বিজ্ঞাপন

কিটের দাম ৩ ভাগের একভাগ হলেও বেসরকারিতে কমেনি পিসিআর পরীক্ষার ফি

April 24, 2021 | 1:55 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্তে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (আরটি-পিসিআর) পরীক্ষা। ২০২০ সালের কোভিড-১৯ পরিস্থিতির শুরুর দিকে এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিটের চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। তখন একেকটি কিট ২৮শ টাকা পর্যন্ত দামে কিনতে হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে একপর্যায়ে কমতে থাকে সেই কিটের দাম। এ বছরে এসে সেই কিটের দাম ব্র্যান্ডভেদে নেমে এসেছে ৯৫০ টাকা থেকে ৯৮০ টাকায়। অর্থাৎ এই সময়ে কিটের দাম হয়ে গেছে তিন ভাগের একভাগ। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেসরকারি ল্যাবগুলোতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফি কমেনি।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বর্তমান করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে কিটের দাম যেহেতু তিন ভাগের একভাগে নেমে এসেছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেসরকারিতে নমুনা পরীক্ষার খরচও কমে আসা উচিত। বেসরকারি ল্যাবে এই পরীক্ষার খরচ দেড় হাজারে নেমে এলেও স্বল্প সামর্থ্যবান অনেকেই নমুনা পরীক্ষায় আগ্রহী হবেন।

সরকারি ও বেসরকারিভাবে করোনা পরীক্ষা

দেশে শুরুতে কেবল সরকারি ল্যাবেই করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সুযোগ ছিল। সেই পরীক্ষা করা হতো বিনামূল্যে। গত বছরের জুনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বুথ থেকে সংগৃহীত ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীর নমুনা পরীক্ষার ফি ২০০ টাকা এবং বাসা থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার ফি ৫০০ টাকা করা হয়। পরে এই ফি আবার কমানো হয়। বর্তমানে সরকারিভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার বিনিময়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।

করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকেই গত বছরের ২৯ এপ্রিল বেসরকারিভাবে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয় তিন হাসপাতালে। তখন কিটের দাম অনেক বেশি থাকায় সেই দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীর নমুনা পরীক্ষার খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা।

বিজ্ঞাপন

মাসখানেক পর ২১ মে অনুমোদিত কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষা করার অনুমতি দেয় সরকার। এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও নমুনা পরীক্ষার খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। তবে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাড়তি এক হাজার টাকা, অর্থাৎ মোট সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ ধরা হয়। বর্তমানে দেশের ৭০টি বেসরকারি ল্যাবে এই খরচেই করোনা নমুনা পরীক্ষা করানো হচ্ছে।

কিটের দাম কত?

দেশে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরুতে সরকারকে করোনা পরীক্ষার কিট সরবরাহ করে আসছিল একটি প্রতিষ্ঠান। পরে মে মাসে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানকে কিট সরবরাহের কাজ দিলেও তারা যথাসময়ে অনুমোদন করাতে না পারায় জুন মাসে কিট সংকট দেখা দেয়। সংকট মেটাতে নতুনভাবে কিটের অর্ডার দেওয়া হয় সিএমএসডি থেকে। সিএমএসডিতে যারা সরকারিভাবে ওয়ার্ক অর্ডারের মাধ্যমে কিট সরবরাহ করে, তারাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কিট সরবরাহ করে থাকে।

কিট সরবরাহকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের শুরুর দিকে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার কিটের দাম যা ছিল, এখন সেই কিটেরই দাম নেমে এসেছে এক-তৃতীয়াংশে।

বিজ্ঞাপন

কিট সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, দেশে এখন সরকারিভাবে ট্যাক্সসহ ৯৮০ টাকা দরে সিএমএসডিতে কিট সরবরাহ করা হচ্ছে। বেসরকারি ল্যাবগুলোতে আমরা ৯৬০ থেকে ৯৭০ টাকায় কিট সরবরাহ করে থাকি। তবে কিছু ক্ষেত্রে ভিটিএমসহ এর দাম এক হাজারের কিছু বেশি হতে পারে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, শুরুতে অল্প কিছু কোম্পানি এই কিট সরবরাহ করত বলে দাম ছিল অনেক বেশি। এখন এটি স্বাভাবিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অনেক বেড়েছে। তাই দাম কমে এসেছে। তবে এখন যেহেতু আবার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ, সেক্ষেত্রে দাম কিছুটা বাড়তে পারে। সেটিও কিট প্রতি হয়তো একশ টাকা হতে পারে। আবার নাও বাড়তে পারে।

কিটের দাম কমলে খরচ কেন কমবে না?

কিটের দাম তিন ভাগের একভাগে নেমে এলেও বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার খরচ কেন কমছে না— এ প্রশ্ন তুলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন। সরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে। বেসরকারি ল্যাবে খরচ কমলে স্বল্প সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা নমুনা পরীক্ষায় বেশি আগ্রহী হবেন। আর সেটি ঘটলে পরিস্থিতি বুঝতে সহায়ক হবে।

দেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও বিএমডিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে যেহেতু কিটের দাম কমে এসেছে, তাই এখনো সেই আগের খরচে বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া অযৌক্তিক। যদি কিটের দাম ৯৮০ বা ১ হাজার টাকাও হয়ে থাকে, তবে নমুনা পরীক্ষার খরচ দেড় হাজার টাকায় নামিয়ে আনা উচিত বলে মনে করি। তাতে মানুষ বেসরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষা করাতেও আগ্রহী হবে বেশি।

বিজ্ঞাপন

ডা. সহিদুল্লাহ বলেন, মহামারি মোকাবিলায় সবার একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। বেসরকারি খাতেও তাই যদি নমুনা পরীক্ষার মূল্য পুনঃনির্ধারণ করা হয়, তবে তাতে খুব বেশি সমস্যা আমি দেখি না। কারণ এর মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা মানুষের কাছে সহজলভ্য হবে। তাতে অনেক উপকার হবে। বেশি নমুনা পরীক্ষা হলে চিকিৎসা দিতে ও হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। একইসঙ্গে দ্রুত রিপোর্ট পাওয়ার কারণে আইসোলেশনও দ্রুত নিশ্চিত করা যাবে। আর এগুলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জন্য খুবই জরুরি।

জানতে চাইলে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আগে জানতে হবে কতসংখ্যক মানুষের মাঝে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা বাড়াতেই হবে। সরকার ১০০ টাকায় নমুনা পরীক্ষা করে দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি এসব স্থানের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। নমুনা পরীক্ষার পর ফল পেতে দেরি হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এসব কারণে কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা বা আইসোলেশন নিশ্চিত করতেও সময় বেশি লাগে। সেক্ষেত্রে বেসরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষাকে সহজলভ্য ও দ্রুত রিপোর্ট নিশ্চিত করা গেলে তা নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।

কিটের দাম কমলেও বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার খরচ কমেনি— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডা. লেলিন বলেন, একসময় আমাদের দেশে যে কিট আসত, তার দাম অনেক বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববাজারে এর দাম কমেছে। আর তাই বেসরকারি খাতে করোনা পরীক্ষার দাম পুনরায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এটি কোনোভাবেই দুই হাজার টাকার বেশি হতে পারে না। একইসঙ্গে থ্রি-জিন কিট ব্যবহার করেও নমুনা পরীক্ষা আরও বাড়ানো যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমরা কিন্তু বারবার নমুনা সংগ্রহের বুথ বাড়াতে বলছিলাম। সেটি এখনো সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে যদি বেসরকারি খাতে নমুনা পরীক্ষার ফি কমানো হয়, তাহলে অনেক মানুষ টেস্ট করাতে আগ্রহী হবে। ধরুন, কোনো পরিবারের সদস্য চার জন। তাদের সবার নমুনা পরীক্ষা করাতে গেলে খরচ হবে ১৪ থেকে ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার খরচ দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় নামিয়ে আনা গেলে তাদের খরচই নেমে আসবে ছয় থেকে আট হাজার টাকায়। এই খরচটা কিন্তু আরও বেশি মানুষের জন্য ব্যয়যোগ্য। তারা কিন্তু ১৪ থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ করতে অপারগ।

এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে প্রয়োজনে কিছু ছাড় দিতেও বলছেন ডা. লেলিন। তিনি বলেন, দেশে মহামারি নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি খাতের সবার একমত হওয়া উচিত যে ‘নো প্রফিট নো লস’ ভিত্তিতে তারা চলবে। এক্ষেত্রে তারা যদি লাভ করতে চায়, তবে ব্যাংক লোনের যে ইন্টারেস্ট আছে সেটি ধরে করতে পারে। ১৯৭১ সালে আমরা যা করেছি তা যদি ২০২১ সালেও করা যায়, তবে সেটি মহামারি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। যারা পিসিআর মেশিন কিনে সার্ভিস দিচ্ছে, তাদের প্রায় সবারই তো দাম এতদিনে উঠে আসার কথা। তাই এখন খরচ কমানো গেলে সবার জন্যেই সুবিধা হবে।

কী বলছে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ?

কিটের দাম প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে গেলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এখনো ৩ হাজার ৫০০ টাকা করেই নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। বাসায় গিয়ে ৪ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে নমুনা সংগ্রহের কথা থাকলেও এক্ষেত্রে ৫ হাজার থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকাও নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এত টাকা নিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও কিছু ল্যাবে এক কিটে দুই নমুনা পরীক্ষা করার ঘটনাও আছে কিছু ল্যাবে।

তবে এসব অভিযোগ বাদ দিলেও কিটের দাম কমার পরও কেন বেসরকারি ল্যাবে দাম কমানো হচ্ছে না— এমন প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য একাধিক ল্যাবের কর্মকর্তারা উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এটি সরকারের বিষয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে একটু সময় লাগতে পারে। এটা তো সারাদেশের ব্যাপার। প্রায় ১১ থেকে সাড়ে ১১ হাজার চিকিৎসাসেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের সবার সঙ্গেও তো কথা বলতে হবে।

কী বলছে স্বাস্থ্য অধিদফতর?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, এ বিষয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হবে। পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। সারাবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলমের সঙ্গেও।

তবে এর আগে, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার খরচ কমানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন