুন, এক মর্টার প্লাটুন, এক কোম্পানি ইপিআর আর চার কোম্পানি গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা, সাথে কিছু আর্টিলারি ও অন্যান্য সার্ভিস কোরের অল্প কয়েকজন সদস্য। একেবারেই অপ্রতুল এই বাহিনী নিয়েই মহানন্দা নদীর দুপাশে আলীনগর মোকরমপুর থেকে শাহপুর গড় পর্যন্ত প্রায় সাত মাইল বিস্তৃত এলাকায় পরবর্তী চার মাস ধরে দুর্ধর্ষ সব অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। কালাবাড়ি, ছোবরা, কানসাট ও বারঘরিয়ায় একের পর এক সফল যুদ্ধে পাকিস্তানিদের নাস্তানাবুদ করেছিল তার ইউনিট। এমনকি ২২ নভেম্বর ২৫ রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শাহপুর গড় দখল হয়ে গেলেও কয়েকদিনের মধ্যেই মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সুনিপুণ রণকৌশলে চতুর্মুখী আক্রমণে শাহপুর গড় আবার পুনঃদখল করে মুক্তিযোদ্ধারা।

অবশেষে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলের পরিকল্পনা করা হলো। যেহেতু চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরটি মহানন্দা নদীর তীরে অবস্থিত এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি এবং ইপিসিএএফের ৭ নম্বর উইং নদীর উঁচু পার ধরে সংযোগ মরিচাসহ বাংকার তৈরি করে শক্তিশালী শহর প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেছে। সুতরাং পরিকল্পনা হলো আক্রমণ হবে মহানন্দা নদী পেরিয়ে তিনদিক থেকে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এবং লেফটেন্যান্ট কাইউম তাদের দল নিয়ে সোনামসজিদ-শিবগঞ্জের পথ ধরে এগোবেন। লেফটেন্যান্ট রফিক ও লেফট্যানেন্ট বজলুর রশীদ তাদের দল নিয়ে রহনপুর-আমানুরা হয়ে শহরের দিকে এগোবেন। আর অভিযানের নেতা মেজর গিয়াস চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী রাস্তায় অবস্থান নিয়ে রাজশাহী থেকে পাকিস্তানিদের রিইনফোর্সমেন্ট এবং রসদ আসার পথ বন্ধ করে দেবেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের এই অপারেশনে আর্টিলারি সাপোর্ট দেবে। ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে কানসাট হয়ে শিবগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা মুক্ত করে পরদিন দুপুরের মধ্যে মহানন্দা নদীর উত্তর-পশ্চিম দিকে বারঘরিয়ায় পৌঁছান। বাকি সেনাদলগুলো তার সঙ্গে যোগ দিলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুত আর্টিলারি কাভারিং ফায়ার এলো খুব সামান্যই।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা তাতে বিন্দুমাত্র না দমে ১৩ ডিসেম্বর সকাল থেকেই পাকিস্তানিদের বিভিন্ন অবস্থানে হামলা চালাতে থাকেন। চারদিক থেকে তুমুল আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করে। মহানন্দার তীর ঘেঁষে তাদের দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাব্যুহ অকার্যকর হয়ে পড়তে শুরু করে।পূর্বদিক থেকে সৈন্য নিয়ে এসে রিইনফোর্স করতে না পেরে একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা শহরের ভেতর তাদের কংক্রিটের বাংকারগুলোতে আশ্রয় নেয়। জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে আগুয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের দল শত্রুর অবস্থান দখল করতে করতে সন্ধ্যার মধ্যে বিভিন্ন পথে শহরের প্রান্তে এসে পড়ে। জাহাঙ্গীর তার প্লাটুন নিয়ে আকন্দবারিয়া ঘাট দিয়ে নদী পার হয়ে টিকারামপুর এলাকায় পৌঁছান। রাতে প্লাটুন ও সেকশন কমান্ডারদের শহর দখলের পরিকল্পনা ও প্রত্যেকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। ঠিক হলো জাহাঙ্গীর রেহাইচর দিয়ে শহরের আরও ভেতরে ঢুকবেন। মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর শাহজাহান ও তুরফানের দল জাহাঙ্গীরের দলকে কাভারিং ফায়ার দেবেন।


বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর

এভাবে ট্রেঞ্চের পর ট্রেঞ্চ দখল নিয়ে এগোতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা, যুদ্ধ চলে পরদিন সকাল পর্যন্ত। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর সকাল ৮টার দিকে তার দল নিয়ে টিকারামপুরে নদীর পাড় ঘেঁষে এগুতে থাকা অবস্থায় ওয়্যারলেস অপারেটর নওশেরকে আরও এগিয়ে শত্রুর অবস্থান জানার জন্য পাঠান। নওশের খোঁজ নিয়ে এসে জানান, শত্রু ২০০-৩০০ গজ দূরে দূরে অনেকগুলো কংক্রিটের বাংকারে শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে। বাংকার আর সংযোগ মরিচাগুলো মুখোমুখি আক্রমণ চালিয়ে দখল করা দুঃসাধ্য বুঝতে পারলেন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু দমলেন না। শত্রুকে ধোঁকা দিয়ে কৌশলে দক্ষিণ দিক দিয়ে অগ্রসর হলেন তিনি, তার দল দুঃসাহসী তেজে অতর্কিতে শত্রুর উপর হামলা চালিয়ে একটানা ১০টির মতো বাংকার দখল করল। এরপর বাকি বাংকারগুলো দখলের জন্য এগোতে থাকলো তারা। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেল— একটা বাড়ির উপরে বসানো মেশিনগান নিয়ে।

একে তো কংক্রিটের দেওয়াল ভেদ করে শত্রুর অবস্থানে আঘাত হানা কঠিন, তার উপর মেশিনগানটি দোতলার উচ্চতায় বসানো থাকায় পাকিস্তানি মেশিনগানাররা উঁচু জায়গার সুবিধা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মুভমেন্ট সহজেই দেখতে পাচ্ছিল এবং তীব্র গুলিবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছিল। মেশিনগান অবস্থানের এই টানা গুলির সামনে মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগোতে পারছিলেন না। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের জন্য অবস্থা আরও কঠিন হয়ে গেলো বামপাশ থেকে কাভারিং ফায়ার দিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর শাহজাহান হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হওয়ায়, তার দলটা আটকে গেছে। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তার জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম মুহূর্তের মুখোমুখি হলেন। এখন যদি এই একটি মেশিনগানের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগোতে না পারে, তাহলে আক্রমণের তীব্রতা কমে যাবে। আর সে সুযোগে একবার পাকিস্তানিরা রিইনফোর্সমেন্ট এনে পাল্টা আক্রমণ চালাতে পারলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে, কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে মহানন্দা নদী, পিছু হটার সুযোগ নেই। তাই যেভাবেই হোক মেশিনগানটাকে থামিয়ে সামনে এগোতে হবে, পিছু হটার সুযোগ নেই।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে— এই মেশিনগানকে থামাবেন কিভাবে মহিউদ্দিন? প্রশিক্ষিত যোদ্ধা হিসেবে তিনি জানেন যে, মাটিতে শুয়ে উঁচুতে গুলি লাগানো কঠিন। তা ছাড়া রাইফেলের গুলিতে এই মেশিনগান পোস্ট ধ্বংস করা যাবে না। আর মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি জানেন যে, আর্টিলারি গোলা মেরেও কংক্রিটের ওই ছাদ গুঁড়িয়ে দেওয়া কঠিন। তাছাড়া শত্রুর এতো কাছাকাছি এসে নিজেদের আর্টিলারির ফায়ার সাপোর্ট কল করলে নিজেদের গোলায় শত্রুর সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের হতাহতের আশঙ্কা অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে একমাত্র মেশিনগানের বাংকারের ভেতরে গ্রেনেড চার্জ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। কিন্তু কার্যকরভাবে গ্রেনেড চার্জের জন্যও বাংকারের কমপক্ষে ১০-১২ গজের ভেতর পৌঁছাতে হবে। মেশিনগানের গুলির তোড়ে সামনে এগোনোই যেখানে মুশকিল, সেখানেও হয়তো চেষ্টা করলে আর ভাগ্যের কিছুটা সহায়তা পেলে বাংকারের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু গ্রেনেড ছুঁড়ে জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। প্রশ্ন হলো— কমান্ডার কাকে পাঠাবেন এই সুইসাইডাল মিশনে? নিশ্চিত মৃত্যু হবে, কিন্তু তার চেয়েও যেখানে সবচেয়ে জরুরি— নিখুঁতভাবে গ্রেনেডটা থ্রো করে বাংকারের ভেতরে ফেলা। নিশ্চিত মৃত্যু জেনে প্রাণ দিতে প্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধা তার ডিস্পোজালে আছে, কিন্তু কার উপর ভরসা করবেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন?

অবশেষে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললেন ক্যাপ্টেন। আর কাউকে না, নিজেই যাবেন নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর ট্রেঞ্চ বা বাংকার ধ্বংস করার জন্য গ্রেনেড চার্জ করা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, ট্রেঞ্চ-বাংকার ক্লিয়ার করতে গিয়ে সৈন্যের মৃত্যুও ঘটে নিয়মিতই। সচরাচর এসব ক্ষেত্রে এয়ার সাপোর্ট, আর্টিলারি ফায়ার, রকেট লঞ্চারসহ যে কোনো উপায় ব্যবহার করে ট্রেঞ্চ-বাংকার ধ্বংসের চেষ্টা করেন কমান্ডাররা। একান্তই কোনো উপায় না থাকলে গ্রেনেডসহ একজনকে পাঠান কমান্ডার। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কমান্ডার সরাসরি কাউকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন না, এমনকি সেই সেনা স্বেচ্ছায় দেশের জন্য আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকলেও। ৫০-৫০ ভাগ সুযোগ থাকলেও গ্রেনেড থ্রো করতে যাওয়া সেনাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন।

সেখানে একে তো এখানে মৃত্যুর সম্ভাবনা শতভাগ, তার উপর যখন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সামনে অপশন এলো যে, তিনি কাকে পাঠাবেন এই মিশনে, তখন অসমসাহসী জাহাঙ্গীর নিজেকেই বেছে নিলেন। যুদ্ধ ইতিহাসে এর আগে কখনো দেশের জন্য একজন কমান্ডারের স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগের নজির নেই, এরপরেও কখনো আছে কিনা সন্দেহ। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের জায়গায় থাকলে অন্য যে কোনো কমান্ডার হয়তো নিরাপদ দূরত্বে পিছিয়ে আসতেন, শক্তি সঞ্চয় করে আবার আক্রমণে যেতেন, নিদেনপক্ষে অন্য কোনো সেনাকে আক্রমণে পাঠাতেন। কিন্তু শত্রুকে প্রবল বিক্রমে গুঁড়িয়ে দিতে দিতে এগোনো বিজয়ের ঘ্রাণ পাওয়া অদম্য মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর থামতে চাইলেন না, দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়ে হলেও শত্রুকে পরাভূত করতে বেছে নিলেন নিজেকেই।

চারপাশে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের ভেতর হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ক্ষিপ্রতায় ক্রলিং করে রাস্তাটা পেরিয়ে বাড়ির একদম গোঁড়ায় চলে গেলেন। তারপর বাম হাতে এসএমজি আর ডান হাতে পিন খোলা গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে। নিখুঁত নিশানায় চোখের পলকে গ্রেনেডটা ছুঁড়ে দিলেন মেশিনগান পোস্ট লক্ষ্য করে। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত গ্রেনেডে ঘায়েল হলো পাকিস্তানি মেশিনগানাররা। গ্রেনেড চার্জ করে শত্রুর ওই অবস্থানটি দখলে নেওয়ার পর একজন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরকে দেখালেন বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাচ্ছে। তখনই ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর অসমসাহসে ছুটে গেলেন পলায়নপর পাকিস্তানিদের ধরতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের দুপাশে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তখন ক্যানেলের নীচে এলএমজি নিয়ে অবস্থান নিয়ে থাকা দুজন পাকিস্তানি সেনার গুলিবর্ষণ ঠেকাতে ফায়ার করছিলেন। শত্রুকে ধরতে ছুটে যাওয়া আগুয়ান জাহাঙ্গীর একা হয়ে পড়লেন। ওদিকে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা ইপিসিএএফের একদল রাজাকার আর পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের উপর একযোগে গুলিবর্ষণ শুরু করল। কপালে লাগা গুলির ধাক্কায় ছিটকে পড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।

বিজ্ঞাপন

গ্রেনেড চার্জ করার পর বাংকারটি কমান্ডারের এমন অসামান্য গৌরবদীপ্ত মৃত্যু মুহূর্তটি বর্ণনা করেছেন তার পাশে যুদ্ধ করতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম— “৫ নম্বর বাংকারের ওপর দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর কমান্ড করছেন। তার বাম পাশে আমি, ডান পাশ থেকে ১৫-১৬ বছরের এক মুক্তিযোদ্ধা সামনের দালানঘরের দিকে পলায়নরত পাকিস্তানি এক সেনাকে দেখিয়ে বলল, স্যার, পালিয়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর ‘ধর ওকে’ বলে সামনে দৌড় দিলেন। একই সময় পেছন থেকে একজন বলল, নিচে শত্রু। আমি পেছনে লাফ দিয়ে দেখি, দুজন পাকিস্তানি সেনা দুটি এলএমজি নিয়ে ক্যানেলের নিচে দুই মুখে পজিশন নিয়ে আছে। আমরা দুজন ওপর থেকে শত্রুকে গুলি করা আরম্ভ করলাম।…আমরা যখন শত্রুকে গুলি করায় ব্যস্ত, তখন অসীম সাহসী, দেশমাতৃকার নিবেদিত সন্তান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি নায়ক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ছুটে চলেছেন শত্রুকে জীবন্ত ধরার জন্য। তারা ধেয়ে আসা ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে জানালা দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করল। কপালের নিচে গুলি লেগে এপার-ওপার হয়ে গেলো।”

কমান্ডারের অবিস্মরণীয় এই আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত মুক্তিযোদ্ধারা ১৫ ডিসেম্বরেই একযোগে আক্রমণ চালিয়ে সকাল ১০টার মধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত করেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের লাশ উদ্ধার করে ১৫ তারিখ বিকেলে তাকে সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। যে সবুজ জমিনকে শত্রুমুক্ত করতে লাল রক্তের আত্মত্যাগে সাহসিকতা, নিবেদন আর দেশপ্রেমের অনন্য উদাহরণ তৈরি করে চলে গেলেন জাহাঙ্গীর, সেই দেশ স্বাধীন আর মাত্র দুই দিনের মাথায় শত্রুমুক্ত হলেও বিজয়ের স্বাদ পেলেন না ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তবু দেশের জন্য একজন কমান্ডারের অসামান্য এই আত্মত্যাগের ইতিহাস চির-ভাস্মর হয়ে রইবে এই দেশের সবুজ জমিনে, লাল রক্তের হরফে।

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন