বিজ্ঞাপন

সিরিয়ায় প্রশিক্ষণ-যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরেন ‘জঙ্গি’ সাখাওয়াত

June 12, 2021 | 6:07 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: গ্রেফতার হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ‘আইটি বিশেষজ্ঞ’ সাখাওয়াত আলী লালু সিরিয়ায় গিয়ে একটি জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছ থেকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এরপর তিনি সিরিয়ার ইদলিবে সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ শেষে আরও কয়েকটি দেশ ঘুরে বাংলাদেশে ফেরেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে লন্ডন থেকে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করা এই জঙ্গি নেতা।

বিজ্ঞাপন

সাখাওয়াত আলী লালুকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

শুক্রবার (১১ জুন) বিকেলে নগরীর দক্ষিণ খুলশীতে আহলে হাদিসপন্থীদের একটি মসজিদের সামনে থেকে কাউন্টার টেররিজম বিভাগের কর্মকর্তারা সাখাওয়াত আলী লালুকে গ্রেফতার করেন। তার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়েছে। এসব বইয়ের মধ্যে আছে— মুরতাদ হত্যার বিধান, বাংলাদেশ: হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের এক বিপদজনক ও নতুন পর্যায়, তারাবিয়াহসহ আরও কয়েকটি বই। এছাড়া একটি পাসপোর্ট এবং একটি ট্যাব ও মিনি নোটবুক উদ্ধার করা হয়েছে।

গ্রেফতার সাখাওয়াত আলী লালু (৪০) নগরীর খুলশী থানার এম এম আলী রোডের বাসিন্দা শেখ মো. শমসের আলীর ছেলে। নগরীর লালখান বাজার এলাকার অভিজাত লন্ড্রি ‘ওয়াশো ড্রাই ক্লিনার্স’র মালিক তার বাবা।

বিজ্ঞাপন

সিএমপির কাউন্টার টেররিজম বিভাগের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাছিব খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিরিয়ায় অবস্থানের পর ইন্দোনোশিয়া হয়ে গত ২২ মার্চ সাখাওয়াত বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তাকে নজরদারি শুরু করি। চট্টগ্রামে নিজের বাড়িতে অবস্থান করে তিনি আনসার আল ইসলামের পক্ষে অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্র মতাদর্শ প্রচার শুরু করেন। গতকাল (শুক্রবার) তিনি উগ্র মতাদর্শের জিহাদি বইপত্র নিয়ে দক্ষিণ খুলশীতে যান। আমরা তথ্য পাই, জিহাদি কার্যক্রম সংগঠনের উদ্দেশ্যে বৈঠক করতে তিনি সেখানে গেছেন। তখন আমরা তাকে গ্রেফতার করি।’

এদিকে গ্রেফতারের পর কাউন্টার টেররিজম বিভাগের কর্মকর্তারা সাখাওয়াত আলী লালুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে সাখাওয়াত সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্পর্কিত তথ্য আড়াল করতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করেন।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান সাখাওয়াত চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়ায় পুলিশ লাইন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভারতে চলে যান। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করেন। সেখানে বসবাসরত আরিফ নামে এক বাংলাদেশির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ভারতে থাকা অবস্থায় আরিফের শ্যালিকাকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে তিনি স্ত্রীসহ চলে যান লন্ডনে। ২০০৯ সালে গ্রিনিজ ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সাইয়েন্সে এমএসসি সম্পন্ন করেন। ২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশে ফেরেন।

বিজ্ঞাপন

কয়েকবছর বেকার থাকার পর ২০১৪ সালে ‘কম্পিউটার অনলাইন ওয়েব ফার্ম’ নামে একটি অনলাইন ব্যবসা শুরু করলেও মাত্র ছয়মাসের মধ্যে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৫ সালে তিনি কিছুদিন নগরীর আন্দরকিল্লায় ‘তাজ সায়েন্টিফিক’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ২০১৬ সালে তাদের পারিবারিক ব্যবসা ‘ওয়াশো ড্রাই ক্লিনার্স’এ বসতে থাকেন। ২০১৭ সালে তুরস্কে চলে যাবার আগপর্যন্ত তিনি সেখানেই বসতেন।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মূলত লন্ডন থেকে ফেরার পর ২০১২ সালের দিকে সাখাওয়াতের মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে। এসময় সে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তার স্ত্রীর দুই ভগ্নিপতি আরিফ ও মামুনই মূলত তাকে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের যুক্ত করে।’

‘২০১৩ সালে আনসার আল ইসলামের সামরিক কমান্ডার বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার সঙ্গে আরিফ ও মামুনের মাধ্যমে বৈঠক করেন সাখাওয়াত। তখন বরখাস্ত মেজর জিয়াকে মোয়াজ নামে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সে জিয়ার ভাবশিষ্যে পরিণত হয় এবং পুরোপুরি সশস্ত্র জিহাদি কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করেন। এছাড়া আনসার আল ইসলামের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পেলে সংগঠনটির তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করতে থাকেন সাখাওয়াত। অর্থাৎ অনলাইনের মাধ্যমে জিহাদের প্রচার করতে থাকেন।’

বিজ্ঞাপন

এছাড়া নগরীর মনসুরাবাদ এলাকার হুজুর শফিক, লালখান বাজার এলাকার একটি এসি’র দোকানে কর্মচারি ওমর ফারুককে নিয়ে দেশজুড়ে আনসার আল ইসলামের সদস্যদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সরকার উৎখাতে ধর্মান্ধ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নস্যাৎ করা হয়েছে। অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টাকারীদের নেতা হিসেবে তখন জানানো হয় মেজর জিয়ার নাম। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া জিয়া পালিয়ে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামে যুক্ত হন এবং পরবর্তীতে সামরিক কমান্ডারের দায়িত্ব পান। গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল সরকার।

এদিকে ২০১৭ সালে তুরস্কে চলে যান সাখাওয়াত। কয়েকদিন তুরস্কে অবস্থানের পর অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়ায় চলে যান। সিরিয়ায় গিয়ে জিহাদে অংশ নেওয়া— এমনটাই তার লক্ষ্য ছিল বলছেন কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের কর্মকর্তারা।

এস আই রাছিব খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদ বিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িতদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য হায়াত তাহরীর আরশাম নামে একটি সংগঠন আছে। সাখাওয়াত সিরিয়ায় যাবার পর সেখানকার বিদ্রোহী জঙ্গিদের সঙ্গে যুক্ত হন। তারা তাকে ওই হায়াত তাহরীর আরশাম সংগঠনের মাধ্যমে ছয়মাসের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়। ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে আসাদবিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে যুদ্ধে অংশ নেয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।’

বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাশার আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটি সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে বিদ্রোহীদের মধ্যে আল-কায়েদা সমর্থক জিহাদি গোষ্ঠী, তুরস্ক-সমর্থিত বিদ্রোহী এবং কিছু কুর্দি বাহিনীও আছে।

কাউন্টার টেররিজম বিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সিরিয়ার ইদলিবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে সাখাওয়াত আবারও অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তুরস্কে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে আবারও অবৈধভাবে যান ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দোনেশিয়া থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে আবারও ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে এরপর ফেরেন বাংলাদেশে। গত ২২ মার্চ সাখাওয়াত বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

এসআই রাছিব খান জানিয়েছেন, ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় একবছর অবস্থান করেন সাখাওয়াত। সেখানেও সে জিহাদি কার্যক্রম সংগঠিত করার চেষ্টা করে।

তবে বাংলাদেশে বর্তমানে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে আর কারা জড়িত সে সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য সাখাওয়াতের কাছ থেকে এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন এস আই রাছিব। সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে নগরীর খুলশী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়ের হয়েছে।

সারাবাংলা/আরডি/এনএস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন